৫৭’র বদলে আসছে ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের ১৯ ধারা!

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

তীব্র সমালোচনা ও বিতর্কের পর ২০০৬ সালের তথ্য প্রযুক্তি আইনের (আইসিটি অ্যাক্ট) ৫৭ ধারার পরিবর্তে নতুন করে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট) প্রণয়নের কথা জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি জানান, পুরনো ৫৭ ধারাকে কেন্দ্র করে যেসব প্রশ্ন রয়েছে, ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের ১৯ ধারায় তার জবাব পাওয়া যাবে। এই আইনে মত-প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি থাকবে। তবে মন্ত্রীর সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন আইনজীবীরা।

 

তারা বলছেন, একই আইনের আদলে গত বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া তারা দেখেছেন। তাদের আশঙ্কা আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হলেও যে মত-প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে নতুন আইনে বড় রকমের কোনও পরিবর্তন হবে,  তেমনটা আশা করা যায় না। এই শঙ্কা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বুধবার বলেন, ‘ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট এখনও প্রণীত হয়নি। নতুন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের খসড়া আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং পর্যায়ে আছে। শিগগিরই এর অস্পষ্টতা দূর করতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীসহ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক হবে। এরপরই তৈরি হবে আইনটির চূড়ান্ত খসড়া।’

 

গত চার বছর ধরে খসড়ার কাজ চলা এই আইনের ১৯ ধারায় বলা আছে, ‘কোনও ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে (১৮৬০ সালের ৪৫ নম্বর আইন)-এর ৪৯৯ ধারা মতে কোনও ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মানহানি ঘটলে তাহা হইবে একটি অপরাধ। কোনও ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইট বা অন্য কোন ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে এমন কোনও কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা বা অশ্লীল এবং যাহা মানুষের মনকে বিকৃত ও দূষিত করে, মর্যাদাহানি ঘটায় বা সামাজিকভাবে হেয়-প্রতিপন্ন করে, তাহা হইলে ইহা হইবে একটি অপরাধ।’

 

এদিকে, প্রস্তাবিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের খসড়ায় ধর্মীয় অনুভূতির ক্ষেত্রে ১৯-এর ৩-এর ধারায় লেখা আছে, ‘কোনও ব্যক্তি স্বেচ্ছাকৃতভাবে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার উদ্দেশ্যে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা  সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পাঠ করে বা দেখে বা শুনে তার ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত পান, তা হলে এটি হবে একটি অপরাধ।’ তবে এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ‘ওয়েবসাইট বা অন্য কোনও ইলেক্ট্রনিক মাধ্যমে প্রকৃত ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত বা ব্যবহৃত কোনও পুস্তক, লেখা, অঙ্কন বা চিত্র অথবা যেকোনও উপসানালয়ের ওপর বা অভ্যন্তরে বা প্রতিমা পরিবর্তনের জন্য ব্যবহৃত যেকোনও ধরনের খোদাই,  চিত্র বা প্রকারান্তরে প্রতিচিত্র অথবা কোনও ধর্মীয় উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত কল্পমূর্তির ক্ষেত্রে উপধারা ৩ প্রযোজ্য হবে না।’

 

পুরনো ৫৭ ধারার অপরাধ প্রমাণিত হলে ১৪ বছর কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে। এদিকে ১৯ ধারায় শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে ২ বছর। এছাড়া পুরনো ৫৭ ধারার মতোই নতুন ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টেও পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, মালামাল জব্দ ও গ্রেফতারের বিধান রাখা হয়েছে।

 

এদিকে, বিতর্কের মুখে পড়া তথ্যপযুক্তি আইন এর ৫৭ ধারায় ইলেকট্রনিক ফর্মে মিথ্যা, অশ্লীল অথবা মানহানিকর তথ্য প্রকাশ সংক্রান্ত অপরাধ ও এর দণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘কোনও ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনও ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার মাধ্যমে মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে বা  হানতে পারে  বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনও ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি দেওয়া হয়, তা হলে তার এই কাজ হবে একটি অপরাধ।’

 

এ বিষয়ে ব্লগার নুরুন্নবী দুলাল বলেন, ‘১৯ ধারা আর ৫৭ ধারার মধ্যে মূলত কোনও পার্থক্য নেই। দু’টি ধারা বাক-স্বাধীনতার পরিপন্থী। যাচ্ছেতাইভাবে ৫৭ ধারার প্রয়োগ ঘটিয়ে সরকার দেশ ও বিদেশে কঠোর সমালোচনা ও চাপের মুখে পড়েছে। তাই আইওয়াশের উদ্দেশ্যে ৫৭ ধারার জায়গায় নতুন মোড়কে ১৯ ধারা আমদানি করছে। দু’টি ধারাকে বলা যায়, একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।’

 

২০১৫ সনে এই ৫৭ ধারা বাতিল চেয়ে করা মামলায় এই আইনের অভিযোগ আমলে নেওয়ার প্রক্রিয়াগত ত্রুটি, অভিযোগের তদন্ত, অসম শাস্তির বিধান, ভিন্ন মাধ্যমে মত-প্রকাশের কারণে কঠোর শাস্তির বিধান, সংবিধানের আইনের সমতার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ার মতো বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছিল বলে জানালেন ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

 

তিনি বলেন, ‘আইনটি বাতিলের ক্ষেত্রে নতুন কোনও আইন যেন একই ধরনের পীড়নমূলক পদ্ধতি নিয়ে হাজির না হয়, তা বিবেচনায় নিতে হবে। আইসিটি অ্যাক্টের ৫৭ ধারা বাতিল করা হবে বলে দীর্ঘদিন থেকে শুনে আসছি। অথচ সেই একই আইনের আদলে গত বছর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খসড়া আমরা দেখেছি। ফলে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারা বাতিল হলেও যে মত-প্রকাশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে বড় রকমের পরিবর্তন আসবে, তেমনটা আশা করা যায় না।’

 

নতুন আইনের অপ-প্রয়োগের আশঙ্কা প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘সরকার কারও বাকস্বাধীনতা হরণে বিশ্বাস করে না। নতুন আইনে যদি তেমন কিছু থাকে, তাহলে সেগুলো যাচাই বাছাই করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘যারা বলছেন, ৫৭ ধারা ও ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট-এর ১৯ ধারা একই, তাদের বলি, এটি এখনও আইন হয়নি। তেমন কিছু থাকলে বিবেচনা করা হবে। আইনের অপব্যবহার যেন না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। আমরা সেই নজরটা দেব।’

 

আইনমন্ত্রী বলেন, ‘সাইবার সিকিউরিটির বিষয়টি এখন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য আইন দরকার। তবে তার যেন অপব্যবহার না হয়, সেদিকে সতর্ক থাকতে হবে। তাই বলে কেউ এ ধরনের অপরাধ করলে শাস্তি পাবে না, তা তো হতে পারে না।’

সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন