আমি ভেসে আসিনি, রাজপথ থেকেই বঙ্গভবনে গিয়েছি: রাষ্ট্রপতি

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক :

আমি বঙ্গবন্ধুর ছোঁয়া পেয়েছি। কারাগারে যেতে হয়েছে আমাকে। চরম অত্যাচারিত হয়েছি। রাতের আঁধারে তুলে নেওয়া হয়েছে আমাকে। হাতকড়া পরানো হয়েছে। ডাণ্ডাবেড়ি পরানো হয়েছে। রাজপথে সক্রিয় হয়ে আমি বঙ্গবন্ধুর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাকশালের পাবনার জয়েন্ট সেক্রেটারি হয়েছিলাম।মঙ্গলবার (১৬ মে) বিকেলে পাবনা সরকারি এডওয়ার্ড কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত নাগরিক কমিটির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন তিনি।

আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গত ১৪ বছরের নানা অগ্রগতি ও আগের অবস্থা মূল্যায়ন করার আহ্বান জানান রাষ্ট্রপতি।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা ক্ষমতায় এসেছে, তারা মুক্তিযুদ্ধের অসম্প্রদায়িক চেতনা ধ্বংস করেছিল। কিন্তু পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অসাম্প্রদায়িক চেতনা আবার ফিরে এসেছে।

তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নিয়ে সরকারকে রাজনৈতিকভাবে পরাস্ত করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। অনেক মন্ত্রী আমার কাছে এসে বিশ্বব্যাংকের দাবি মেনে নিতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি রাজি হইনি। এটা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল। স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল। কিন্তু আমি শক্ত হাতে মোকাবিলা করেছি।

এ সময় তিনি পাবনা থেকে সরাসরি ট্রেন চলাচলের ঘোষণা দেন‌। সঙ্গে সঙ্গে অনুষ্ঠানে উপস্থিত সবাই আনন্দ উল্লাসে মেতে ওঠেন। ধাপে ধাপে পাবনাবাসীর দাবি পূরণের আশ্বাস দেন রাষ্ট্রপতি।

মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, আমার আগমন ঘিরে পাবনায় এমন আয়োজন হবে তা কল্পনাও করিনি। পাবনাবাসীর এই উচ্ছ্বাসের ঋণ আমি কিভাবে শোধ করবো? আমি চির কৃতজ্ঞ। এ আয়োজন আমি জীবনেও ভুলবো না। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের স্মৃতিবিজড়িত এই ঐতিহাসিক মাঠে আয়োজিত নাগরিক সংবর্ধনা সভায় উপস্থিত হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি। আপনাদের এত ভালোভাসা ও সম্মান পেয়ে আমি আবেগাপ্লুত-আনন্দিত। ঢাকার বাইরে প্রথম সফরেই নিজ জন্মস্থান পাবনায় আসতে পেরে আমি অত্যন্ত আনন্দিত।

তিনি বলেন, স্বাধীনতা বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন। এ অর্জনের পেছনে রয়েছে অনেক সংগ্রামের ইতিহাস, যার নেতৃত্বে ছিলেন জাতির পিতা।

রাষ্ট্রপতি বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়েছিল বলেই আজ আমি রাষ্ট্রপতি হয়েছি।
বঙ্গবন্ধু একটি ক্ষুধা ও দারিদ্রমুক্ত সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশ গঠনের কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার বিপক্ষের একটি কুচক্রি মহল ষড়যন্ত্র করে বঙ্গবন্ধুসহ তার পরিবারকে নৃশংসভাবে হত্যা করে দেশের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল।

৭১’র স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, জাতির পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আমি এই পাবনা শহরে প্রতিরোধ মিছিলে নেতৃত্ব দিয়েছিলাম। ১৯৭৫ সালের ২০ আগস্ট আমাকে গ্রেফতার করে সেনা ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। সেনা ক্যাম্পে আমিসহ আরও অনেককে নিয়ে আসা হয়েছিল। সেখানে টানা তিন মাস চলে অসহ্য-অমানবিক নির্যাতন। তারপর তিন বছর কারাভোগের পর ১৯৭৮ সালে আমি কারাগার থেকে মুক্তি পাই। তারপর আমি বিচারক হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেই। এসময় আমি সাধ্যমত দেশের জন্য কাজ করেছি। আমি জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে চাকরি থেকে অবসর নিয়েছি। পরবর্তীকালে দুর্নীতি দমন কমিশনের কমিশনার হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছি। দুর্নীতি দমন কমিশনে দায়িত্ব পালনকালে বিশ্বব্যাংক কর্তৃক পদ্মা সেতু প্রকল্পে যে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছিল তা তদন্তের দায়িত্বভার আমাকে দেওয়া হয়েছিল। এটা ছিল এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। আমার দেওয়া প্রতিবেদনের ভিত্তিতে কানাডার আদালতে বিশ্বব্যাংকের সেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এই চাপ মোকাবিলায় আমার প্রতি পাবনাবাসীসহ দেশবাসীর দোয়া ছিল বলেই এই কঠিন কাজ আমি সফলভাবে শেষ করতে পেরেছি।

মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, দেশের রাষ্ট্রপতি হবো এটা কখনো ভাবিনি। কিন্তু ভাগ্য আজ আমাকে রাষ্ট্রপতির পদে বসিয়েছে। আপনাদের দোয়া আর ভালোবাসা ছিল বলেই আমি এ পর্যন্ত আসতে পেরেছি। আপনাদের ভালোবাসাকে সঙ্গী করেই রাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্ব পালন করে যেতে চাই। এজন্য আপনাদের দোয়া ও সহযোগিতা চাই।

পাবনা জেলা ও দেশের উন্নয়নে আপনারা নিজ নিজ অবস্থান থেকে কার্যকর অবদান রাখবেন এটাই আমি প্রত্যাশা করি। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে সামিল হয়েছে।  প্রধানমন্ত্রীর প্রজ্ঞা ও গতিশীল নেতৃত্বে বাংলাদেশের অর্থনীতি আজ স্থিতিশীল। মানুষের গড় আয়ু ও জীবযাত্রার মান বেড়েছে এবং বিভিন্ন উন্নয়নসূচকে বাংলাদেশ পার্শ্ববর্তী অনেক দেশ থেকে ভালো অবস্থায় অবস্থান করছে। উন্নয়নের এ ধারা অব্যাহত রাখতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে প্রত্যেককে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।

সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পাবনার সংসদ সদস্যরা রাষ্ট্রপতির কাছে স্থানীয় বিভিন্ন দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন। রাষ্ট্রপতি তাদের দাবিগুলো শোনেন এবং তা পূরণের আশ্বাস দেন। এসময় আগামী সেপ্টেম্বর মাসে পাবনা থেকে ঢাকা সরাসরি ট্রেন চালুর ঘোষণা দেন রাষ্ট্রপ্রধান।

এর আগে ৩টা ২৪ মিনিটে অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত হন রাষ্ট্রপতি। এসময় তাকে বরণ করে নেওয়া হয়। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতসহ ধর্মগ্রন্থ পাঠের মাধ্যমে মঙ্গলবার (১৬ মে) বিকেল ৩টা ২৭ মিনিটে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতির সহধর্মিনী রেবেকা সুলতানা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানে বীর মুক্তিযোদ্ধা বেবী ইসলামের সভাপতিত্বে বক্তব্য দেন- ডেপুটি স্পিকার ও পাবনা-১ আসনের সংসদ সদস্য শামসুল হক টুকু, পাবনা-৫ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্স, পাবনা-৪ আসনের সংসদ সদস্য নুরুজ্জামান বিশ্বাস, পাবনা-৩ আসনের সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন, পাবনা-২ আসনের সংসদ সদস্য আহমেদ ফিরোজ কবির, নারী সংরক্ষিত আসনে সংসদ সদস্য নাদিরা ইয়াসমিন জলি, পাবনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি রেজাউল রহিম লাল, নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক অঞ্জন চৌধুরী, সদস্য সচিব-১ অধ্যাপক শিবজিত নাগ, সদস্য সচিব-২ আব্দুল মতীন খান এবং পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. হাফিজা খাতুন।

এর আগে চারদিনের সফরের দ্বিতীয় দিন মঙ্গলবার সকাল ১১টার দিকে পাবনার বিসিক শিল্পনগরে স্কয়ার সায়েন্স অ্যান্ড লাইফ প্ল্যান্ট উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি। পরে দুপুর ১২টার দিকে পাবনা প্রেসক্লাবে স্থানীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন তিনি।

সোমবার (১৫ মে) দুপুর ১২টা ৮ মিনিটে ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারযোগে নিজ জেলা পাবনায় এসে পৌঁছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। এরপর পাবনা সার্কিট হাউজে উপস্থিত হয়ে গার্ড অব অনার গ্রহণ করেন। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর দুপুর দেড়টায় জেলা পরিষদ বঙ্গবন্ধু চত্বরের নাম ফলক উদ্বোধন ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান তিনি। দুপুর ২টার দিকে পাবনা সদরের আরিফপুর কবরস্থানে বাবা-মায়ের কবর জিয়ারত করেন রাষ্ট্রপতি। এরপর তিনি স্কয়ার বাগানবাড়িতে পারিবারিক সমাধিস্থলে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান এবং প্রার্থনায় অংশ নেন। এভাবে প্রথম দিনের কার্যক্রম শেষ করে সার্কিট হাউজে রাতযাপন করেন তিনি।

দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত ও শপথ নেওয়ার পর প্রথমবারের মতো সোমবার (১৫ মে) নিজের জেলা পাবনায় এসেছেন মো. সাহাবুদ্দিন।

এরপর বুধবার (১৭ মে) সকাল ১১টায় পাবনা ডায়াবেটিক সমিতির অফিস পরিদর্শন শেষে বিকেল ৪টায় জেলা ও দায়রা জজ আদালতের যাদুঘর, বঙ্গবন্ধু কর্নার এবং বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল উদ্বোধন শেষে আইনজীবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন তিনি। এছাড়া তিনি বিকেল ৫টায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সাহাবুদ্দিন চুপ্পু বিনোদন পার্ক পরিদর্শন করবেন।

বৃহস্পতিবার (১৮ মে) বেলা সাড়ে ১১টায় সার্কিট হাউজে গার্ড অব অনার গ্রহণ শেষে ১১.৪০ মিনিটে হেলিকপ্টারে করে ঢাকার উদ্দেশে পাবনা ছাড়বেন রাষ্ট্রপতি।