রবিবার , ৪ মার্চ ২০১৮ | ১২ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরীর খবর
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

জেলে গেলেই হিরো হওয়া যায় না

Paris
মার্চ ৪, ২০১৮ ৫:৩০ অপরাহ্ণ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশে বিএনপি সমর্থক বুদ্ধিজীবী ও কলামিস্টদের অনেকেই তাদের লেখা বা কথাবার্তায় মুখের উপর একটা নিরপেক্ষতার নেকাব টানেন। তাতে অনেক পাঠকেরই এটা বুঝতে কষ্ট হয় যে, তারা সরকার এবং বিএনপি কাকে সমর্থন করছেন? যারা বুদ্ধিমান পাঠক তারা ধরে ফেলেন, কৌশলী কলামিস্টরা কৌশলে বিএনপিকেই সমর্থন দিচ্ছেন। সম্প্রতি ঢাকার কাগজে এরকম দু’জন চতুর কলামিস্টের লেখা পড়েছি।

তাদের একজন একটি নেকাব পড়া ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকের সম্পাদকীয় বিভাগের ছোট মুনশি। সম্পাদক নিজে যেসব লেখা লিখে বিতর্কিত হতে চান না বা “তওবা সম্পাদক” বলে আবার পরিচিত হতে রাজি নন, সেসব লেখা তার এই ছোট মুনশিকে দিয়ে লেখান। বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির দায়ে সাজা দিয়েছেন আদালত। ফলে আদালতের রায় নিয়ে বিদেশি কূটনীতিকেরাই যেখানে কথা বলতে রাজি নন (ইউরো পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দল পর্যন্ত), সেখানে দেশের ছোট-বড় “মুনশিরা” কথা বলবেন কোন সাহসে? তাই তারা নিরপেক্ষতার নেকাবে মুখ ঢেকে কথা বলছেন, এখন একটু ছোট গলায়। সুযোগ পেলে বড় গলায় বলবেন।

সম্প্রতি ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকটির ছোট মুনশি আদালতের রায়ের সমালোচনা করতে না পেরে সংবিধানের একটি ধারা ব্যাখ্যা করার নামে বেগম খালেদা জিয়াকে অপরাধমুক্ত হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন। এটা প্রমাণ করা গেলে বিএনপি নেত্রী যে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার যোগ্যতা হারাননি তা বলা যাবে। এই ছোট মুনশিরা কবে থেকে দেশের সংবিধান-বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠলেন তা জানি না। দেশের প্রথম সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা এবং সংবিধান-বিশেষজ্ঞ ড. কামাল হোসেন পর্যন্ত যেখানে এখনো স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না, সেখানে একই ভেকের দলের কোলাহল তাত্পর্যপূর্ণ।

বাংলাদেশের সংবিধানে ৬৬ (২) (খ) ধারায় বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তি জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার এবং সংসদ সদস্য থাকার যোগ্য বিবেচিত হবেন না, যদি তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো ফৌজদারি অপরাধে দোষী প্রমাণিত হয়ে কমপক্ষে দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন এবং তার মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর কেটে না গিয়ে থাকে।” দেশের এতিম শিশুদের অর্থ আত্মসাত্ একটি বড় ধরনের নৈতিক স্খলন এবং ফৌজদারি অপরাধ। আদালতে এই মামলার বিচার চলেছে নয় বছর। আদালতে বেগম জিয়ার পক্ষে সমর্থন করে লড়েছেন এক ঝাঁক তুখোড় আইনজীবী। আদালত দীর্ঘকাল উভয় পক্ষের যুক্তিতর্ক শোনার পর বিএনপি নেত্রীকে দোষী সাব্যস্ত করে ৫ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন। আদালতের রায় অনুযায়ী এটা অবশ্যই তার নৈতিক স্খলন।

উচ্চ আদালতের আপিলে যদি প্রমাণিত হয় তিনি নির্দোষ এবং নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধ করেননি, তাহলে আমিও অত্যন্ত খুশি হব। কিন্তু তা না হওয়া পর্যন্ত, হোক নিম্নআদালত, তার রায়কে টপকে আমি কি করে বলব, বেগম জিয়া নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধ করেননি? তাহলে তার সশ্রম কারাদণ্ড হলো কেন? নিরপেক্ষতার নেকাব পরা দৈনিকটির ছোট মুনশি তার ব্যক্তিগত রায়ে বলেছেন, বেগম খালেদা জিয়ার অপরাধ নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধ কিনা, তা এখন একটি প্রশ্ন। অর্থাত্ প্রশ্নের আড়ালে নিজেকে গোপন রেখে তার সারা নিবন্ধটিতেই প্রচ্ছন্নভাবে বলার চেষ্টা করেছেন খালেদা জিয়া নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধ করেননি। উচ্চ আদালতে বিষয়টি যখন বিবেচিত হতে যাচ্ছে, তখন এই ধরনের মন্তব্য দ্বারা বিচার ও জনমতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা যায় কিনা, তা আমি জানি না, তবে এই ধরনের মন্তব্য করে পরে আদালতে গিয়ে ক্ষমা প্রার্থনার নজির এই ‘নিরপেক্ষ’ পত্রিকাটির রয়েছে।

পত্রিকাটির ছোট মুনশি তার মন্তব্যটি প্রশ্নের আকারে করলেও তার পাঠকদের আসলে বোঝাতে চেয়েছেন, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার দ্বারা বিএনপি-নেত্রী নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধ করেননি। এই মন্তব্যের পক্ষে তিনি পণ্ডিত সেজে কিছু যুক্তিতর্কের অবতারণাও করেছেন। দেখে বিস্মিত হয়েছি, আর্জেন্টিনার পতিত স্বৈরিণী শাসক ইসাবেলা পেরনকে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের জন্য দায়ী করে আদালতে বিচার চলাকালে তাকে বাঁচানোর জন্য তার পক্ষের কয়েকজন আইনজীবী যে যুক্তিতর্কের অবতারণা করেছিলেন, তার সঙ্গে বাংলাদেশের ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকের ছোট মুনশির যুক্তিতর্কের বেশ মিল আছে।

ইসাবেলা আর্জেন্টিনার শাসন ক্ষমতায় বসে দুর্নীতি, স্বজন পোষণ ও ক্ষমতার অপব্যবহারের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছিলেন। দীর্ঘকাল শাসন ক্ষমতায় থাকার পরেও তিনি শেষ রক্ষা করতে পারেননি। দেশব্যাপী গণবিক্ষোভের মুখে তাকে দেশ ছেড়ে পালাতে হয়েছিল। তারপরও আইনের বিচার তাকে ছাড়েনি। যতদূর মনে পড়ে বিদেশ থেকে তাকে ধরে এনে সম্ভবত দশ কি বারো বছর কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। সেদিক থেকে বাংলাদেশে খালেদা জিয়া ভাগ্যবতী নেত্রী। তাঁকে তাঁর বয়স বিবেচনা করে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে এবং ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা রাশেদ খান মেননের ভাষ্য অনুযায়ী বিএনপি-নেত্রী কারাগারে রানির হালে আছেন। তিনি যদি আপিল আদালতের বিচারে নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে অবশ্যই বলব তিনি নৈতিক স্খলনজনিত কোনো অপরাধ করেননি। নইলে আদালতের একটি সুস্পষ্ট রায় সামনে রেখে বাংলাদেশের ইসাবেলা পেরনের পক্ষে ছোট মুনশির মতো ওকালতি করতে যাব কী করে?

এবার আসি দ্বিতীয় লেখাটির কথায়। এই লেখাটিও ঢাকার কাগজেই প্রকাশিত হয়েছে। লেখক বিশিষ্ট কলামিস্ট। তার লেখায় তথ্য ও সুযুক্তি এবং কিছুটা নিরপেক্ষতাও থাকে। তবে বিএনপি’র প্রতি তার যে একটা দুর্বলতা আছে, তা তার লেখা পড়লেই বোঝা যায়। তার লেখা ‘নিরপেক্ষ’ দৈনিকটির ছোট মুনশির মতো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত নয়। তার একটি সাম্প্রতিক লেখাতেও (রায়-পরবর্তী রাজনীতির চালচিত্র) বিএনপিকে সুপরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সুপরামর্শটি হলো, যেকোনো অবস্থাতেই অর্থাত্ বেগম জিয়া যদি নির্বাচনে প্রার্থী হতে না পারেন, তাহলেও দলটি যেন নির্বাচনে অংশ নেয়।

২০১৪ সালে নির্বাচন বয়কট করেও বিএনপি যে সরকারের পতন ঘটাতে পারেননি তিনি সে কথাটা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু যে কথাটা উল্লেখ করেননি, তা হলো, ১৯৯৬ সালে ফেব্রুয়ারি-নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী লীগ খালেদা সরকারের পতন ঘটাতে পেরেছিল। এটা পারার কারণ, আওয়ামী লীগসহ বিরোধী দলগুলোর নির্বাচন বর্জনের পেছনে অনেক যুক্তিযুক্ত কারণ ছিল এবং এই নির্বাচন বর্জনের পেছনে বিপুল জনসমর্থন ছিল। ২০১৪ সালে আওয়ামী লীগের পন্থার অনুকরণ করে নির্বাচন বর্জন দ্বারা বিএনপি-জামায়াত হাসিনা সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছে। পারেনি তার কারণ, এই বর্জনের পেছনে কোনো যুক্তিযুক্ত কারণ এবং জনসমর্থন আদৌ ছিল না। ২০১৮ সালের আসন্ন নির্বাচনেও বিএনপি যদি কেবল বেগম জিয়ার কারাবন্দি থাকাকে ইস্যু করে নির্বাচন বয়কট করে তাহলে জনসমর্থন পাবে না। যেকোনো বর্জননীতি, অসহযোগ নীতি তখনই সফল হয়, যখন তার পেছনে অকুণ্ঠ জনসমর্থন থাকে। বিএনপি’র কোনো আন্দোলনের পেছনে আগেও জনসমর্থন ছিল না। এখনো নেই। আমার আলোচ্য বিশিষ্ট কলামিস্ট নিশ্চয়ই একথাটা জানেন, কিন্তু তার লেখায় প্রকাশ করেননি।

বিএনপির প্রতি কলামিস্টের যে দুর্বলতা আছে তার এই লেখাতেও তার প্রকাশ ঘটেছে। তিনি লিখেছেন, “রাজনৈতিক নেতাদের জেলে যাওয়া একটি স্বাভাবিক ঘটনা, তারা ফিরেও আসেন বিপুল জনপ্রিয়তা নিয়ে। খালেদা জিয়ার জেলে গমন তাকে আরও শক্তিশালী নেতায় পরিণত করেছে, তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে বৈ কমেনি।” আমার কথা, বেগম জিয়া জেলে গেছেন মাত্র কয়েক সপ্তাহ হয়। এর মধ্যেই তার জনপ্রিয়তা বেড়েছে, তিনি শক্তিশালী নেতায় পরিণত হয়েছেন, এটা এই বিশিষ্ট কলামিস্ট টের পেলেন কিভাবে? এই ব্যাপারে কোনো জনমত জরিপ হয়েছে কি,— না, এটা কলামিস্টের নিজস্ব উদ্ভাবন অথবা wish fulfilment?

বঙ্গবন্ধুর জীবন থেকে কোনো উদাহরণ টানব না। চট্টগ্রাম-শার্দুল সদ্য প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীকে গ্রেফতার করা হলে প্রতিবাদে লাখ লাখ মানুষ নেমেছিল চট্টগ্রামের রাস্তায়। বেগম জিয়ার জেল গমনের সময় সেই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি কোথায়? জনগণের কোনো দাবি-দাওয়া বা জনপ্রিয় রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে কোনো নেতা জেলে গেলে তার সমর্থনে জনতা রাজপথে নামে। কিন্তু দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে কোনো নেতা-নেত্রী আদালতের বিচারে বা অন্য কোনোভাবে জেলে ঢুকলে তার পক্ষে মানুষ রাস্তায় নামে কি?

জেনারেল জিয়াউর রহমান তো দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের দায়ে খোন্দকার মোশতাক আহমদকে পাঁচ বছরের জন্য জেলে পাঠিয়েছিলেন। তিনি কি বর্ধিত জনপ্রিয়তা নিয়ে জেল থেকে বেরিয়েছিলেন? তার রাজনৈতিক জীবনের মৃত্যু ঘটেছিল! সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ তো দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার, নারী কেলেঙ্কারি ইত্যাদি দায় নিয়ে ছয় বছর জেলে কাটিয়েছেন। কিন্তু জনপ্রিয়তার জোরে তিনি আর ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তন করতে পেরেছেন কি? জামায়াত নেতা ’৭১-এর ঘাতক গোলাম আযমও তো বিএনপির আমলে কিছুদিন জেলে কাটিয়ে ‘মজলুম জননেতা’ খেতাবটি গ্রহণ করেছিলেন, তাতে তার শেষ রক্ষা হলো কি?

যেসব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী জনগণের দাবি-দাওয়া নিয়ে রাজনৈতিক মামলায় জেলে যান, তারা জেলে গিয়ে আরও জনসমর্থিত হন এবং জেল থেকে আরো শক্তিশালী নেতা হয়ে বের হন। কিন্তু বেগম জিয়া জনগণের কোনো দাবি-দাওয়া নিয়ে, রাজনৈতিক কারণে জেলে যাননি। গেছেন দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি কারণে। তিনি যদি উচ্চ আদালতের রায়ে নির্দোষ প্রমাণিত হন, তাহলে নিশ্চয়ই তার শক্তি ও জনপ্রিয়তা আরো বাড়বে। অন্যথায় নির্দিষ্ট সাজার মেয়াদ শেষ করে বা আগে তিনি যদি জেল থেকে বের হন এবং রাজনীতিতে থাকেন, তাহলে বড়জোর ‘কারানির্যাতিত নেত্রী’ এই খেতাবটুকু শুধু ধারণ করতে পারবেন। তার বেশি কিছু নয়। তিনি এবং তাঁর দল দেশের রাজনীতিতে টিকে থাকতে পারবেন, যদি এ বছরের শেষের দিকে নির্বাচনে তাঁর দল সকল শক্তি নিয়ে অংশগ্রহণ করে। এই সুপরামর্শ বিএনপিকে দিয়ে বিশিষ্ট কলাম লেখক অবশ্যই বেগম জিয়া এবং তার দলের প্রকৃত হিতৈষীর কাজ করেছেন।

সূত্র: ইত্তেফাক 

 

সর্বশেষ - মতামত