হালদায় মা মাছের ‘অস্বাভাবিক’ প্রজনন

ছিল পূর্ণিমার তিথি। তবে নেই বজ্রসহ বৃষ্টি। তাইতো নেই তীব্র স্রোত। তার মধ্যে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এবং সামুদ্রিক অতিরিক্ত জোয়ারে লবণের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রাসনের প্রভাবে টানা বৃষ্টি, পাহাড়ি ঢল ও মেঘের গর্জন না থাকার কারণে সৃষ্টি হয়নি ডিম ছাড়ার অনুকূল পরিবেশ।

প্রকৃতির এমন হেঁয়ালিতে আশা-নিরাশার দোলাচলে দুই দফায় নমুনা ডিম দেয়ার পর দেশের অন্যতম জোয়ার-ভাটার মিঠাপানির প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন কেন্দ্র হালদা নদীতে পুরোদমে ডিম ছেড়েছে কার্প জাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল ও কালিবাউশ) মা মাছ।

বুধবার (২৬ মে) দিবাগত রাত সাড়ে ১২টা থেকে পূর্ণমাত্রায় হালদা নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় ডিম ছাড়ে মা মাছ। নদীতে নৌকা, জাল ও বালতিসহ নানা সরঞ্জাম নিয়ে অপেক্ষায় থাকা ডিম আহরণকারীরা সেই মাহেন্দ্রক্ষণে ডিম সংগ্রহের উৎসবের আমেজে মেতে উঠে।

রাত যত বাড়ে তত মানুষের হাঁকডাক বাড়তে থাকে নদীতে। পাশাপাশি ডিম সংগ্রকারীদের জালে বাড়তে থাকে ডিম পাওয়ার পরিমাণ। এভাবে ভোর পর্যন্ত ৩৪৩টি নৌকায় ৮০৬ জন ডিম সংগ্রহকারী মা মাছের ডিম আহরণ করেছেন।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, বুধবার মধ্যরাত থেকে ডিম আহরণের নানা সরঞ্জাম নিয়ে হালদা নদীর আজিমের ঘাট এলাকায় সর্বোচ্চ পরিমাণে ডিম সংগ্রহ করেছেন ডিম সংগ্রহকারীরা। এছাড়া হালদার হাটহাজারী ও রাউজান অংশের রামদাশ মুন্সীর হাট, নাপিতের ঘাট, আমতুয়া, মাছুয়াঘোনা, পোড়াকপালি, কাগতিয়া, সিপাহির ঘাট, গড়দুয়ারা নয়াহাট, কেরামতলীর বাঁক ও অঙ্কুরিঘোনা ইত্যাদি এলাকায় ডিম সংগ্রহ করেন।

এ সময় প্রতি নৌকায় ডিম সংগ্রহকারীরা কেউ ১ বালতি, আবার কেউ সর্বোচ্চ ২-৩ বালতি পর্যন্ত ডিম সংগ্রহ করেছেন। সংগৃহীত প্রতি বালতি ১০-১৬ লিটার ক্ষমতা সম্পন্ন। সেই হিসেবে সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ সাড়ে ৬ হাজার কেজি হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

বংশ পরম্পরায় দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে হালদা নদী থেকে ডিম আহরণ করে আসছেন হাটহাজারী উপজেলার গড়দুয়ারা কামাল সওদাগর (৬০)। তিনি বলেন, গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে এবং পরের দিন বুধবার দুপুরে মা মাছ নদীতে ডিমের নমুনা ছেড়েছে। এর মধ্যে বুধবার দিবাগত রাতে ভাটার সময় মা মাছ পুরোদমে ডিম ছেড়েছে। তবে এবার ডিম সংগ্রহের পরিমাণ একেবারেই কম। আমি ৬টি নৌকা দিয়ে ২-৩ কেজির মতো ডিম সংগ্রহ করতে পেরেছি।

এছাড়া উপজেলার মধ্যম মার্দাশা এলাকার ডিম আহরণকারী আশু বড়ুয়া জানান, আমার ৬টি নৌকা দিয়ে একেকজন ৩ কেজি করে ডিম সংগ্রহ করেছি।

এবার মা মাছের দেয়া সংগৃহীত ডিমের পরিমাণ আগের বছরের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশেরও কম। ফলে এ বছর আশানুরূপ ডিম আহরণ করতে না পারায় ডিম সংগ্রহকারীদের মাঝে হতাশার ছাপ পরিলক্ষিত হয়।

বিশেষজ্ঞরা আগের বছরের তুলনায় এক-তৃতীয়াংশেরও কম দেয়াকে হালদায় মা মাছের ‘অস্বাভাবিক’ প্রজনন বলছেন। এক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এবং সামুদ্রিক জোয়ারে লবণের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রাসনের প্রভাবকে তারা দায়ী করছেন।

যদিও হালদা নদীতে গত বছর ২৫ হাজার কেজি, ২০১৯ সালে ১০ হাজার কেজি, ২০১৮ সালে ২২ হাজার কেজি, ২০১৭ সালে ১৬ হাজার কেজি, ২০১৬ সালে ৭৩৫ কেজি, ২০১৫ সালে দুই দফায় ২ হাজার ৮০০ কেজি, ২০১৪ সালে ১৬ হাজার ৫০০ কেজি, ২০১৩ সালে৪ হাজার ২০০ কেজি, ২০১২ সালে ২১ হাজার ২৪০ কেজি, ২০১১ সালে ১২ হাজার ৬০০ কেজি, ২০১০ সালে ৯ হাজার কেজি ও ২০০৯ সালে ১৩ হাজার ২০০ কেজি ডিম ছাড়ে মা মাছ।

হালদা রিসার্চ ল্যাবরেটরির সমন্বয়ক ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক এবং হালদা গবেষক ড. মনজুরুল কিবরীয়া বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি পরীক্ষায় হালদার পানিতে ৩৬ পিপিটি লবণ পাওয়া গেছে। এটির সহনীয় মাত্রা হচ্ছে ১ পিপিটি। ঘূর্ণিঝড় ‘ইয়াস’ এবং পূর্ণিমার প্রভাবে সামুদ্রিক জোয়ারে লবণের মাত্রাতিরিক্ত আগ্রাসন বেড়েছে। তাই এবার মা-মাছ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ডিম ছাড়তে পারেনি। এ কারণে হালদা নদীতে মা মাছ স্বল্প পরিমাণে ডিম ছাড়ছে।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গত দুই দিন ধরে প্রচুর পরিমাণ লবণাক্ত পানি সাগর থেকে কর্ণফুলী হয়ে হালদায় ঢুকেছে। লবণাক্ত পানি সহ্য করতে না পেরে মা মাছ ডিম ছেড়ে দিয়েছে। এজন্য আমরা এই প্রজননকে স্বাভাবিক বলছি না। তারপরও আমরা আশা করি, এ সমস্যা কেটে যাবে। বজ্রসহ বৃষ্টি শুরু হলে এবং পাহাড়ি ঢল নামলে মা মাছ আবারও ডিম ছাড়বে বলে মনে করেন এই হালদা গবেষক।

চট্টগ্রাম জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ফারহানা লাভলী জানান, হাটহাজারী ও রাউজান অংশে সরকারি ছয়টি হ্যাচারিতে গোলাকার ও আয়তাকার মিলে মোট ১৫০টি এবং ১৬৫ সিমেন্ট ও ১৭৫টি মাটির কুয়ায় হালদা নদী থেকে আহরণ করা ডিম থেকে নিরাপদে রেণুতে পরিস্ফুটনের জন্য ব্যস্ত সময় পার করছেন ডিম সংগ্রহকারীরা।

এছাড়া সংগৃহীত মা মাছের ডিমের পরিমাণ কম হওয়ায় হালদা পাড়ে কৃত্রিম রেণু পোনা উৎপাদনকারী ও বিক্রেতারা বেশ তৎপরতা চালাচ্ছে। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি জানান, এসব অসাধু ব্যক্তির এ ধরনের কাজ করার কোনো সুযোগ নেই। কারণ উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য অধিদপ্তর ও নৌপুলিশ বেশ সক্রিয় অবস্থানে রয়েছে।

এবার প্রকৃতি অনুকূলে না থাকায় মা মাছ প্রজননের উপযুক্ত পরিবেশ পায়নি- এমনটা দাবি করে হাটহাজারী ইউএনও রুহুল আমীন বলেন, ডিম দেওয়ার পরে কার্প জাতীয় মা মাছ দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় শিকারিরা মা মাছ ধরতে ফাঁদ পাতে। তাই হালদাপাড়ে সার্বক্ষণিক দুইটি ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে গ্রামপুলিশের সমন্বয়ে গঠিত টহল দল পাহারা দিচ্ছে।