আমসহ নিত্যপন্য ই-কমার্স মার্কেটিংয়ে কমেছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ব

নিজস্ব প্রতিবেদক চাঁপাইনবাবগঞ্জ :
চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুমিস্ট আমসহ নিত্যপন্য এবার ই-কমার্স মার্কেটিং বেড়ে যাওয়ায় কমেছে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ত্ব। ই-কমার্স মার্কেটিং বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ও সরবরাহে জড়িতরা হচ্ছেন উপকৃত। ই-কমার্স প্লাটফর্ম,সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অংশিদারিত্ব ও সহায়তায় স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে ঘটেছে অনেক পরিবর্তন। নায্য ও নগদ মূল্যে সরাসরি উৎপাদকের কেন্দ্র থেকে পন্য বিক্রি করতে পারায় খুঁশি উৎপাদন ও সরবরাহে জড়িতরা।

এমনভাবে অগামীতেও ই-কমার্স প্লাটফর্ম,সরকারী ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা ও সহায়তা পেলে নগদ টাকায় নায্যমূল্যে পন্য বিক্রি করে জড়িতরা যেমন হবেন উপকৃত,তেমনি ভোক্তা পাবেন ভাল পন্য কম দামে,কমে আসবে মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ত্ব। পাশাপাশি স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং পিছিয়ে পড়া আচার ও আমস্বতত্ত্ব উৎপাদনে জড়িত নারীরা হবেন স্বাবলম্বী।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও শিবগঞ্জ উপজেলার আমচাষি প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম ও আহসান হাবিব । গত কয়েক বছর থেকেই তারা নিরাপদ ও স্বাস্থ্য সম্মত আম উৎপাদনে জড়িত। ২০১৯ সাল পর্যন্ত তাদের উৎপাদিত আম কানসাট ও গোমস্তাপুর স্টেশন আম বাজারসহ ভোলাহাট আম বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে ফড়িয়া ও আড়তদারদের কাছে আম বিক্রি করতেন। ফড়িয়া ও আড়তদাররাও আরেক ধরনের মধ্যস্বত্বভোগী।

মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কারনে ক্রেতা-বিক্রেতারা পড়েন বেকায়দায়,মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের কারণে আমসহ নানান কম দামের পন্য কয়েক হাত ঘুরে হয়ে যায় বেশী দাম। আম উৎপাদনকারী প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম ও আহসান হাবিব বাজারে ২০ মান আম নিয়ে আসলে কয়েক দফায় বাছাবাছির পর ১৫ মন আম ক্রয়যোগ্য হিসেবে বিক্রি করলে টাকা পেতে এবং অবশিস্ট ৫ মন আম বিক্রি করতে পড়েন নানা বিড়ম্বনা ও নাজেহালের স্বীকার হন। এমন অবস্থা শুধু শফিকুল ইসলাম ও হার“ন অর রশিদ এর নয়,হাজার হাজার আমচাষি ও বাগান মালিকের একই অবস্থা।

এ মৌসুমে করোনার কারণে অনলাইনে আমসহ অন্যান্য কৃষি পন্য ক্রয় বিক্রয়ে বেড়ে যায় চাহিদা। শফিকুল ইসলাম ও হারন অর রশিদসহ চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার অন্তত ৮০০ জন আম,মাছ,মালটা,পেয়ারা,আমস্বত্ব ও আঁচারসহ বিভিন্ন পন্য অনলাইনে বিক্রয়ে আগ্রহী ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান,অনলাইনে বিক্রয় উদ্যোক্তা ও নিজে ফেসবুকে প্রচারের মাধ্যমে বিক্রি করে পেয়েছেন নায্য ও নগদ মূল্য।

ই-কমার্স বা অনলাইন ভিত্তিক প্লাটফর্মের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমেও অনেকই ব্যাক্তিগতভাবে আম বিক্রি করায় বাজারে আম বিক্রিতে হয়রানীতে পড়তে হয়নি তাদের। ঢাকার অনলাইন ভিত্তিক বা ই-কমার্স মার্কেটিং প্রতিষ্ঠান এর মধ্যে পারমিদা এন্টারপ্রাইজ,শুদ্ধ ডট কম,খাঁটি সংগ্রহ ও রংপুরের ফাস্টকল সহ অন্তত ৭ টি প্রতিষ্ঠান সরাসরি বাগান মালিকদের সাথে যোগাযোগ করে বাগান থেকেই নিরাপদ ও স্বাস্থ্য সম্মত আম নায্য ও নগদ মূেেল্য কিনে ভোক্তার কাছে পৌছে দিয়েছেন।

নিরাপদ আম উৎপাদনে জড়িত কৃষদের মধ্যে অনেকেই জানান কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান,চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনেকেই ব্যাক্তিগত ও একটি অনলাইন ব্যবসায়ী নামে কথিত একটি গ্র্রংপ বাজার থেকে নিম্নমানের আম কিনে চাষিদের কাছ থেকে ক্রয় ও সেরা আম বলে ভোক্তার কাছে দেওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমের সুনাম নস্ট হবার পাশাপাশি ভোক্তা প্রতারিত হচ্ছেন।

আমচাষি ও প্রকৌশলী শফিকুল ইসলাম, আমচাষি আহসান হাবিব,হারন অর রশিদ,সোহেল রানা,সাকির হোসেন ,শহিদুল ইসলাম খোকন,কাইয়ুম আলী,মাসুদ রানা ও আতাউর রহমানসহ অনেকেই জানান, অনলাইন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে এবার আম বিক্রি করতে পারায় আম নস্ট হয়েছে কম এবং নায্যমূল্য ও নগদ টাকা পাওয়া গেছে।

তারা আরো জানান,শুদ্ধ ডট কম ,পারমিদা এন্টারপ্রাইজ ,ফাস্টকল ও খাঁটি সংগ্রহের মাধ্যমে আমরা এবার প্রায় ২০ লক্ষ টাকার ছয়শ মন ল্যাংড়া,বারী ফোর, ক্ষিরসাপাত,ফজলি,আম্রপালি,বৃন্দাবনী,ব্যানানা ও গৌড়মতি আম সরবরাহ করেছি ।

মালটা ও পেয়ারা চাষি মাসুদ রানা জানান, গত এক মাসে পারমিদা এন্টারপ্রাইজ নামে একটি অনলাইন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সরাসরি নিজের প্রজেক্ট থেকে প্রায় ২ লক্ষ টাকার মালটা ও পেয়ারা দিয়েছি,টাকাও পেয়েছি সাথে সাথেই। আগামীতে আরও এই কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সাথে সংযুক্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে এসব আম,আচার,আমস্বত্ব, মাছ ব্যবসায়ী ও সরবরাহকারীর।

আমের আচার ও আমস্বত্ব তৈরীতে জড়িত শিবগঞ্জ পৌরসভার ৭০ জন নারীদের নিয়ে তিনটি সমিতির সদস্যদের সাথে ই-কমার্স মার্কেটিং এ জড়িত পারমিদা এন্টারপ্রাইজ এর সাথে সুইজ্যারল্যান্ড ভিত্তিক বেসরকারাী সংস্থ্য সুইসকন্টাক্ট ও প্রবৃদ্ধি প্রকল্প লিঙ্ক করিয়ে দেয়ায় নারী সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়ে আচার ও আমস্বত্ব তৈরী ও সরবরাহ নিয়ে ভোক্তার কাছে পৌছে দিচ্ছে।

ঐসব নারী এর আগে আমস্বত্ব ও আচার তৈরী করলেও তারা মার্কেটিংয়ের সুযোগ পাননি। এতে করে এই ৭০ জন নারী আগের চেয়ে উন্নত মানের পন্য উৎপাদন ও নায্যমূল্যে সরবরাহের নিশ্চয়তা পেয়েছেন।
ই-কমার্স মার্কেটিং পারমিদা এন্টারপ্রাইজের ব্যবস্থপনা পরিচালক আবু দারদা জানান, আমরা সুইজ্যারল্যান্ড ভিত্তিক বেসরকারাী সংস্থা সুইসকন্টান্ট সুইসকন্টাক্টের মাধ্যমে সরাসরি চাষিদের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে নায্যমূল্য দিয়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুমিস্ট আম বাগান থেকে কিনে করোনা পরিস্থিতিতে ভোক্তার কাছে পৌছে দেই।

এরআগে কখনই চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমস্বত্ব ও আচার তৈরীতে জড়িত পিছিয়ে পড়া নারীদের উৎপাদিত পন্য বিক্রয় করতে পারতো না। আবু দারদা আরো জানান, আমরা ৭০ জন নারীকে প্রশিক্ষন দিয়ে তাদের উৎপাদিত আমস্বত্ব ও আচার নায্যমূল্যে কিনে ভোক্তার কাছে অনেক পরিমান সরবরাহ করেছি।
সত্তর জন নারীকে নিয়ে গড়া তিনটি সংগঠনের মধ্যে ’ টক জাল মিস্টি সমিতি র নেত্রী ও উদৌাক্তা রকসানা কাবেরী জানান,আমাদের সমিতির মাধ্যমে উৎপাদিত আমস্বত্ব ও আচার বিক্রি করেছি একটি ই-কমার্স মার্কেটিং প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে,যা আগে কল্পনার মধ্যেও ছিলনা। এতে করে আমাদের সমিতির নারী সদস্যরা বাড়তী আয় করে সংসারে স্ব”ছলতা এনেছেন।

মালটা ও পেয়ারা চাষি মাসুদ রানা জানান, আমাদের প্রজেক্টে উৎপাদিত প্রায় পঞ্চাশ মন মালটা ও পেয়ারা স্থানীয় বাজারে বিক্রি না করে ঢাকার একটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করেছি,আমার মত আরো কয়েকজন এভাবে বিক্রি করছেন। এতে করে বাজারে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যায় পড়তে হয়না,তেমনি বাগানে বসেই টাকা পেয়ে যাচ্ছি।

বোগলাউড়ি গ্রামের মাছ আহরণ ও সরবরাহকারী জিন্নুর রহমান জানান, আমিসহ আরো কয়েকজন একটি ই-কমার্স প্লাটফর্মের মাধ্যমে বেশকিছু পরিমান দেশী ছোট মাছ নদীর ঘাট থেকে নগদমূল্যে বিক্রয় করেছি,যা এর আগে এমনটি হয়নি,এভাবে বিক্রি করতে পেরে আমরা লাভবান হচ্ছি ।
শিবগঞ্জের আম বাগান মালিক ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রনালয়ের সাবেক সচিব জিল্লার রহমান জানান,শিবগঞ্জে আম সংশ্লিস্ট স্টেকহোল্ডার,আম চাষি ও

বাগান মালিকসহ ব্যবসায়ীদের স্বার্থে সরকারের পাশাপাশি সুইসকন্টাক্টসহ কয়েকটি বেসরকারী সংস্থা ও ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান এবার মনোযোগী ও সুনজর দেওয়ায় আমচাষিরা উপকৃত হচ্ছেন,আগামীতেও এমনভাবে সবাই এগিয়ে আসলে উৎপাদকরা ভোগান্তী থেকে রক্ষা পাবেন এবং উপকৃত হবেন বলে মনে করি, এতে করে স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটবে এবং অনেকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃস্টি হবে।

শুদ্ধ ডট কম,পারমিদা এন্টারপ্রাইজ খাঁটিসংগ্রহ ও ফাস্টকলসহ ই-কমার্স প্লাটফর্মগুলি ঢাকাসহ সারা দেশে ভোক্তার কাছে ভাল পন্য পৌছে দেয়ায় তাদের প্রতিষ্ঠানে অনেকের কর্মসংস্থান হয় বলে জানান প্রতিষ্ঠানের কর্তারা।

ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব ও আম চাষি আহসান হাবিব জানান,গত দুই বছর আগেও সরকারী ও বেসরকারী কোন সংস্থা আম চাষিদের জন্য জোরালোভাবে এগিয়ে আসেনি,গত দুই বছর যাবত স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে আম চাষিদের নিয়ে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বেসরকারী সংস্থা সুইসকন্টাক্ট,পৌরসভা ও প্রবৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় আম চাষি ও বাগান মালিকদেরসহ শ্রমিক ও কুলি এবং আমস্বত্ত্ব ও আচার তৈরীতে জড়িত নারীদের প্রশিক্ষন দেয়ার পাশাপাশি বেশ কিছু পরিকল্পনা গ্রহন ও সম্পাদন করে।

উৎপাদিত আমের নায্যমূল্য নিশ্চিতে চাষিদের স্বার্থে কয়েকটি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করে আম সরবরাহের ব্যবস্থা করায় অনেক আম চাষি নায্যমূল্যে সঠিক যায়গায় আম বিক্রি করতে পারছে।

এতে করে ম্যাংগো ফাউন্ডেশনের অনেক সদস্য সরাসরি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নগদে ও নায্যমূল্যে আম বিক্রি করতে পারায় সামনের দিনে আম উৎপাদনের জন্য মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে চাষিদের। আহসান হাবিব আরো জানান আমের বিকল্প পন্য তৈরীতে আরো জোরালো ভুমিকা থাকা দরকার সরকারী ও বেসরকারী সংস্থারগুলোর।

আহসান হাবিব আরো জানান, পৌরসভা ও প্রবৃদ্ধি প্রকল্পের আওতায় “করোনাকালীন দুর্যোগ প্রতিরোধে” চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার নিরাপদ, সুস্বাদু ও স্বাস্থ্য সম্মত আম ই-কমার্স এর মাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন এলাকার ভোক্তাদের নিকট পৌছে দিতে এ বছর ২৩ জুন থেকে এই কার্যক্রম চালু হয়।

সুইজারল্যান্ড সরকারের অর্থায়নে এবং চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ পৌরসভা ও সুইসকন্ট্যাক এর প্রবৃদ্ধি প্রকল্প যৌথ উদ্দ্যেগে ই-কমার্স সেবা চালু করে।
২০১৮ সাল থেকে প্রবৃদ্ধি প্রকল্প স্থানীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে নিরাপদ আমচাষ পদ্ধতি ও আম এর ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে আমচাষী, আম-ব্যবসায়ী, আম শ্রমিকদের সাথে বিভিন্ন ধরনের কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।

এছাড়াও শিবগঞ্জ পৌরসভা আম বাজারের অবকাঠামো উন্নয়নসহ করোনাকালীন দুর্যোগ প্রতিরোধে এই আম বাজারে বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা উপকরণ সরবরাহ করে নিরাপদ স্বাস্থ্য সম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করার কাজ করে।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাকিব আল রাব্বী জানান শিবগঞ্জে আমচাষিদের নিয়ে ম্যাংগো ফাউন্ডেশনসহ তিনটি সংগঠন ও কয়েকটি আড়তদার সমিতি কাজ করে বলে শুনেছি। নিরাপদ ও স্বাস্থ্য সম্মত আম উৎপাদন ও নায্যমুল্য প্রাপ্তিতে সব ধরনের সহায়তা করা হবে।

আমের বিকল্প পন্য উৎপাদন না হলে সব রকম আমের মূল্য পাওয়া কঠিন,তাই আমের জেলি,কাঁচা আমের জুস,আমস্বত্ত্ব , আচার ও আরো কয়েকটি পন্য উৎপাদনে কেউ এগিয়ে আসলে সহায়তার আশ্বাস দেন তিনি।