২৪ বছর ধরে রোজদারদের বিনামূল্যে মেসওয়াক বিলি করছেন মাহাতাব

বাগাতিপাড়া প্রতিনিধি:
পেশায় ওয়াচম্যান। দৈনিক মুজুরীতে চাকরী করেন। নিজের সংসার চালাতে যিনি হিমশিম খান। তিনিই আবার ছুটি নিয়ে রমজান মাসে মানব সেবার এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। রোজদারদের খেদমতে বিনামুল্যে বিলি করছেন মেসওয়াক। আর এ কাজটি করছেন ২৪ বছর ধরে। নিজের এলাকা ছাড়িয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ঘুরে বিলি করেন মেসওয়াক। সেই মানুষটির নাম মাহাতাব উদ্দিন। বয়স ৫৩। নাটোরের বাগাতিপাড়া উপজেলার চকমহাপুর গ্রামের বাসিন্দা। নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের কৃষ্ণা খামারে চাকুরী করেন।

বৃহস্পতিবার বাগাতিপাড়ার তমালতলা বাজারে মেসওয়াক বিতরনের সময় দেখা হয় তাঁর সাথে।

‘বাংলার মাটিতে এক কাঠা জমি থাকলে সরকারকে কর দিতে হবে। কিন্তু আমাকে কোনো পয়সা দিতে হবে না। আমার মেসওয়াক ফ্রি। সবাই ব্যবহার করতে পারেন।’

এমন সুরে রোজাদারদের মাঝে বিলি করছিলেন মেসওয়াক। সেসময় কথা হয় তাঁর সাথে। একটি ছোট শিশুও কোন কাজের হুকুম করলে কাজটা করে আনন্দ পেতেন মাহাতাব। এই স্বভাবের কারনে সবাই তাঁকে কাজের হুকুম করতেন। সেই ছোটবেলা থেকে রমজান মাসে বাড়ির পাশের বাজারে গিয়ে বসে থাকতেন। বিকেল হলেই সবাই তাঁকে মেসওয়াক (দাঁতন) নিয়ে আসতে হুকুম করতেন। সেই থেকে মানব সেবার অদ্ভুত এক নেশায় পেয়ে বসে তাঁকে।

তিনি মনে করেন, কেউ হুকুম করার আগেই যদি তার মেসওয়াকটা হাতের কাছে এনে দেওয়া যেত, তাহলে লোকটি বোধ হয় আরো খুশি হবেন। সেই ভাবনা থেকেই শুরু। এরপর ২৪ বছর ধরে রমজান মাসে মেসওয়াকের ব্যাগ নিয়ে ঘুরে বেড়ান নাটোর-রাজশাহী, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন হাটে-বাজারে, মসজিদের সামনে। আর বিতরন করেন বিনামূল্যে এসব মেসওয়াক। এতেই তাঁর আনন্দ। অত্যন্ত বিনয়ী এই মানুষটি এর জন্য ব্যবহার করেন একটি ভাংগা বাইসাইকেল। বাড়ি থেকে একটু দুরে তিনি সাইকেলে একটি ব্যাগ ভর্তি মেসওয়াক নিয়ে পৌছে যান আগে থেকেই স্থির করা বাজারে। তারপর সাইকেলটি কোথাও রেখে তার বোল দেন আর বিতরন করেন মেসওয়াক।
তিনি সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, সেহরী খাওয়ার পর নেমে পড়েন মেসওয়াক তৈরীর কাজে। সারা সকাল মেসওয়াক বানিয়ে দুপুরের পরই বেরিয়ে পড়েন বিতরন করতে। এ কাজে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানেরা তাঁকে সহযোগিতা করেন। মুলত তিনি নিম গাছের ডাল দিয়ে মেসওয়াক বানান। একাজের জন্য নিম গাছের মালিকরা তাকে দাওয়াত করে ডেকে নিয়ে যান । তাছাড়া বিশিষ্ট ব্যক্তিদের জন্য ঔষধি গাছ আপাংয়ের ডালের বিশেষ মেসওয়াক তৈরী করেন তিনি।

 
বর্তমানে প্রতিদিন তিনি ৫০০-৬০০ মেসওয়াক বিলি করেন। এদিকে শুধু রমজান মাসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি তার এ কাজ। বিশ্ব ইজতেমার মাঠে বস্তায় ৫০ হাজার মেসওয়াক নিয়ে যান তিনি এবং তা দেশি-বিদেশী মুসুল্লীদের মাঝে বিনামূল্যে বিতরন করেন। মাহাতাব বলেন, এসব মেসওয়াক প্রতিটি দুই টাকায় বিক্রি করলে এক লাখ টাকায় বিক্রি করা যেত। কিন্তু কোনদিন তা করবো না। তিনি জানান, সংসার জীবনে তিনি তিন সন্তানের জনক। বছর ১২ পুর্বে একমাত্র মেয়ে মুক্তার বিয়ে দিয়েছেন। বড় ছেলে মধু একাদশ পাশ করে আনসার বাহিনীর প্রশিক্ষণ গ্রহন করছেন। আর ছোট স¤্রাট সপ্তম শ্রেণীতে পড়ে।
তিনি জানালেন, সারা বছর ছুটি না কাটিয়ে সেগুলো জমা করে রাখেন। রমজান মাস এলেই পুরো মাসের ছুটি নিয়ে নেমে পড়েন এ কাজে। শুরুর দিকে কর্তৃপক্ষ ছুটি দিতে না চাইলেও তার এ কাজের নেশায় এখন আর বাধেন না।
তমালতলা বাজারে সাবেক শিক্ষক নেতা বছির উদ্দিন জানান, ৬২ বছর বয়সে এমন বিচিত্র মানুষকে দেখিনি। বেশ কয়েক বছর ধরে তাকে এই বাজারে বিনামূল্যে মেসওয়াক বিলি করতে দেখছেন। কোন দিন তাকে কারো কাছ থেকে এক টাকাও নেন নি তিনি।

স/শ