এক পায়ে তামান্নার এগিয়ে যাওয়া

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

দুই হাত নেই। পাও নেই একটি।  বাকি একটি মাত্র পা-ই তার চলার সম্বল। দৈনন্দিন জীবনে নাওয়া-খাওয়ার প্রতিটি মুহূর্তই তার সংগ্রামের। এ অবস্থায় লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া তো বাড়তি বোঝাই বটে। কেউ মমতায়, কেউ বা করুণার চোখে তাকায়। কিন্তু এসবে ভ্রুক্ষেপ নেই মেয়েটির। তার দৃষ্টি অনেক দূরে, শিক্ষার সর্বোচ্চ শিখরে। এই অভিযানে এরইমধ্যে ৯টি সিঁড়ি উঠে এসেছে সাফল্যে সঙ্গে, পিইসি-জেএসসিতে জিপিএ ৫ পেয়ে। এক পায়ে ছবিও আঁকে সে। এর পেছনের গল্প মা-বাবার মরিয়া চেষ্টা, আর নিজের অদম্য ইচ্ছা।

মা-বাবার অতি আদরের এই মেয়ের নাম তামান্না নুরা। এক পা নিয়েই সুস্থ সবল অন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে চলছে সে। সুস্থ অনেক শিক্ষার্থীর চেয়ে লেখাপড়ায় ভালোও করছে। এই  পা দিয়ে লিখেই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জেএসসি পরীক্ষায় জিপিএ ৫ পেয়ে সে তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছে।

যশোরের বাঁকড়া জোনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছে তামান্না নুরা। সে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী। নবম শ্রেণির পরীক্ষা তার ভালো হয়েছে। আর কয়েক দিন পরই সে পা রাখবে শিক্ষাজীবনের দশম সিঁড়িতে। ছবি আঁকায় প্রাতিষ্ঠানিক কোনো শিক্ষা নেই। কিন্তু ওই এক পা দিয়ে খুব সুন্দর ছবিও আঁকতে পারে সে।

মেয়েটির লেখাপড়ার ইচ্ছা পূরণে সহযোগিতা করছে তার বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। ক্লাসে তামান্নার সুবিধার জন্য বসার ব্যবস্থা অন্য শিক্ষার্থীদের থেকে ভিন্ন। শ্রেণিকক্ষে তার জন্য ব্ল্যাকবোর্ডের পাশেই বসানো আছে একটি চৌকি। তাতে বসে সে পা দিয়েই লিখতে ও পড়তে পারে।

যশোরের ঝিকরগাছা উপজেলার বাঁকড়া গ্রামের রওশন আলী ও খাদিজা পারভীন শিল্পীর মেয়ে তামান্না। দুই বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে সে বড়। ছোট বোনটি রুশনি আক্তার পড়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে। ছোট ভাই মহিবুল্লাহ তাজের বয়স চার। তামান্নার প্রতিবন্ধী জীবনের বড় সৌভাগ্য তার সচেতন মা-বাবা। বাবা রওশন আলী বিএসসি পাস। মা খাদিজা এএসসি পাস। প্রতিবন্ধী মেয়ে জন্ম নেওয়ার খবর পেয়ে বিদেশের চাকরি ছেড়ে চলে আসেন বাবা রওশন, মেয়েকে যত্নের সঙ্গে বড় করে তোলার ইচ্ছায়।

রওশন আলী জানান, বিয়ের তিন মাস পর তিনি সৌদি আরব চলে যান। তখন তাঁদের অবস্থা ছিল মোটামুটি সচ্ছল। কিন্তু এমন সন্তান জন্মের খবরে রওশন দেশে ফেরত আসেন। এরপর আর বিদেশে যাননি। তিনি ও তাঁর স্ত্রী মিলে ঠিক করেন যেভাবেই হোক ভালোভাবে বড় করে তুলবেন এই বুকের ধনকে।

তামান্নার মা খাদিজা পারভীন জানান, প্রথমে তাকে এলাকার একটি স্কুল ভর্তি নিতে চায়নি। তাতে তারা থেমে যাননি। তামান্নার পায়ের আঙুলে পাটকাঠি ধরিয়ে কলম ধরায় অভ্যস্ত করেছেন। এরপর লেখার চর্চা করিয়েছেন। এলাকার অন্য স্কুলগুলো যখন তাকে ভর্তি করতে চায়নি, তখন এগিয়ে আসে স্থানীয় আজমাইন এডাস স্কুল কর্তৃপক্ষ। তারা সানন্দে মেয়েটিকে ভর্তি করে নেয়। এরপর থেকে হুইল চেয়ারে করে তামান্নাকে স্কুলে আনা-নেওয়া করেন তার বাবা। এ কাজে কখনো কখনো তামান্নার স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থী অথবা প্রতিবেশীরাও সহায়তা করেন। আজমাইন স্কুলের পর তামান্নার বর্তমান স্কুল জোনাব আলী খান মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও তামান্নাকে সব ধরনের সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন।

মা-বাবার চেষ্টা, ভালোবাসা, আর শিক্ষকদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণায় তামান্না এতদিন সাহসে ভর করে সামনে চলেছে। তবে এখন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে তামান্নার আগামী দিনের লেখাপড়া এগিয়ে নেওয়ার প্রশ্নে। তামান্না জানায়, তার খুব ইচ্ছা মেডিসিন বিষয়ে চিকিৎসক হওয়ার। কিন্তু সে জানে না শারীরিক অসুবিধার কারণে তা সম্ভব হবে কি না। তার ইচ্ছা, যদি শারীরিক কারণে মেডিক্যালে পড়া না যায়, তা হলেও উচ্চশিক্ষার জন্য ভালো পড়াশুনা করতে এসএসসির পর যেন সে শহরে যেতে পারে। ভালো কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে পারে। কিন্তু কিভাবে তা সম্ভব হবে—এই চিন্তায় মাঝেমধ্যেই হতাশ হয়ে পড়ে মেধাবী মেয়েটি।

তামান্নার বাবা রওশন জানালেন, সামান্য কিছু জমি থেকে আসা আয়েই চলে তাঁর সংসার। সম্প্রতি তিনি চাকরি নিয়েছেন একটি নন এমপিও মাদরাসায়। সেখান থেকে কোনো বেতন পান না। তাই ঠিকমতো সংসার চালানোই দায়। তাঁর সামর্থ্যের মধ্যে আগামীতে আর কতটুকুই করতে পারবেন তামান্নার জন্য—এই চিন্তায় দিশাহারা রওশনও। মেয়ের জন্য মুখ ফুটে সহায়তা চাইতেও পারেন না এই শিক্ষক। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হবে তাও জানেন না।

তামান্নার শ্রেণিশিক্ষক ও প্রতিবেশী রফিকুল আলম বাবলু জানালেন, তামান্না শারীরিক প্রতিবন্ধী হলেও খুবই মেধাবী ছাত্রী। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় ও জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় সে জিপিএ ৫ পেয়েছে। উপযুক্ত পরিচর্যা পেলে তামান্না বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হবে।

তামান্নার স্কুলের প্রধান শিক্ষক হেলাল উদ্দিন খান জানালেন, ভর্তির পর থেকে তামান্নার জন্য স্কুলের সেশন ফিসহ অন্যান্য সব ফি মওকুফ করা হয়েছে। শুধু প্রতিবন্ধী ভাতা ছাড়া সরকারি আর কোনো সহায়তা সে পায়নি। তাই তার আগামী দিনের পড়াশুনা এগিয়ে নিতে সরকারি-বেসরকারি সহায়তা কামনা করেন তিনি। কালের কণ্ঠ