দেশে ধারাবাহিকভাবে কমছে হিন্দু সম্প্রদায়

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

দেশে টানা চার বছর ধারাবাহিকভাবে কমেছে হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা। এর পেছনে তিনটি কারণ বলছেন বিশেষজ্ঞরাÑ প্রজনন, মৃত্যু ও স্থানান্তর। তবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা বলছেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে দেশের মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ২০২২ সালের হিসাবে ছিল ৯ দশমিক ৬৩ শতাংশ; ২০২১ সালে ছিল ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ; ২০২০ সালে ছিল ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং ২০১৯ সালে ছিল ১০ দশমিক ৫৫ শতাংশ। বিবিএস পরিচালিত ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিক’ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

বিবিএসের পরিসংখ্যানে বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের জনসংখ্যাও কমতে দেখা গেছে। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২৩ সালে বৌদ্ধ জনসংখ্যা ১ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০২২ সালে ছিল ১ দশমিক ১১ শতাংশ; ২০২১ সালে ছিল ১ দশমিক ১৩ শতাংশ। ২০২৩ সালে খ্রিস্টান জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে শূন্য দশমিক ২৪ শতাংশে। যদি এর আগের বছর ২০২২ সালে ছিল শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ।

হিন্দু সম্প্রদায় কমার কারণ হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, তিনটি জনমিতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জনসংখ্যার হার বাড়ে বা কমে। সেগুলো হচ্ছেÑ জন্মহার, মৃত্যুহার ও স্থানান্তর। বিশ^জুড়ে মুসলমান জনগোষ্ঠীর মধ্যে জন্মহার বেশি। বাংলাদেশেও মুসলমানদের প্রজনন হার বেশি। অন্যদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে জন্মহার কম। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, হিন্দু জনগোষ্ঠীর মধ্যে মোট প্রজনন হার বা টোটাল ফার্টিলিটি রেট তুলনামূলক কম। অর্থাৎ হিন্দু দম্পতিরা তুলনামূলকভাবে কম সন্তান জন্ম দেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়া এখনকার বিষয় না। ঐতিহাসিককাল থেকে ধারাবাহিকভাবে এই অঞ্চল থেকে হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাচ্ছে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত উপমহাদেশ ভাগ হওয়ায় পাকিস্তান (পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান) মুসলমানদের এবং ভারত হিন্দুদের দেশ বলে বিবেচিত হতে থাকে। দেশ ভাগের আগে ব্রিটিশ ভারতের ১৯৪১ সালের আদমশুমারিতে পূর্ববাংলার (বর্তমান বাংলাদেশ) হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ২৮ শতাংশ। ১০ বছর পরে অর্থাৎ ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রথম আদমশুমারিতে হিন্দু কমে ২২ শতাংশে দাঁড়ায়। এর মধ্যে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের কারণে অনেক হিন্দু দেশ ছেড়ে ভারতে চলে যান। ভারত থেকেও অনেক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশে চলে আসেন। এই দেশান্তর জনসংখ্যার অনুপাতে প্রভাব ফেলে।

এরও আগে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমার প্রবণতা ছিল। ১৯০১ সালের আদমশুমারিতে বাংলাদেশে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল ৩৩ শতাংশ। এরপর প্রতি ১০ বছর পর পরিচালিত আদমশুমারিতে এই হার কমতে দেখা গেছে। অর্থাৎ এই প্রবণতা ১০০ বছরের বেশি পুরনো। ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশ ভাগ হওয়া, ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধ এ দেশে হিন্দু জনসংখ্যা কমে যাওয়ার কারণ।

অসাম্প্রদায়িক চেতনার মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে জন্ম নেওয়া স্বাধীন বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ সব ধর্মাবলম্বীর অধিকার সমান বলে স্বীকৃতি পায়। রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। তবে পাকিস্তান আমলে করা অর্পিত সম্পত্তি আইন বহাল থাকে, যা ছিল বৈষম্যমূলক।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রথম আঘাতটি আসে ১৯৭৭ সালে, যখন পঞ্চম সংশোধনী অনুমোদনের মাধ্যমে সংবিধান থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি বাদ দেওয়া হয়। এর ১১ বছর পর ১৯৮৮ সালের জুনে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করা হয়।

বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আইনজীবী রানা দাশগুপ্ত আমাদের সময়কে বলেন, সংখ্যালঘুরা দেশত্যাগ করছে না। তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের পর সাংবিধানিক পরিবর্তনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ বাঙালি জাতিকে ধর্মের নামে বিভক্ত করা হয়েছে। হিন্দুদের রাষ্ট্রীয় সংখ্যালঘুতে পরিণত করা হয়েছে। হিন্দুরা পাকিস্তান আমলে সমনাগরিকত্ব পায়নি, স্বাধীন বাংলাদেশেও তারা একই পরিস্থিতির শিকার।

এদিকে পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ক্রমাগতভাবে প্রতি বছরই মুসলিম জনসংখ্যা বাড়ছে। বিবিএসের সর্বশেষ জরিপে ২০২৩ সালে মুসলিম জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৮৯ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ; ২০২২ সালে ছিল ৮৮ দশমিক ৯৮ শতাংশ; ২০২১ সালে ছিল ৮৮ দশমিক ৯৯ শতাংশ এবং ২০২০ সালে ছিল ৮৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ।