১৯ বছরে লালপুরে খুন দেড় শতাধিক

আলাউদ্দিন, লালপুর প্রতিনিধি:
নাটোর জেলার লালপুর উপজেলা। লালপুরে যত খুন, বিশেষ করে রাজনৈতিক ও আধিপত্যের ঘটনার পেছনে রয়েছে আর্থিক বিষয়। অর্থনৈতিক স্বার্থের উৎসের মূল ক্ষেত্র সুগার মিল। যেখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বিরাজমান কোটি টাকার বৈধ ও অবৈধ বাণিজ্য আর লুটপাট। আর এই অর্থের উৎস ও রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব আর খুনের মিছিল ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে। বিশেষ করে পৌর এলাকায় চরম খুন আতংক বিরাজ করছে জনমনে। এই খুনের মিছিল বন্ধ হওয়া এখন সময়ের দাবি।

লালপুর থানা, সংবাদপত্র ও স্থানীয় সূত্রমতে, ২০০০ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১৯ বছরে লালপুরে দেড় শতাধিক খুনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ১৪টি রাজনৈতিক খুন সংঘটিত হয়েছে উপজেলার গোপালপুর পৌরসভা এলাকায়। ১৯৯১-৯২, ১৯৯৮ সালে বিশেষ খুনের ঘটনাসহ নাটোরের লালপুর উপজেলায় ২০০০ সালে ১০টি, ২০০১ সালে ৯টি, ২০০২ সালে ৮টি, ২০০৩ সালে ৮টি, ২০০৪ সালে ৬টি, ২০০৫ সালে ১৪টি, ২০০৬ সালে ১৬টি, ২০০৭ সালে ২টি, ২০০৮ সালে ১০, ২০০৯ সালে ৯টি, ২০১০ সালে ৪টি খুনের ঘটনা ঘটে।

একইভাবে প্রতিবছরই এ খুনের ঘটনা ঘটে। ২০১১ সালে ৭টি, ২০১২ সালে ৯টি, ২০১৩ সালে ১২টি, ২০১৪ সালে ৯টি, ২০১৫ সালে ২টি, ২০১৬ সালে ১টি, ২০১৭ সালে ২টি, ২০১৮ সালে ২টি, ২০১৯ সালে ২টি খুনের ঘটনা ঘটেছে।

চরাঞ্চলে লালচাঁদ ও পান্নাবাহিনীর তাণ্ডবে পাঁচ (২০০২-২০০৬) বছরে লালপুরের রমজান হাফেজ, মুকুল, ভাসান, শাহজাহান, বকুল আলী, আমির, কুদ্দুস, হাতু, মমতাজ উদ্দিন ও খান্নাস খুন হন।
এসব খুনের মধ্যে শুধুমাত্র মমতাজ উদ্দিন ও খান্নাস হত্যার বিচার হলেও বাঁকি খুনের মামলা অন্ধকারে রয়েছে। অনেক খুনের ঘটনার রহস্য উদঘাটন হয়নি। আবার অনেক খুনের মামলার আসামি জামিনে, কেউ পলাতক, কেউ ধরা ছোঁয়ার বাইরে রয়েছেন।

প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী দেখা যায়, ১৯৯১ সালের ২২ জুন ঈদের আগের রাতে গোপালপুর পৌরসভার মধুবাড়ি এলাকায় সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তোফা। খুনের স্থানটি তোফা কাটা মোড় হিসেবে পরিচিত। ১৯৯২ সালের ২২ জুন উত্তরবঙ্গ আখচাষী নেতা আব্দুস সালাম খুনের মাধ্যমে শুরু হয় দিবালোকে খুনের ইতিহাস। সকাল ১০টায় নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের ২ নম্বর গেটের সামনে ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা কমরেড আব্দুস সালামকে প্রকাশ্য দিবালোকে সন্ত্রাসীরা গুলি করে হত্যা করে।

১৯৯৮ সালের ২৪ মে উপজেলা যুবলীগের সদস্য মুনছুর আলীকে (২৮) কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। ২০০২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি উপজেলার হাবিবপুর গ্রামে ছাত্রলীগকর্মী মোয়াজ্জেম হোসেন খান্নাসকে গুলি করে ও কুপিয়ে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ২০০৩ সালের ২৫ মে সুগারসেসের টেন্ডার ভাগাভাগিকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, আহত ১০, গুলি, ককটেল ও ভাংচুর করা হয়।

নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা মমতাজ উদ্দিন দলীয় কাজ শেষে ২০০৩ সালের ৬ জুন রাত ১০টার দিকে গোপালপুর থেকে আব্দুলপুরের মিল্কিপাড়ার নিজ বাড়ি ফেরার পথে দাঁইরপাড়া রাস্তায় তাকে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।

২০০৫ সালের ১৪ জানুয়ারি গোপালপুর পৌর শ্বশানের নিকট যুবদল নেতা রজব আলী পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধে নিহত হন। ২০০৫ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১টার দিকে উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুর রশিদ (৩৭) দলীয় কোন্দলের জের ধরে আড়বাব গ্রামে যাওয়ার পথে বাউড়া বটতলার আদূরে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হন। ওই ঘটনায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে আহত মিন্টু ২০০৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি মারা যান।
চরাঞ্চলে লালচাঁদ ও পান্নাবাহিনীর তাণ্ডবে পাঁচ (২০০২-২০০৬) বছরে লালপুর, রাজশাহী, কুষ্টিয়া, পাবনায় ৩০ খুন, ৪০০ পরিবার গৃহহারা হয়। এরমধ্যে লালপুরের রমজান হাফেজ, মুকুল, ভাসান, শাহজাহান, বকুল আলী, আমির, কুদ্দুস ও হাতু খুন হন। ২০০৬ সালের ৫ জুন র‌্যাবের ক্রসফায়ারে রাজশাহীর বাঘার জোতরাঘোব এলাকায় পান্না বাহিনীর প্রধান কুষ্টিয়ার দৌলতপুর গ্রামের মাঝদিয়ার গ্রামের জসিম উদ্দিনের ছেলে আব্দুল মান্নান ওরফে রানা আহমেদ ওরফে পান্না নিহত হয়।
২০০৮ সালের ২৩ জুন নাটোরের লালপুর উপজেলার ভূইয়াপাড়া ব্রিজের নিকট বর্ণার বিলের আখক্ষেত থেকে রফিকুল ইসলাম (৩৫) নামের এক ব্যক্তিকে গলায় রশি পেঁচিয়ে হত্যা করা হয়। ২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর দুপুরে বিজয়পুর নামক স্থানে দুস্কৃতিকারীরা সাখাওয়াত হোসেন (৪০) নামে এক আওয়ামী লীগকর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করে।
২০১৫ সালের ১৮ আগস্ট দুপুরে উপজেলার নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের গ্যারেজের পেছনে মিলের আখ ক্ষেতে মীর হাসান মাহমুদ সৈকত (১৯) খুন হয়।
নাটোরের লালপুর পদ্মারচর থেকে জালাল উদ্দিন (২৫) নামের এক কলেজছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়। ২০১৬ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাতে বন্ধুদের হাতেই হত্যার শিকার হন জালাল উদ্দীন।
২০১৭ সালের ১২ জানুয়ারি দুপুর ১টার দিকে লালপুর-বাঘা সড়কের বাদলিবাড়ি (তিনখুঁটি) এলাকায় মোশাররফ হোসেন (৩৮) নামের এক কলেজশিক্ষককে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর সকাল সাড়ে ১০টার দিকে নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল এলাকায় আওয়ামী লীগের দু’পক্ষের বিরোধের জেরে জাহারুল ইসলাম (৩৮) নামে যুবলীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।
২০১৯ সালের ২০ জানুয়ারি বেলা ১টার দিকে গোপালপুর পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর পৌর আওয়ামী লীগের সদস্য জামিরুল ইসলাম (৪৩) দুর্বৃত্তদের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন হন।

২০১৯ সালের ১২ জুন উপজেলার গোপালপুর পৌর এলাকার মনির উদ্দিন আকন্দ রোডে বেলা আড়াইটার দিকে আলোক বাগচি (৫০) নামের একজনের বুকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। এনিয়ে গোপালপুর পৌরসভায় রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে ১৪টি। বিভিন্ন সময়ে খুন, সংঘর্ষ, লুটপাটের ঘটনায় লালপুরের মানুষ উদ্বিগ্ন।
লালপুরে অপ্রত্যাশিত হত্যাকাণ্ডের ঘটনার কারণ, হত্যাকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত বা দোষী এবং হত্যাকাণ্ড-সন্ত্রাসী ঘটনা থেকে উত্তরণের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ নাগরিক জীবন নিশ্চিত করতে দায়িত্বশীল ব্যক্তি, রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের মতামত নেওয়া হয়।

লালপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) নজরুল ইসলাম জুয়েল বলেন, লালপুর উপজেলা নাটোর, পাবনা, কুষ্টিয়া ও রাজশাহী জেলার সীমান্তবর্তী এলাকা। পদ্মা নদীর বিশাল চর ও সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় সন্ত্রাসীরা যে কোন অপরাধ করে সহজেই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ প্রশাসন তৎপর রয়েছে। ইতোমধ্যে পৌরসভা এলাকা সিসি ক্যামেরার আওতাভূক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য এ্যাড. আবুল কালাম আজাদ বলেন, লালপুর উপজেলার গোপালপুর পৌরসভা ও সুগার মিল আর্থিক সংস্থানের ক্ষেত্র। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব এবং আধিপত্য বিস্তারে হত্যাকান্ড লাগামছাড়া বেড়ে চলেছে। রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ব্যক্তি ও সামাজিকভাবে পদক্ষেপ নিলে লালপুরের অপরাধ প্রবণতা প্রতিহত করা সম্ভব।

নাটোর-১ (লালপুর-বাগাতিপাড়া) আসনের সংসদ সদস্য শহিদুল ইসলাম বকুল বলেন, লালপুরে খুনের রাজনীতি দীর্ঘদিন ধরে চলছে। রেজিস্ট্রি অফিস, গোডাউন ব্যবসা, সুগার মিল, পৌরসভা বিধায় এখানে যারা বিভিন্ন সময়ে নেতৃত্বে রয়েছে তারা মনে করেন যে, এই জায়গা আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলে আমাদের জন্য লাভজনক। সব সময় এখানে গ্রুপিং সৃস্টি করে খুন-খারাপি করা, মামলা-মোকাদ্দমায় ঝুলিয়ে দেওয়া রেওয়াজ হয়ে গেছে। সকলের এক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।

স/শা