করোনা, ঈদ ও আমাদের চামড়া শিল্প

একে তো করোনা, তারপর বন্যা! সব মিলে কঠিন সময়ের মুখোমুখি আমরা। কিন্তু সময় তো বসে নেই। বহমান সময়ের চৌকাঠ পেরিয়ে এসে গেছে পবিত্র ঈদুল আজহা। সামর্থ্যবানদের পশু কোরবানির মাধ্যমে সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টি অর্জনে ত্যাগের এ উৎসবে জড়িয়ে আছে ধনী-গরিবের মাঝে পারস্পরিক সহযোগিতা ও হক আদায়ের দায়িত্ব পালন।

একইসঙ্গে এ উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন। কোরবানি উপলক্ষে রমরমা হয়ে ওঠে পশু বিক্রয়, চামড়া, লবণ ও মসলাদির ব্যবসা। দেশের হাজারও খামারি ও দরিদ্র কৃষক-গৃহস্থরা তাদের আদরযত্নে পালিত পশু বিক্রির মাধ্যমে সামর্থ্যবানদের কোরবানি করার সুযোগ করে দেয় আর নিজেরাও তাদের বিনিয়োগ থেকে লাভ পেয়ে থাকে। পশু কোরবানির সঙ্গে জড়িয়ে আছে সম্ভাবনাময় চামড়া শিল্প।

তৈরি পোশাক শিল্পের পর বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত হল চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য শিল্প। মূলত কোরবানির পশুর চামড়া থেকেই দেশের সর্বাধিক কাঁচা চামড়ার চাহিদা পূরণ করা হয়। প্রতি বছর দেশে গড়ে ১ কোটি ৬৫ লাখ পিস কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করা হয়, যার মধ্যে ছাগলের চামড়া ১ কোটি, গরুর চামড়া ৫০ লাখ এবং ভেড়া ও মহিষ মিলে ১৫ লাখ।

অর্থাৎ প্রতি বছর সর্বমোট ২২ কোটি বর্গফুট চামড়া উৎপাদিত হয়ে থাকে। এ সরবরাহকৃত চামড়ার প্রায় ৪৮ ভাগই আসে ঈদুল আজহা উৎসবে। তাছাড়া প্রাত্যহিক মাংস সরবরাহের জন্য জবাইকৃত পশুর চামড়া এবং বিবাহ ও অন্যান্য উৎসব থেকেও উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণে চামড়া সংগৃহীত হয়ে থাকে। রফতানি খাতে বর্তমানে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের অবদান প্রায় ৯ শতাংশ।

দেশের জিডিপি ও শিল্পোৎপাদনে চামড়ার অবদান যথাক্রমে ০.৬ শতাংশ ও ২ শতাংশ। সম্ভাবনাময় খাত বিবেচনা করে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে সরকার চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যকে ‘প্রোডাক্ট অব দ্য ইয়ার’ ঘোষণা করে। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে চামড়া শিল্প সফলতার মুখ দেখছে না।

২০১৯-২০ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি হয়েছে ৬৩ কোটি ১৮ লাখ ডলারের, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে ৯ শতাংশ কম এবং আট মাসের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় সাড়ে ১২ শতাংশ কম।

দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টাতেও দেশে চামড়া শিল্পের সুসংগঠিত বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। প্রতি বছর ঈদুল আজহায় কোরবানির চামড়া নিয়ে বাজারে অস্থিরতা, চামড়ার নির্ধারিত দাম না মানা, বকেয়া আদায়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের দেন-দরবারসহ বিভিন্ন বিষয়ে তৈরি হয় শোরগোল। তার ওপর এবার করোনাভাইরাসের কারণে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং বন্যার কারণে তৈরি হয়েছে সমস্যা।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, করোনার কারণে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া, বন্যার কারণে পশুর পরিবহনে জটিলতা এবং অনেক জায়গায় হাট পরিচালনা সম্ভব না হওয়ায় পশুর চাহিদা কমে যাবে ৩০ শতাংশের উপর।

দ্বিতীয় বৃহত্তম খাত হওয়া সত্ত্বেও অদৃশ্য কোনো শক্তির কারণে সম্ভাবনাময় এ শিল্প প্রায় বিপর্যস্ত। বিক্রেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চামড়ার ন্যায্য দাম না পাওয়ার পেছনে রয়েছে নানা সমস্যা। চামড়ার বাজারে সমস্যার জন্য তৃণমূল পর্যায় থেকে আড়ত ব্যবসায়ীরা পর্যন্ত ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে।

সরকার প্রতি বছর চামড়ার মূল্য বর্গফুট হিসেবে নির্ধারণ করে দেয়ার পরও সেটা কেউ মানছে না। আন্তর্জাতিক বাজারে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের দাম বেশি থাকা সত্ত্বেও দেশে চামড়ার দাম কমে যাওয়া অত্যন্ত দুঃখের বিষয়। বিধান অনুসারে কোরবানির পশুর চামড়া বা এর মূল্যের হক এতিম ও গরিব মানুষের। যারা কোরবানি দেন তারা মাদ্রাসা ও এতিমখানায় চামড়া দিয়ে দেন অথবা চামড়া বিক্রি করে সে টাকা এতিম ও গরিবদের দেন।

কোরবানির পশুর চামড়া থেকে প্রাপ্ত অর্থ, দরিদ্র ও এতিমদের সামাজিক নিরাপত্তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসলাম ধর্মে গরিবদের হক নষ্ট না করার কথা বলা হয়েছে বারবার। অথচ কিছু ব্যবসায়ী নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে চামড়া কিনে গরিবদের হক নষ্ট করছে।

গত এক দশকে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়ার মূল্য কমেছে প্রায় অর্ধেকের মতো, যদিও চামড়া ও চামড়াজাত সব পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। কেন এমনটা হচ্ছে তার যথার্থ কোনো ব্যাখ্যা মিলছে না। ২০১৩ সালের কোরবানি ঈদে ঢাকায় প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম ৮৫-৯০ টাকা এবং খাসির চামড়ার দাম ৫০-৫৫ টাকা থাকলেও বিগত দুই বছরে (২০১৮ ও ২০১৯) সেই দাম যথাক্রমে ৪০-৫০ টাকা এবং ১৮-২০ টাকায় নেমে আসে। গত বছর দেশের চামড়া খাত নজিরবিহীন দরপতনের সাক্ষী হয়েছিল।

গরুর দাম লাখ টাকা হলেও এর চামড়া বিক্রি করতে হয়েছিল মাত্র ৪০০ টাকায়। আবার আড়তে এসে প্রতিটি চামড়া ৫০ টাকায়ও বিক্রয় করতে পারেনি মৌসুমি কাঁচা চামড়া সংগ্রহকারীরা। ফলে দেশের নানা স্থানে স্থানীয় জনগণ ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা পশুর চামড়া মাটিতে পুঁতে ও আগুনে পুড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। করোনা মহামারীতে আসন্ন ঈদুল আজহায় এ সংকট যাতে তীব্রতর না হয় সেদিকে বিশেষ নজর রাখা প্রয়োজন।

বিগত কয়েক বছরে চামড়ার দাম পতন নিয়ে আড়তদার ও ট্যানারি মালিকদের পাল্টাপাল্টি অভিযোগ চামড়া বাজারকে অস্থিতিশীল করে তুলছে। ট্যানারি শিল্প খাতের প্রধান কাঁচামাল হল চামড়া। ট্যানারি মালিকরা প্রতি বছর রফতানির জন্য ১৫ থেকে ১৬ কোটি বর্গফুট চামড়া সংগ্রহ করে থাকেন, যার অর্ধেকই আসে কোরবানির পশুর চামড়া থেকে। ট্যানারি মালিক ও মৌসুমি ব্যবসায়ীরা চামড়ার দাম কমে যাওয়ার জন্য বরাবরই আড়তদারদের দায়ী করেন।

অন্যদিকে, আড়তদাররা তাদের পাওনা টাকা পান না বলে অভিযোগ করে আসছেন। আড়তদাররা বকেয়া টাকা না পাওয়ার কারণে নাকি মৌসুমি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে নতুন করে চামড়া কিনতে পারছেন না। ফলে কমে যাচ্ছে চামড়ার দাম।

দোষারোপের এ পরিস্থিতিতে চামড়ার দাম না পেয়ে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা অনেক কম দামে চামড়া বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। অন্যদিকে লাভের পুরো অংশই চলে যায় অদৃশ্য শক্তির হাতে, যাদের দৌরাত্ম্য থামাতে হলে এ জায়গায় হস্তক্ষেপ দরকার। প্রয়োজন একটি শক্তিশালী টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে নির্ধারিত দামে চামড়া কেনাবেচা হচ্ছে কিনা তা তদারকি করা।

একইসঙ্গে প্রয়োজন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারিত দামে কাঁচা চামড়া বেচাকেনা নিশ্চিত করতে ও কাঁচা চামড়ার গুণাগুণ যাতে নষ্ট না হয় সে জন্য স্থানীয়ভাবে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে চামড়া সংরক্ষণের জন্য ব্যবসায়ী ও স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি লক্ষ রাখার নির্দেশ প্রদান করা।

গত বছর চামড়ার উপযুক্ত দাম নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার কাঁচা চামড়া রফতানির সিদ্ধান্ত নেয়, যা নিয়ে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে ছিল মতবিরোধ। করোনাভাইরাস যেভাবে আন্তর্জাতিক বাজারকে স্থবির করে রেখেছে, সেখানে এ বছর কাঁচা চামড়া রফতানি করা সম্ভব কিনা তা ভাবার পাশাপাশি প্রয়োজন চামড়া ব্যবসায়ী সংগঠনের মাঝে সমন্বয় বৃদ্ধি করা।

চামড়া সংরক্ষণের সঙ্গে লবণ শিল্পের সম্পৃক্ততা রয়েছে। বিভিন্ন সময় কোরবানির ঈদে দাম বাড়ার কারণে লবণের সংকটের কথা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। তবে এবার ঈদুল আজহায় চামড়া সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ লবণ সরবরাহের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ উদ্যোগ প্রশংসনীয়। তারপরও যাতে কেউ কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে সেদিকে নজর রাখতে হবে।

করোনা সংকটের এ সময়ে সরকার কোরবানির পশুর হাট এবং পশু কেনাবেচা নিয়ে নানাবিধ উদ্যোগ নিলেও প্রশ্ন থেকে যায় কোরবানি পরবর্তী পশুর চামড়ার যথাযথ বিপণন ও সরবরাহ চেইন নিয়ে। স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কোরবানির চামড়া সংরক্ষণে সহযোগিতা করার কথা বলছে, প্রত্যাশা সরকার এবার পারবে চামড়া শিল্পের অদৃশ্য শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে, অদৃশ্য শক্তির ভয়াল থাবায় পিষ্ট হওয়া থেকে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের রক্ষা তথা গরিবদের হক নিশ্চিত করতে।

সামগ্রিকভাবে চামড়া শিল্পের অগ্রগতির জন্য কয়েকটি বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে : ১. হাজারীবাগ থেকে হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরী স্থানান্তরিত হলেও বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) কাজ পুরোপুরি সম্পন্ন না করায় মিলছে না লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের অনুমোদন।

এতে করে ইউরোপের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশ থেকে চামড়া কিনছে না। ফলে সংকুচিত হয়ে পড়ছে চামড়ার আন্তর্জাতিক বাজার, স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এ সমস্যার সমাধান প্রয়োজন; ২. দেশীয় বাজারে চামড়ার দাম নিশ্চিত করা; ৩. জাতীয় চামড়া নীতিমালা বাস্তবায়ন এবং এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য সহজ শর্তে আর্থিক সহায়তা প্রদান, ৪. চামড়ার সঠিক সংরক্ষণের জন্য দক্ষ শ্রমিক ও জনবল তৈরি করা এবং ৫. ট্যানারি মালিকদের সঙ্গে আড়তদার ও অন্য ব্যবসায়ীদের সমন্বয় বাড়ানো।

চামড়া শিল্পের সঙ্গে পাদুকা, ব্যাগ ও অন্যান্য পণ্য তৈরির কারখানার রয়েছে গাঢ় সম্পর্ক। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২০০ থেকে ২৫০ মিলিয়ন জোড়া জুতা তৈরি হচ্ছে, যা দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার ৫০ শতাংশ মেটানো হচ্ছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পাদুকা ও চামড়াজাত পণ্য রফতানির সুযোগকে বিস্তৃত করা গেলে চামড়া খাতকে আরও অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। তার জন্য নিশ্চিত করতে হবে চামড়ার সঠিক দাম, দক্ষ সরবরাহ চেইন ও সুসংগঠিত বাজারব্যবস্থা।

অবকাঠামোগত উন্নয়ন, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের মূল্য সংযোজন, সহজ শর্তে আর্থিক সহযোগিতার ব্যবস্থা, চামড়াজাত পণ্যের বহুমুখীকরণ, সর্বোপরি পরিবেশগত উন্নয়ন ঘটাতে পারলে চামড়া শিল্প আরও বেশি প্রসারিত হবে, বাড়বে রফতানি আয়।

২০২৫ সালের মধ্যে চামড়া রফতানিতে বিশ্বের প্রথম ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রণীত হয়েছে চামড়া খাতের রফতানি রূপরেখা। আর এ রূপরেখা বাস্তবায়নে সরকারের নানামুখী উদ্যোগে চামড়া শিল্প হবে আরও বেশি সম্ভাবনাময় ও টেকসই।

ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম : প্রফেসর, কৃষিব্যবসা ও বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

দেবাশিষ শর্মা : প্রকল্প ইনটার্ন, কৃষিব্যবসা ও বিপণন বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়

 

সুত্রঃ যুগান্তর