অবরুদ্ধ বিশ্বে মুসলমানের রমজান প্রস্তুতি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

রমজান মুসলিম জাতির জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ মাস। এই মাসে মহানবী (সা.)-এর ওপর কোরআন অবতীর্ণের সূচনা হয়েছিল। রমজানে মহান আল্লাহ তাঁর রহমতের দুয়ার খুলে দেন, বাড়িয়ে দেন প্রতিটি ভালো কাজের প্রতিদান। ফলে মুমিন রোজা পালনসহ অন্যান্য ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভে ব্রতী হয়। মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে ঈমানি উদ্দীপনা ও আনন্দের আবহ। ব্যক্তিগত ইবাদত-বন্দেগির পাশাপাশি সম্মিলিত অনেক ধর্মীয় আয়োজন থাকে রমজানজুড়ে। তারাবি, ইফতার, সাহরি, মসজিদে মসজিদে দ্বিনি আলোচনা ও শেষ দশকে ইতিকাফ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়া রমজানকে স্বাগত জানাতে, রমজানের সম্মান ও মর্যাদা প্রকাশেও নিজস্ব সংস্কৃতির আদলে ভিন্ন ভিন্ন সম্মিলিত আয়োজন দেখা যায় মুসলিম বিশ্বে।

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে পাল্টে গেছে সারা পৃথিবীর চিরায়ত রূপ। প্রায় পুরো পৃথিবী অবরুদ্ধ হয়ে আছে। মুসলিম বিশ্বের দৈনন্দিন জীবনেও এর প্রভাব দৃশ্যমান। উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে ভিন্ন রূপ নিয়েছে মুসলিম বিশ্বের রমজানের প্রস্তুতি।

 

নেই ৎসবের আমেজ

রমজানে মধ্যপ্রাচ্যের শহর, নগর ও জনপদগুলো উৎসবমুখর হয়ে ওঠে। মুসলিমরা আরব ও ইসলামী ঐতিহ্যের আলোকে রমজানকে বরণ করে নানা আনুষ্ঠানিকতায়। মধ্যপ্রাচ্যের বেশির ভাগ মুসলিম দেশে তোপধ্বনির মাধ্যমে রমজানের চাঁদকে স্বাগত জানানো হয়। ১৫ শাবানের পর থেকে আরবের মসজিদ, ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও শপিংমলে আলোকসজ্জা করা হয়। ঐতিহ্যবাহী খাবার সংগ্রহ করে মুসলিমরা। কিন্তু এবার চিরচেনা সেই উৎসবের পরিবেশ নেই আরবে। রাস্তায় রঙিন আলোয় লেখা হচ্ছে ‘স্বাগত বরকতময় রমজান’, মসজিদ ও রাস্তায় আলোকসজ্জা দেখা যাচ্ছে না।

যেহেতু শপিংমল ও বাজারগুলোর ওপর বিধি-নিষেধ রয়েছে, তাই ইফতার-সাহরির আয়োজনও হবে না আড়ম্বরপূর্ণ। বাড়ির ছাদে বা সামনের খোলা প্রাঙ্গণে প্রতিবেশী ও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একসঙ্গে ইফতার করা এবং তারাবির পর চা-আড্ডা আরবের একটি জনপ্রিয় রমজান-সংস্কৃতি। তবে এবার ইফতারের আয়োজন পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে হবে তাদের।

 

ঘরে ঘরে মসজিদ

দল বেঁধে তারাবির জামাতে অংশ নেওয়া মধ্যপ্রাচ্যের আরেকটি রমজান-সংস্কৃতি। আরবের কিশোর, যুবক ও বৃদ্ধরা সমবয়সীদের সঙ্গে দল বেঁধে তারাবির জামাতে অংশ নেন। কিন্তু এবার লকডাউন ও কারফিউ তারাবির নামাজে ব্যাপক অংশগ্রহণের সুযোগ থাকবে না। ফলে পরিবারের সঙ্গেই তারাবির নামাজ আদায়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। যেমন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন ছবিতে মধ্যপ্রাচ্য ও তুরস্কের বিভিন্ন বাড়ির ছাদে মানুষকে জামাতের সঙ্গে নামাজ আদায় করতে দেখা যাচ্ছে। ফলে প্রতিটি ঘর মসজিদ হয়ে উঠবে এবং কোরআনের তিলাওয়াতে মুখর হয়ে উঠবে প্রতিটি আবাস।

 

উল্টে গেছে ব্যবসার চাকা

মুসলিম বিশ্বের ব্যবসায়ীদের জন্য রমজানে বিশেষ প্রস্তুতি থাকে। তারা রোজার আগ থেকে ইফতার-সাহরিতে জনপ্রিয় খাবার, ধর্মীয় পোশাক ও ঈদ আয়োজনের বিষয়গুলো মাথায় নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করে। হোটেল ও রেস্টুরেন্টগুলো নতুন সময়সূচি ও খাবারের তালিকা হাজির করে। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে এবার রমজানকেন্দ্রিক ব্যাবসায়িক আয়োজন নিষ্প্রভ। অবরুদ্ধ পরিবেশ, আয়-উপার্জনের সীমাবদ্ধতা, বৈশ্বিক বাণিজ্য চেইন ভেঙে পড়া ও মনস্তাত্ত্বিক কারণে ব্যবসায়ীরা হতাশ। এ ছাড়া প্রশাসন কর্তৃক বেচা-বিক্রিতে বিধি-নিষেধ থাকায় ব্যবসায়ীদের রমজানকেন্দ্রিক তৎপরতা থেমে রয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এতে মুসলিম বিশ্বের ক্ষুদ্র, মাঝারি ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের ক্ষতির পরিমাণ বেশি হবে। বিশেষত খাবার ও পোশাকশিল্পের সঙ্গে জড়িতরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

রমজানে মুসলিম বিশ্বে আমদানি ও রপ্তানি থেকে যে আয় হতো, তাও এবার হবে না। কেননা স্থবির বিশ্ব পরিস্থিতিতে সীমিত আকারে জরুরি খাদ্য, ওষুধ ও চিকিৎসাসামগ্রী ছাড়া আর কোনো কিছুই লেনদেনের সুযোগ পাওয়া যাচ্ছে না।

 

করোনা আক্রান্তদের রোজা নিয়ে শঙ্কা

ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক অসুস্থ, মুসাফির, শিশু ও গর্ভবতী নারী ছাড়া সবার জন্য রোজা রাখা ফরজ। সর্দি, কাশি ও জ্বরের মতো অসুস্থতার কারণে রোজা ভাঙার অনুমতি নেই। তবে সর্দি, কাশি, গলা ব্যথা ও জ্বর করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ হওয়ায় এসব রোগে আক্রান্তদের রোজা পালন নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজনে বা জীবনের শঙ্কা এড়াতে হয়তো তাঁরা রোজা রাখতে পারবেন না।

তবে কর্মস্থলের ছুটি থাকায় শ্রমিক শ্রেণির মানুষ—যারা কঠোর পরিশ্রম করার কারণে রোজা রাখতে পারত না এবং কিশোর-কিশোরীদের যারা লেখাপড়ার কারণে রোজা রাখতে পারত না তারা এবার রোজা রাখতে পারবে। এতে রোজাদারের পরিমাণ বাড়বে।

 

অনিশ্চয়তায় দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো

‘মুসলিম চ্যারিটি ফোরাম’ (এমসিএফ)-এর মতে রমজানে মুসলিমরা কমপক্ষে ১৬০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দান করে। এর বেশির ভাগ যায় ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, উদ্বাস্তু ও দরিদ্র মুসলিম জনগণের কাছে। করোনাভাইরাসের কারণে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, স্থানীয় চাহিদা ও অর্থের প্রবাহ না থাকায় এবার দানের পরিমাণ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছে দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলো।

 

অমুসলিম দেশে অনলাইনে দ্বিন শিক্ষার আয়োজন

অমুসলিম দেশে বসবাসকারী মুসলিমদের জন্য রমজান দ্বিনি শিক্ষার মৌসুম। এই মাসে মুসলিম দেশগুলো থেকে বিপুলসংখ্যক দ্বিন প্রচারক আলেম অমুসলিম দেশগুলোতে যান। তাঁরা তারাবি, ইফতার, সাহরির মতো বিষয়গুলো পরিচালনার পাশাপাশি কোরআন ও ধর্মীয় বিধি-বিধান শেখান। কিন্তু এবার রমজানে জমায়েত নিষিদ্ধ হওয়ায় ইউরোপসহ বিভিন্ন অমুসলিম দেশে অনলাইনে দ্বিনি শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারগুলো এসব শিক্ষা কার্যক্রমের উদ্যোগ নিয়েছে।

 

অর্থপূর্ণ রমজানের প্রত্যাশা

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে রমজানের আনুষ্ঠানিকতায় ঘাটতি থাকলেও আধ্যাত্মিক বিবেচনায় এবারের রমজান অর্থপূর্ণ হবে বলে আশা করছেন মুসলিম ধর্মীয় নেতারা। কেননা করোনাভাইরাস মানুষকে যে অসহায়ত্ব ও অচলাবস্থার মধ্যে ফেলে দিয়েছে, তা মানুষকে আরো বেশি আল্লাহমুখী করবে এবং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভে তাদের উৎসাহিত করবে—এমনটিই প্রত্যাশা করছেন তাঁরা। আর মানুষের বিনীত প্রার্থনার মাধ্যমেই এই সংকটের অবসান হবে—ইনশাআল্লাহ।

 

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ