ঢাকার বস্তিতে কেন বরিশালের মানুষ বেশি?

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

ধান-নদী-খাল এই তিনে বরিশাল। বহুল প্রচলিত প্রবাদের এই এক বাক্যেই বৃহত্তর এ বিভাগের পরিচয়। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন বরিশালের চিত্রই পাল্টে দিয়েছে। বসবাসের প্রায় অনুপযোগী হয়ে পড়া মাতৃভূমি ছেড়ে এ অঞ্চলের মানুষ আশ্রয় নিচ্ছে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে। লবণাক্ততা এখন এতটাই বেড়েছে যে, পানি থাকলেও তা ব্যবহার করতে পারছেন না তারা। বছরের পর বছর এমন পরিস্থিতি চাষে অনাগ্রহী করেছে এ অঞ্চলের কৃষকদের। ফলে কাজের খোঁজে অভিবাসী তারা। অবস্থা এখন এমন যে মাঠের পর মাঠ খালি জমি পড়ে আছে, চাষ করার নেই কেউ।

ঢাকায় অবস্থান করা বিভিন্ন বিভাগের মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অবস্থান বরিশালের মানুষের। আবার ঢাকায় এসে বস্তিতেও সবচেয়ে বেশি অবস্থান এ অঞ্চলের মানুষের। উত্তরবঙ্গের একসময়ের দারিদ্র্যপীড়িত অঞ্চলের তকমা এখন গিয়ে ঠেকেছে দক্ষিণাঞ্চলের এই বিভাগে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ বিভাগের মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে বেশি। নদীভাঙন, লবণাক্ততা, চাষের জমি নষ্ট হয়ে যাওয়ায় কাজ হারিয়ে ফেলা এবং পরিকল্পিত উন্নয়ন না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে নিজ ভূমি ছেড়ে অভিবাসী হচ্ছে এ অঞ্চলের মানুষ।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য বলছে, ২০২৩ সালে দেশের শহরাঞ্চলে যত বস্তি ছিল, সেগুলোর বাসিন্দাদের শীর্ষ ভাগই আসে পাঁচ জেলা থেকে। আর ওই জেলাগুলোর মধ্যে আবার শীর্ষে রয়েছে বরিশাল। বস্তিগুলোতে বরিশালের পরিবার ১৩ দশমিক ৫৪ শতাংশ। দ্বিতীয় অবস্থানে ময়মনসিংহ ৯ দশমিক ৩৪ শতাংশ, আর ৭ দশমিক ৮২ শতাংশ নিয়ে

তৃতীয় অবস্থানে কিশোরগঞ্জের পরিবারগুলো। সবদিক থেকে তুলনামূলক উন্নত কুমিল্লার পরিবারও বস্তিতে কম নয়। বিভিন্ন শহরের বস্তিতে ৬ দশমিক ৫২ শতাংশ পরিবার নিয়ে এ জেলার অবস্থান চতুর্থ। আর পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে নেত্রকোনা, বস্তিগুলোতে বসবাসকারী এ জেলার পরিবারের সংখ্যা ৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। বিবিএসের প্রকাশিত স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩ জরিপে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এতে দেখা যায়, শহরগুলোতে বস্তির সংখ্যা এক বছরের ব্যবধানে কিছুটা বেড়েছে। ২০২৩ সালে শহরাঞ্চলে বস্তির অনুপাত ৫ দশমিক ৫৪ (পরিবার), যেটি ২০২২ সালেও ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৪। তবে ২০২১ সালের তুলনায় দেশে বস্তির অনুপাত কিছুটা কমই, ওই বছর দেশে বস্তির অনুপাত ছিল ৬ দশমিক ৬৭।

ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরে বরিশালের মানুষ বেশি হওয়ার প্রধান কারণ হিসেবে জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের অধ্যাপক ড. মোকাদ্দেম হোসেনের মতে, শুধু একটা কারণ দিয়ে এটাকে ব্যাখ্যা করা যাবে না। যেহেতু দক্ষিণাঞ্চলে অসংখ্যবার ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে, বন্যা হচ্ছে, সেখানে নদীভাঙনও বেশি। এ ছাড়া ঘূর্ণিঝড় ও মৌসুমি ঝড়ের প্রবণতা, লবণাক্ততা, জলাবদ্ধতাসহ জলবায়ুজনিত অনেক কারণ আছে। এসব কারণে ক্লাইমেট মাইগ্রেন্ট (জলবায়ু অভিবাসী) হয়।

ঢাকায় বা অন্য শহরে বরিশালের মানুষের অভিবাসন বেশি হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, ‘দক্ষিণাঞ্চল সব সময়ই দুর্যোগপীড়িত এলাকা। দেশের জিডিপিতে এ অঞ্চলের অবদান ২ শতাংশ। যখন মারাত্মক দুর্যোগগুলো হয় দেখি তখন ফসল হতে শুরু করে ঘরবাড়িসহ ব্যাপক যে ক্ষয়ক্ষতি হয়, তখন নাজুক জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেড়ে যায়। যখন আপনি গৃহহীন হয়ে পড়েন, সবকিছু হারিয়ে ফেলেন তখন অসহায় মানুষের সংখ্যা বেড়ে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘এর বাইরেও আমরা দেখতে পাই বরিশালের মানুষের মধ্যে শিক্ষার হার বেশি। তৃতীয় কারণ হলো বরিশালের মানুষের মধ্যে এক ধরনের উদ্যোক্তা প্রবণতা দেখা দিয়েছে। এ প্রবণতা কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ফেনী ও নোয়াখালীর মানুষের মধ্যে বেশি ছিল। পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে দক্ষিণাঞ্চলের লোকদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে তারা শুধু বিনিয়োগমুখীই নয়, তারা ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য বহির্মুখী হচ্ছেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যাচ্ছে। এটি হচ্ছে পদ্মা সেতুর প্রভাবে।’

অভিবাসনের পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবও আছে উল্লেখ করে ড. মোকাদ্দেম হোসেন বলেন, ‘বরিশালের মানুষদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বও আছে। সব মিলিয়েই তারা অভিবাসী হচ্ছে, তবে জলবায়ু পরিবর্তনই প্রধান কারণ।’

বরিশাল অঞ্চলের মানুষ লবণাক্ততার কারণে কৃষিজমিতে চাষাবাদ করতে পারছেন না। ফলে উৎপাদন নেই, নেই কর্মসংস্থানও। লবণাক্ত পানি প্রবেশ করায় সেখানকার জনস্বাস্থ্যও হুমকির মুখে। পানির তড়িৎ পরিবাহিতা বা ইলেকট্রিক্যাল কনডাকটিভিটি (ইসি) ছিল প্রতি সেন্টিমিটারে ৩০০ থেকে ৪০০ মাইক্রো সিমেন্স পর্যন্ত। কিন্তু মাঝেমধ্যেই নাটকীয়ভাবে এই মান বেড়ে হয় প্রতি সেন্টিমিটারে ১ হাজার ৩৬২ মাইক্রোসিমেন্স।

আঞ্চলিক কৃষি গবেষণা কেন্দ্র, বরিশালের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. বিমল চন্দ্র কুণ্ডু বলেন, ‘লবণাক্ত পানির কারণে এখানে চাষে সমস্যা হচ্ছে। রবি মৌসুমে এখানে বড় সমস্যা পানি। দেখা যায় পর্যাপ্ত পানি আছে, কিন্তু সেটি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দক্ষিণাঞ্চলে এ কারণে ইরিগেশন সিস্টেমই (চাষ পদ্ধতি) উন্নত হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এ অঞ্চলে যেমন এবার কয়েকবার ঘূর্ণিঝড় হলো। যারা সরিষা, খেসারি ফলিয়েছেন সব নষ্ট হয়েছে। টমেটো দুবার লাগানো হয়েছে, দুবারই নষ্ট হয়েছে। কৃষকরা তো বারবার চারা কিনতে পারেন না। এখানে অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।’

এই কৃষিবিজ্ঞানীর মতে, এ অঞ্চলে এখন প্রচলিত কৃষি আর নেই, কিছু বাণিজ্যিক কৃষি আছে। মাঠের পর মাঠ খালি পড়ে আছে, কোনো কৃষক নেই। সবাই ঢাকায় কিংবা বিদেশে থাকেন। জমি বর্গা নিয়ে কিছু কৃষক চাষ করেন, তাও তারা সব সময় চাষের পানি পান না।

ড. বিমল বলেন, ‘উত্তরবঙ্গ, কুমিল্লা বা বগুড়ায় এখন বাণিজ্যিক কৃষি, সে তুলনায় কৃষিনির্ভর এ বিভাগে (বরিশাল) সে রকম কোনো রূপান্তর নেই। এ অঞ্চলে অধিকাংশ জমিরই মালিক নেই। বর্গাচাষি কিছু আছেন, কিন্তু শ্রমের হিসাব করলে লাভ পাওয়া খুব কঠিন।’

এ প্রসঙ্গে ঢাবির অধ্যাপক ড. মোকাদ্দেম বলেন, ‘আমরা দেখতে পাই বৃষ্টিপাত উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্যাঞ্চলে কমে যাচ্ছে, আর সে কারণে নদীর পানির প্রবাহ কমে যাচ্ছে। ঠিক একই সময়ে সেখানে সমুদ্রের পানি বেড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে সাবমার্সিবল অবস্থা তৈরি হয়েছে। জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড় ও ঝড় এগুলো অতিমাত্রায় হয়ে যাচ্ছে। মাসে তিন থেকে চারবার জোয়ার-ভাটা হওয়ার কারণে সেখানে লবণাক্ত পানি বেড়ে যাচ্ছে। তা ছাড়া দক্ষিণাঞ্চলে কালচার ফিশারিজের (চিংড়ি চাষ) কারণেও লবণাক্ত পানি নিয়ে আসতে হয়। এটিও সেখানে লবণাক্ততা বাড়ার অন্যতম কারণ।’

রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বসবাস বরিশাল বিভাগের মানুষের, আর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাস ময়মনসিংহ বিভাগের মানুষের। সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভূতাত্ত্বিক কারণে এই দুই বিভাগের মানুষ নিজ ভূমি ছেড়ে কাজের জন্য ঢাকায় আসে বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, কাজের ক্ষেত্র কম ও অতি দরিদ্রতার কারণেও এসব অঞ্চলের মানুষের রাজধানীতে আসার প্রবণতা বেশি বলে মনে করছেন তারা।

বিবিএস প্রকাশিত ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের তথ্যে দেখা যায়, বিভাগগুলোর মধ্যে বরিশালের মানুষ সবচেয়ে কম, মাত্র ৭৮ দশমিক ৩০ শতাংশ নিজ বিভাগে অবস্থান করে। বরিশাল বিভাগের ১৮ দশমিক ৬২ শতাংশ মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য ঢাকায় অবস্থান করছে, যেখানে ময়মনসিংহ বিভাগের ১৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ মানুষ ঢাকায় অবস্থান করছে।

নিজ বিভাগে থাকার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে সিলেট। নিজ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন কম হওয়া, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেশি হওয়ার কারণে এই বিভাগের মানুষের অন্য বিভাগে স্থানান্তর হওয়ার প্রবণতা কম। জনশুমারির হিসাব বলছে, এ বিভাগের মাত্র ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ ঢাকায় অবস্থান করে। নিজ বিভাগে অবস্থান করছে ৯৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ সিলেটবাসী।

সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর ঘটে মূলত দুটি কারণে। একটি হলো একেবারেই বাধ্য হয়ে, আরেকটি উন্নত জীবনের আকর্ষণে। বরিশাল বিভাগে খাল, বিল, নদী-নালা সবচেয়ে বেশি। এ এলাকাটি অনেক প্রান্তিক। ফলে এখানকার মানুষ নদীভাঙনও সবচেয়ে বেশি দেখে। নদীভাঙলে একটা গ্রামীণ জীবন কিংবা একটা এলাকা পুরোপুরি বিলীন হয়ে যায়। সেখানকার মানুষ তখন বাধ্য হয় জীবন-জীবিকার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তাই করে। সে কারণেই এসব এলাকার মানুষের অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর ঘটে। এটি অর্থনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক কারণ।

গবেষণা বলছে, বৃহত্তর ময়মনসিংহের মানুষ খুব বেশি স্বাবলম্বী না। ময়মনসিংহ এলাকায় বরিশালের মতো নদী এলাকা না থাকলেও সেখানে হাওর, বাঁওড় রয়েছে, কিছু কিছু এলাকা আবার পাহাড়ি। এটি একটি রিস্ক ফ্যাক্টর (ঝুঁকির কারণ)। ফলে অনেকে সেখান থেকে স্থানান্তরে বাধ্য হচ্ছেন।