ইলা মিত্র নারী আন্দোলনের পথপ্রদর্শক

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

ইলা সেন। ১৯২৫ সালের আজকের দিন অর্থাৎ ১৮ অক্টোবর ব্রিটিশ ভারতের পূর্ব বাংলার যশোর জেলার ঝিনাইদহ মহকুমায় উচ্চ মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর মা মনোরমা সেন এবং বাবা নগেন্দ্রনাথ সেন একজন অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন। তিন বোন আর তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। শৈশবকাল থেকেই তিনি নারী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। বাঙালি হিন্দু রক্ষণশীল পরিবারের মেয়ে কিংবা বউ হয়ে সে সময় পুরোদস্তুর একজন সমাজসেবী হওয়া খুবই কঠিন কাজ ছিল। কিন্তু তারপরও ইলা মিত্র হলেন সেই নারী, যিনি সব অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে এক ধাপও পিছপা হননি।

 

রমেন্দ্র মিত্র নামের এক জমিদারপুত্রকে বিয়ে করে ইলা সেন থেকে ইলা মিত্র নাম ধারণ করেন তিনি। তারপর তিনি ১৯৪৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে অনার্সসহ স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরপর ১৯৪৮ সালে তিনি একমাত্র পুত্রসন্তান মোহন মিত্রের মা হন। তিনি সর্বভারতীয় একজন সেরা অ্যাথলেট এবং বাস্কেটবল খেলোয়াড় ছিলেন। তিনি ১৯৪০ সালের ভারতের হয়ে জাপানে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া বিশ্ব অলিম্পিকে একজন তালিকাভুক্ত অ্যাথলেট ছিলেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে সে বছর জাপানে আর বিশ্ব অলিম্পিকের আসরটি বসেনি। অনেক ছোট বয়স থেকেই তিনি কমিউনিস্ট আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁর স্বামী রমেন্দ্র মিত্রও একজন ছাত্রনেতা ছিলেন এবং তিনি জমিদারপুত্র হওয়া সত্তেও বিয়ের পরেও স্ত্রী ইলা মিত্রকে মানবসেবায় অধিকার আদায়ের জন্য রাজনৈতিক আন্দোলনে শরিক হওয়ার সুযোগ করে দিতেন। অথচ রমেন্দ্র মিত্রের পরিবারও ছিল একটি রক্ষণশীল হিন্দু জমিদার পরিবার। সে সময় রমেন মিত্র নিজেও এসব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই) একজন নেতা ছিলেন তখনই। পরে তাঁর স্ত্রী ইলা মিত্রকেও সেই সিপিআইতে অন্তর্ভুক্ত করেন এবং দুজনে একসঙ্গে মানবিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে শরিক হতে থাকেন।

 

বিয়ের পরই ইলা মিত্র তাঁর স্বামীর বাড়ি তৎকালীন রাজশাহী জেলার দুর্গম অজপাড়াগাঁ রাজশাহী সদর থেকে ৩৫ মাইল দূরে নবাবগঞ্জের নাচোলে চলে যান। বর্তমানে সেটি বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তবর্তী জেলা চাঁপাইনবাবগঞ্জের একটি উপজেলা। সেখানে নারীদের জন্য কাজ করতে এবং তাদের সচেতন করতে তিনি কলকাতা থেকে স্নাতক পাস করেই নাচোলে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। সেখানে গিয়ে তিনি সাঁওতালদের নিয়ে কৃষক-শ্রমিক আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ইলা মিত্র যেসব অধিকার আদায়ের আন্দোলন করেছিলেন, তার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল কৃষক-শ্রমিক আন্দোলন। তার মধ্যে তেভাগা আন্দোলনই সবচেয়ে বেশি সাড়াজাগানো ছিল। তেভাগা আন্দোলনের মূল বিষয় ছিল- জোতদার এবং জমিদার কর্তৃক তাদের প্রজা কৃষক-শ্রমিক শোষণের হাত থেকে রক্ষা করা এবং তাদের ন্যায্য হিস্যা আদায় করার ব্যবস্থা করা। সেখানে জমিতে মোট উৎপাদিত ফসলের সমান তিন ভাগের দুই ভাগ সেই আবাদকারী কৃষককে দিতে হবে। আর জমির মালিক, জমিদার কিংবা জোতদার পাবে সেই ফসলের বাকি এক ভাগ।

 

অপরদিকে ধান ফসলের ক্ষেত্রে ধান থেকে চাল করার জন্য যে শ্রমিক লাগবে সেখানেও এ তেভাগা নীতির প্রতিফলন ঘটাতে হবে। সেখানে প্রতি বিশ আড়া চালের মধ্যে সাত আড়া পাবে শ্রমিক আর তের আড়া পাবে ধানের মালিক। ইতিহাসে এটিই ছিল তেভাগা পদ্ধতি। এ পদ্ধতি কার্যকর করার জন্য তখন মালদাহ, জলপাইগুড়ি, রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর পুরো জেলাসমূহে এবং পাবনা জেলার কিছু অংশে এ তেভাগা আন্দোলনের উত্তাপ ছড়িয়ে দিতে সমর্থ হন ইলা মিত্র। তখন সেসব অঞ্চলে তাঁর অগণিত অনুসারী সৃষ্টি হয়। নাচোলের রামচন্দ্রপুরেই ছিল তাঁর মূল ঘাঁটি। সেখানে জনমানুষের জন্য কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে সবাই ‘রানী মা’ বলে ডাকত। সেজন্য তাঁকে ‘নাচোলের রানী’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে।

 

আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন তাঁর এসব আন্দোলন দমন করার জন্য প্রায়ই নাচোল পুলিশ স্টেশন থেকে তা দমন করার চেষ্টা করা হতো। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি ঘটে এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। কঠোর আন্দোলন দমন করার জন্য নাচোল থানার ওসিসহ পাঁচ পুলিশ কনস্টেবল এলে তাঁদের ওপর আন্দোলনকারীদের হামলায় সেই পাঁচজন পুলিশ কর্মকর্তা সেদিন নিহত হয়েছিলেন। তারপর পুলিশ হন্যে হয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর অবর্ণনীয় শারীরিক ও যৌন নির্যাতন করতে থাকে। অতঃপর মূল নেত্রী হিসেবে ইলা মিত্রকে গ্রেপ্তার করে তাঁকে পুলিশ স্টেশনে তিন-চারদিন আটক রেখে উপর্যুপরি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। এতে তিনি মারাত্মকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লে কলকাতায় চিকিৎসার জন্য গমন করেন। দীর্ঘদিন রোগভোগের পর সুস্থ হয়ে তিনি আর নাচোলে না ফিরে পশ্চিমবঙ্গে থেকে যান। সেখানে তিনি আবার লেখাপড়া করে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের প্রায় ১৩ বছর পর ১৯৫৭ সালের কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। সেখানে তিনি পুরোপুরি কমরেড হিসেবে কমিউনিস্ট রাজনীতিতে যুক্ত হয়ে ১৯৬২ সাল থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সময়ে চারবার পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিধানসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।

 

সেখানে থেকেও তিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছিলেন। নারী আন্দোলনের পুরোধা এ নারীনেত্রী ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর ৭৬ বছর বয়সে কলকাতায় শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। তবে তিনি বিরাজ করছেন কৃষক-শ্রমিক সাধারণ মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায়।  আজ ১৮ অক্টোবর এই মহান নেত্রীর জন্মদিনে তাই তাঁর প্রতি সশ্রদ্ধ শুভেচ্ছা।

 

লেখক : ডেপুটি রেজিস্ট্রার, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র: এনটিভি