ঈদে ঘুরে আসুন নাটোরের দিঘাপতিয়া রাজবাড়ি

জুবায়ের হোসেন বাপ্পি:

দিঘাপতিয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা দয়ারাম রায়। নাটোর রাজ্যের দেওয়ান দয়ারাম রায় রাজা রামজীবনের কাছ থেকে উপহার হিসেবে ১৭০৬ সালে যে জমি পেয়েছিলেন তার ওপরে ১৭৩৪ সালে স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন এই দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেন।

দিঘাপতিয়া রাজপ্রাসাদটি প্রাচীন স্থাপত্যকলার দৃষ্টিনন্দন এক নিদর্শন। প্রায় ৩০০ বছরের প্রাচীন ইতিহাস আর ঐতিহ্যের সৌন্দর্য মণ্ডিত এই রাজবাড়ী।

এই রাজবাড়ীতে এক সময়ে শোনা যেত নূপুরের ঝংকার আর সেই সঙ্গে মধুর কণ্ঠের সুর মূর্ছনা। ছিল পাইক-পিয়াদার কর্মচাঞ্চল্য, রাজ রাজন্যবর্গের গুরুগম্ভীর অবস্থান। ছিল বিত্ত বৈভবের ঝলক। এখন আর সে সব নেই। শুধুই কালের সাক্ষী হয়ে সেই দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীটি উত্তরা গণভবন নাম নিয়ে আজও স্মৃতি বহন করে চলেছে।

দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীর সামনে গেলে সবাইকে থমকে যেতে হয় দৃষ্টিনন্দন সুদৃশ্য বিশাল এক সিংহ দুয়ার বা ফটক দেখে। সেই ফটকের ওপরে রয়েছে এক প্রকাণ্ড ঘড়ি যা দুই দিক থেকেই দৃশ্যমান। সাত দিনে একবার চাবি দিলেও ওই ঘড়িটি আজও সঠিকভাবে সময় নির্ণয় করে চলেছে।

রাজবাড়ীতে প্রবেশের এটাই একমাত্র পথ। এ ছাড়া চারদিকে সুউচ্চ প্রাচীর এবং তারপর পরিখা। সারাটা রাজবাড়ী জুড়ে রয়েছে দেশি বিদেশি নানান বিরল প্রজাতির বৃক্ষরাজি।

দিঘাপতিয়া রাজ্যের রাজা প্রমদা নাথ রায় চারদিকে সীমানা প্রাচীর দিয়ে পরিবেষ্টিত রাজপ্রাসাদের ভেতরে বিশেষ কারুকার্য খচিত মূল ভবনসহ ছোট-বড় মোট ১২টি ভবন নির্মাণ করেন।

এ গুলো হচ্ছে প্রধান প্রাসাদ ভবন, কুমার প্যালেস, প্রধান কাচারি ভবন, ৩টি কর্তারানী বাড়ি, প্রধান ফটক রান্নাঘর, মটরগ্যারেজ, ড্রাইভার কোয়ার্টার, স্টাফ কোয়ার্টার, ট্রেজারি বিল্ডিং ও সেন্ট্রি বক্স। মূল ভবনসহ অন্যান্য ভবনের দরজা-জানালা সব মূল্যবান কাঠে নির্মিত।

প্যালেসের দক্ষিণে রয়েছে পাথর এবং মার্বেল পাথরে কারুকাজ করা ফুলের বাগান। বাগানটি ইতালি গার্ডেন নামে পরিচিত। এই বাগানে রয়েছে দেশি-বিদেশি নানা জাতের দুর্লভ সব ফুলের গাছ। বাগানে ইতালি থেকে আনা শ্বেত পাথরের ৪টি নারী ভাস্কর্য এখনো পর্যটকদের হৃদয় ছুঁয়ে যায়।

আকর্ষণীয় টাইপের ফোয়ারা এবং মাঝে মাঝে কারুকাজ করা লোহা ও কাঠ নির্মিত বেঞ্চ ও ডিম্বাকার সাইজের একটি মার্বেল পাথরের নির্মিত প্লাটফরম।

সমগ্র বাগানে বিরল প্রজাতির ফুল আর নামিদামি গাছের সমাহার। দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীর মূল প্রাসাদটি একতলা। এতে রয়েছে প্রশস্ত একটি হলঘর। বেশ উঁচু হলঘরের শীর্ষে রয়েছে একটি প্রকাণ্ড গম্বুজ। এ গম্বুজের নিচ দিয়ে হলঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস প্রবেশ করার ব্যবস্থা রয়েছে।

এ ছাড়াও হলরুমে কারুকার্য খচিত একটি বড় সোফা রয়েছে যাতে একসঙ্গে চারজন চারমুখী হয়ে বসা যায়। এই সোফায় বসলে দেয়ালে আটকানো বড় আয়নায় প্রত্যেকে প্রত্যেককে দেখতে পেতেন। উত্তরা গণভবনে উচ্চপর্যায়ের কোনো সভা হলে এ রুমেই হয়। উপরে রয়েছে ঝাড়বাতি। দিঘাপতিয়া রাজবাড়ীটি এক সময় বিস্তীর্ণ এলাকার ক্ষমতার কেন্দবিন্দু ছিল।

রাজা দয়ারাম রায় নাটোরের মূল শহর থেকে প্রায় দুই মাইল উত্তরে নাটোর-বগুড়া মহাসড়কের পাশে দিঘাপতিয়া ইউনিয়নে এই রাজপ্রাসাদটি নির্মাণ করেন। পরে রাজা প্রমদা নাথ রায় ১৮৯৭ সাল থেকে ১৯০৮ সাল পর্যন্ত ১১ বছর ধরে বিদেশি বিশেষজ্ঞ, প্রকৌশলী ও চিত্রকর্ম শিল্পী আর দেশি মিস্ত্রিদের সহায়তায় সাড়ে ৪১ একর জমির ওপর এই রাজবাড়ীটি পুনর্নির্মাণ করেন। প্রাচীরে বাহিরের ফটকের সামনে রয়েছে আরও ২.৮৯ একর জমি।

স/অ