কমছে বিদেশি পর্যটক

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

হলি আর্টিসানের ধাক্কা এখনও সামলাতে পারেনি সম্ভাবনাময় পর্যটনশিল্প। ২০১৬ সালে রাজধানীর গুলশানে ভয়াবহ সেই জঙ্গি হামলার পর বিদেশি পর্যটক আগমনে ধস নামে। তখন অনেক দেশ বাংলাদেশের ওপর ‘ভ্রমণ সতর্কতা’ জারি করলেও তা প্রত্যাহার করেনি এখনও। এ অবস্থায় দেশে সার্বিকভাবে বিদেশি পর্যটক কমছে বলে জানিয়েছেন এ খাতের বেসরকারি উদ্যোক্তারা। তবে জাতীয় পর্যটন সংস্থা বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) কাছে বিদেশি পর্যটক আগমনের কোনো পরিসংখ্যানই নেই।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীন দেশের প্রত্নস্থান ও সংশ্নিষ্ট জাদুঘরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে পর্যটক। তবে অধিদপ্তরের এ-সংক্রান্ত পরিসংখ্যানে গরমিল আছে বলে জানিয়েছেন ট্যুর অপারেটররা। টিকিটের ভিত্তিতে পর্যটক গণনা করার কারণেই এমন অভিযোগ। অন্যদিকে, বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনে কমছে বিদেশি পর্যটক।

এ প্রসঙ্গে বিমান ও পর্যটন সচিব মহিবুল হক বলেন, ‘বিদেশি পর্যটকের সঠিক পরিসংখ্যান এ মুহূর্তে নেই। পুলিশের বিশেষ শাখা ইমিগ্রেশন পুলিশের মাধ্যমে বিদেশিদের হিসাব রাখলেও তাদের কাছ থেকে পাওয়া যায় না। তাই পর্যটন মন্ত্রণালয় থেকে এ পরিসংখ্যান তৈরির নতুন উদ্যোগ নিয়েছি। ‘অ্যাডভান্সড প্যাসেঞ্জারস ইনফরমেশন সিস্টেম’ (এপিআইএস) নামে নতুন একটি সফটওয়ারের মাধ্যমে বিদেশি পর্যটকদের পরিসংখ্যান তৈরি করা হবে।’ বিদেশি পর্যটক কমছে- এমন তথ্য জানা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ভালো সেবা না দিলে বেসরকারি কোনো উদ্যোক্তার পর্যটক কমতেই পারে। কোনো নির্দিষ্ট সময়ে বনজঙ্গল দেখার আগ্রহও পর্যটকের কম হতে পারে। এ জন্য সারাদেশে বিদেশি পর্যটক কমে গেছে, এমন কথা বলা যায় না।’ বিভিন্ন দেশের ট্রাভেল অ্যালার্ট কাটানোর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সেসব দেশের দূতাবাসগুলোর সঙ্গে শিগগিরই বৈঠক করা হবে।’

সুন্দরবনে কমছে বিদেশি পর্যটক :বন বিভাগের সুন্দরবন পূর্ব শাখা (বাগেরহাট) ও সুন্দরবন পশ্চিম শাখা (খুলনা) সূত্রে জানা গেছে, ২০১৫-১৬ সালে বিদেশি পর্যটক ছিল দুই হাজার ৭৭০ জন, ২০১৬-১৭ সালে যা নেমে আসে এক হাজার ২২৮ জনে। ২০১৭-১৮ সালে বিদেশি পর্যটক ছিল দুই হাজার ৭৯৬। ২০১৮-১৯ সালে কমে হয়েছে দুই হাজার ১৯৯ জনে। সুন্দরবন অঞ্চলে জাপান ও ইউরোপীয় পর্যটকদের ট্যুর পরিচালনা করে বেসরকারি ‘বেঙ্গল ট্যুরস’। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ হোসেন জানান, বিগত বছরগুলোতে ধারাবাহিকভাবে সুন্দরবনকেন্দ্রিক তার কোম্পানিতে পর্যটক কমেছে। ২০১২-১৩ সালে তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আগত পর্যটক যেখানে ছিল সাড়ে পাঁচ হাজার, ২০১৪-১৫ সালে তা প্রায় অর্ধেক কমে দুই হাজার ২০০ জনে নেমে আসে। ২০১৫-১৬ সালে এক হাজার ৩০০, ২০১৬-১৭ সালে ৯০০, ২০১৭-১৮ সালে ৯০০ ও ২০১৮-১৯ সালে ৬৩৯। কেন পর্যটক কমছে- এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ”হলি আর্টিসানের পর বেশিরভাগ দেশ এখনও বাংলাদেশের ওপর থেকে ‘ট্রাভেল অ্যালার্ট’ অপসারণ করেনি। এ জন্য সরকারের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা কোনো চেষ্টাও করেননি। বিদেশিদের যদি পরিসংখ্যান দিয়ে বোঝানো হতো, ২০১৬ সালের পর বাংলাদেশে কী পরিমাণ জঙ্গি হামলা হয়েছে আর অন্য দেশে কী পরিমাণ হয়েছে, তাহলে চিত্রটি পরিস্কার হয়ে যেত। এর মাধ্যমে বাংলাদেশেও বিদেশি পর্যটকের আগমন বেড়ে যেত।”

বিদেশি দর্শনার্থী কমলেও সুন্দরবনে বেড়েছে দেশি পর্যটক। ২০১৬-১৭ সালে সুন্দরবনে দেশি দর্শনার্থী ছিল ৯৯ হাজার ৬৫৪ জন। পরের বছর তা বেড়ে হয় এক লাখ ৮৬ হাজার ৩৮৬ জনে। ২০১৮-১৯ সালে এ পর্যন্ত এক লাখ ৬০ হাজার ২২২ জন দেশি পর্যটক সুন্দরবন ভ্রমণ করেছেন।

দেশের উত্তরবঙ্গ, পার্বত্য চট্টগ্রাম, সুন্দরবন ও শ্রীমঙ্গলে বিদেশি পর্যটকদের নিয়ে ট্যুর পরিচালনা করে ‘জার্নিপ্লাস’। সংস্থার প্রধান নির্বাহী তৌফিক রহমান জানান, ২০১৫ সালে তার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রায় এক হাজার ৩০০ বিদেশি বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছে। ২০১৬ সালে সে সংখ্যা একশ’তে নেমে আসে। ২০১৭ সালে ছিল ২০০ জন। পরের বছরও প্রায় একই রকম। তবে ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ৫৭৫ বিদেশি পর্যটক তিনি পেয়েছেন। বিভিন্ন দেশের ভ্রমণ সতর্কতা না কাটানোকেই পর্যটকের নিম্নমুখী চিত্রের কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন।

কমিউনিটি বেজড ট্যুরিজম (সিবিটি) নিয়ে কাজ করে ‘আজিয়ার ফেয়ার ট্রেড অ্যান্ড ট্যুরিজম’। টাঙ্গাইলে এ সংস্থার সঙ্গে সম্পৃক্ত রয়েছে ৩০টি স্থানীয় মানুষের বাড়ি। প্রতিষ্ঠানটির সিইও শাহিদ হোসেন শামিম জানান, ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনিও পর্যটক-খরায় ভুগেছেন। তবে চলতি বছরের শুরু থেকে বিদেশি পর্যটকের আগমন বাড়ছে। এর আগে ২০১৭-তে তিনি ১২৫ জন বিদেশি পেলেও ২০১৮-তে তা ৬০ জনে নেমে আসে।

প্রত্নস্থানে বাড়ছে পর্যটক :দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোতে ভ্রমণকারী পর্যটকের সংখ্যার ওপর ভিত্তি করে পরিসংখ্যান তৈরি করে ‘প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর’। এর মধ্যে লালবাগ দুর্গ জাদুঘর, বালিয়াটি জাদুঘর, সোনারগাঁ পানাম সিটি, ময়মনসিংহ জাদুঘর, শালবন বিহার, ময়নামতি জাদুঘর, পাহাড়পুর বৌদ্ধবিহার ও জাদুঘর, মহাস্থানগড় জাদুঘর, বাগেরহাট জাদুঘর, রবীন্দ্র কুঠিবাড়ী শিলাইদহ, জাহাজঘাটা প্রত্নস্থল, গোবিন্দভিটা প্রত্নস্থল উল্লেখযোগ্য। এসব প্রত্নস্থাপনায় গত কয়েক বছর বেশিরভাগ সময়ে দেশি-বিদেশি পর্যটক বেড়েছে। ২০১৭ সালে বিদেশি দর্শনার্থী ছিল ১৩ হাজার ৫০৮। ২০১৮ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ হাজার ৮১৫ জন। একইভাবে ২০১৪ সালে ১৩ হাজার ৪৬৬, ২০১৫ সালে ১৩ হাজার ৯৭৪ ও ২০১৬ সালে ১২ হাজার ১১৯। ২০১৮ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে বিদেশি দর্শনার্থী এসেছে ১৮ হাজার ৪৩০ জন। এতে রাজস্ব আয় হয় ছয় কোটি সাত লাখ ৬৮ হাজার ৭৫৫ টাকা। অন্যদিকে, দেশি দর্শনার্থী ২০১৭ সালে ছিল ৪২ লাখ ৩০ হাজার ৬৫৮। ২০১৮ সালে তা বেড়ে হয় ৪৩ লাখ ৪৭ হাজার ৯৪০ জন। একইভাবে ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রত্ননিদর্শন ভ্রমণকারী দেশি পর্যটক ছিল যথাক্রমে ২৫ লাখ ৮৯ হাজার ৪৩২, ২৫ লাখ ৬৯ হাজার ২০৭ ও ৩৪ লাখ ৬৮ হাজার ৭১৭।

প্রত্নস্থানে পর্যটক বাড়া প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মিজানুর রহমান জামি সমকালকে বলেন, “দেশের মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতনতা ও আগ্রহ বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে সরকারের কিছু উদ্যোগের ভূমিকা আছে। বিশেষভাবে ‘দক্ষিণ এশিয়া পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প’-এর অধীনে দর্শনার্থীদের জন্য গাড়ি পার্কিং, খাবারের ব্যবস্থা, বসার জায়গা, টয়লেট স্থাপনসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়েছে। এতে তারা প্রত্নস্থানগুলোর প্রতি আগ্রহী হয়েছেন। বৈজ্ঞানিকভাবে গবেষণা, খননকাজ ও ব্যবস্থাপনা জোরদার করলে এ খাতে রাজস্ব আয় আরও বাড়বে।”

প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হান্নান মিয়া বলেন, ‘পর্যটকসংখ্যা যতই বাড়ূক, এতে সন্তুষ্ট হতে চাই না। আরও কীভাবে বাড়ানো যায়, সেদিকে দৃষ্টি দিচ্ছি। সঠিক বিদেশি পর্যটকের হিসাব একমাত্র ইমিগ্রেশন বিভাগের পক্ষেই করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।

কাটেনি ভ্রমণ সতর্কতা :হলি আর্টিসানের জঙ্গি হামলার পর থেকে বাংলাদেশের ওপর থেকে ভ্রমণ সতর্কতা বাতিল করেনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইতালিসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলো। এর মধ্যে কয়েকটি দেশ মাঝেমধ্যে সতর্কতা শিথিল করলেও পরে আবার তা অব্যাহত রাখে। বর্তমানে কানাডার নাগরিকদের জন্য বাংলাদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে ‘উচ্চমাত্রার সতর্কতা’ বজায় রাখা হয়েছে। ঢাকায় কানাডিয়ান হাইকমিশনের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘সন্ত্রাসবাদ, রাজনৈতিক বিক্ষোভ, হরতাল এবং সহিংস সংঘাতের হুমকি থাকায় বাংলাদেশ ভ্রমণে উচ্চমাত্রার সতর্কতা জারি হলো।’ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য ২ নম্বর সতর্ক সংকেত রয়েছে। যুক্তরাজ্যের নাগরিকদেরও জন্য রয়েছে সতর্কবার্তা।

পর্যটক পরিসংখ্যান নেই :পর্যটনকে শিল্প হিসেবে ঘোষণার দুই যুগ পেরিয়েছে অনেক আগেই। অথচ দেশে প্রতিবছর কতজন বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটে, সে পরিসংখ্যান এখনও নেই। বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের (বিটিবি) কাছে এ-সংক্রান্ত কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) কাছ থেকে এ তথ্য পাওয়ার চেষ্টা হলেও তা না পাওয়ার কথা জানিয়েছে বিটিবি। এ প্রসঙ্গে বিটিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ড. ভূবন চন্দ্র বিশ্বাস সমকালকে বলেন, ‘পুলিশের বিশেষ শাখা থেকে বিদেশি পর্যটক আগমনের তথ্য পাওয়ার কথা। এ জন্য বিভিন্ন সময়ে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। কখনও কখনও সাড়া মিললেও বেশির ভাগ সময় তথ্য পাওয়া যায়নি। এ-সংক্রান্ত জটিলতা কাটাতে আমরা চেষ্টা করছি।’ তবে বিগত কয়েক বছরের তথ্য জানতে চাইলে ড. ভূবন তা দিতে পারেননি। ইমিগ্রেশন পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার কাছে বিদেশি নাগরিক আগমনের তথ্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ রকম কোনো তালিকা তৈরি করি না আমরা।’