কলঙ্কমুক্তি মহামায়া ভবনের, আতঙ্কমুক্তি বাসিন্দাদের

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

একাত্তরে আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রামের কমান্ডার মীর কাসেম আলীর নির্মমতার সাক্ষী ডালিম হোটেলের (মহামায়া ভবন) বাসিন্দাদের আতংক কাটতে শুরু করেছে। আদালত যে বাড়িকে একাত্তরের ‘ডেথ ফ্যাক্টরি’ বলেছেন মীর কাসেম আলীর ফাঁসিতে স্বস্তি পাচ্ছেন সেই মহামায়া ভবনের মালিকের উত্তরসূরীরা। তারা বলেছেন, মীর কাসেমের ফাঁসির মধ্য দিয়ে তাদের মাথা গোঁজার ঠাঁইটির কলঙ্কমুক্তি হয়েছে।

 

তবে একাত্তরে ডালিম হোটেলে আলবদর বাহিনীর নির্যাতনের শিকার এবং স্বজন হারানোরা এখনও সেখানে শুনতে পান নিরীহ বাঙালির করুণ আর্তনাদ, চাপা কান্না। এখনও ডালিম হোটেলের সামনে গেলে শিউরে উঠেন নির্যাতিতরা।

 

আর ডালিম হোটেলের দোতলায় ডান পাশের যে বাসাটিতে টর্চার সেল গড়ে নিরীহ বাঙালিদের হত্যা করা হয়েছিল সেটি এখনও ভুতুড়ে ঘরের মতোই আছে। চার কক্ষবিশিষ্ট ওই ঘরটি খালিই আছে।

 

ভবন মালিকের পুত্রবধূ দিপ্তী নাথ ঘরটি দেখিয়ে বাংলানিউজকে বলেন, এই ঘরে লোকজন ধরে এনে নির্যাতন করে মেরে ফেলত বলে আমার শ্বশুরের কাছে শুনেছি। ঘরটি প্রায়ই খালি থাকে। ভাড়াটিয়া দিলে বেশিদিন থাকেনা। এমনিতে কোন সমস্যা নেই, তারপরও লোকজন থাকে না কেন, বুঝতে পারিনা।

 

একাত্তরে মীর কাসেমে আলীর নির্দেশেই চট্টগ্রাম শহরের টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্রী চন্দ্রমোহন নাথ ওরফে রঞ্জন নাথের মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির।

 

একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ২০১২ সালের ১৭ জুন মতিঝিলে দৈনিক নয়াদিগন্ত কার্যালয় থেকে মীর কাসেমকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরের বছর ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তার যুদ্ধাপরাধের বিচার।

 

২০১৪ সালের ২ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়ে কিশোর মুক্তিযোদ্ধা জসিমসহ মোট আটজনকে হত্যার দায়ে মীর কাসেমের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ এসেছিল। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ আপিল বিভাগ জসিমকে হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। এছাড়া আরও বিভিন্ন অভিযোগে পৃথকভাবে মোট ৫৮ বছরের কারাদণ্ড দেয়।

 

এরপর মীর কাসেম আলী আপিল বিভাগে মৃত্যুদণ্ডের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। গত ৩০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে গঠিত আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চ মীর কাসেম আলীর চূড়ান্ত রায় পুর্নবিবেচনার (রিভিউ) আবেদন খারিজ করে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখার আদেশ দেন। শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) একাত্তরের সেই জল্লাদের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

 

এর আগে ট্রাইব্যুনাল এবং ‍আপিল বিভাগে রায় ঘোষণার সময় মহামায়া ভবনের মালিকের পরিবারের কাউকে বাসায় গিয়ে পাওয়া যায়নি। প্রতিবারই বাসা তালাবদ্ধ পাওয়া গেছে।

 

তবে এবার ফাঁসি কার্যকরের প্রক্রিয়ার মধ্যে শনিবার রাতে সেই মহামায়া ভবনে গিয়ে দেখা গেছে পরিবারের লোকদের মধ্যে আগের মতো সেই আতংক আর নেই। সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্ত্বি থাকলেও তারা আগের চেয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক।

 

চন্দ্রমোহন নাথ মারা গেছেন ২০০৩ সালে। তার চার ছেলের মধ্যে বড় ছেলে বাবুল নাথ ও ছোট ছেলে অরুণ চন্দ্র নাথ থাকেন মহামায়া ভবনের সেই টর্চার সেলের সামনাসামনি দোতলায় বাম পাশের ফ্ল্যাটে। ছেলে সুভাষ নাথ ও সুখরঞ্জন নাথ থাকেন হাটহাজারী উপজেলার ফতেয়াবাদে গ্রামের বাড়িতে।

 

বাবুল নাথ এবং অরুণ নাথকে থাকায় বাসায় পাওয়া যায়নি। তবে অরুণ নাথের স্ত্রী দিপ্তী নাথ সেই টর্চার সেলটি ঘুরে ঘুরে দেখান। মীর কাসেম আলীর ফাঁসি হয়েছে, কেমন লাগছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমার শ্বশুর বেঁচে থাকলে আরও ভাল হত। তার বাড়ি যে দখল করে এমন খারাপ কাজ করেছে তার ফাঁসি হয়েছে শুনলে তিনি অনেক বেশি স্বস্ত্বি পেতেন। আমারও ভাল লাগছে, একজন রাজাকারের ফাঁসি হচ্ছে। এটা তো অবশ্যই খুশি হওয়ার কথা।

 

অরুণ চন্দ্র নাথের সঙ্গে যোগাযোগ হল টেলিফোনে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, একাত্তরে আমি অনেক ছোট ছিলাম। আমার বড় ভাই বাবুল নাথের বয়স ছিল ১২ বছর। আমার বাবা আর বড় ভাইয়ের মুখে শুনেছি আমাদের বাড়ি দখল করে দোতলায় টর্চার সেল বানানো হয়েছিল। অনেককে এনে মেরে ফেলা হয়েছে। আমরা সবাই একাত্তরে ভারতে ছিলাম। দেশ স্বাধীনের পর ফিরে এসে আমরা বাড়িটি ফেরত পাই।

 

‘বাবা বলতেন যুদ্ধের পরও অনেক স্বজন হারানো মানুষ আমাদের বাসায় এসে কান্না করত। অনেকে আমাদের বিল্ডিংটা দেখার জন্য আসতো। দীর্ঘদিন আমরা ছাড়া কেউ এখানে থাকেনি। তবে এখন সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আমরা দীর্ঘদিন ধরে আছি। এখন আর কোন সমস্যা নেই।’ বলেন অরুণ নাথ।

 

ডালিম হোটেলে নির্যাতনের শিকার মো.জাহাঙ্গীর চৌধুরী বলেন, আমার খুব কষ্ট লাগে, খুব কষ্ট। ডালিম হোটেলের সামনে গেলে আমি চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনা। আমাদের যে কিভাবে নির্যাতন করেছে, ভুলতে পারব না। ৪৬ বছর ধরে ডালিম হোটেলের কলঙ্ক বয়ে বেড়িয়েছে এই ভবন। সেই কলঙ্কের অবসান হয়েছে, তবে যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে ততদিন ডালিম হোটেল মীর কাসেমদের নির্যাতনের সাক্ষ্য বয়ে বেড়াবে।

 

সূত্র:বাংলানিউজ