মা বাবার একমাত্র সন্তান ভালো ফল করায় খুশি পরিবার। দুশ্চিন্তা এখন সন্তানকে পছন্দের কলেজে ভর্তি করানো নিয়ে।
ভালো ফলাফল করেও কি মানসম্মত কলেজে ভর্তি হতে পারবে ছেলে? তা নিয়েই সারাক্ষণ উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা।বাবা প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমান, মা সরকারি স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা পান্না বেগম। তাদের সঙ্গে কথা হয়। তারা বলেন, ছেলে ভালো ফলাফল করেছে। এখন চিন্তা আরও বেশি। ছেলের ইচ্ছা- চট্টগ্রাম কলেজে পড়বে। ওখানে প্রতিযোগীতা বেশি। জিপিএ ৫ পেলেই হবে না, এরমধ্যে যারা বেশি ভালো করেছে তারাই সেখানে ভর্তির সুযোগ পাবে।
ছেলের কলেজ ভর্তি নিয়ে প্রকৌশলী মাহফুজুর রহমানের মতো উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় অসংখ্য অভিভাবক। একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির সব কার্যক্রম অনলাইনে। তবুও অনেকে পছন্দের কলেজে ছোটাছুটি করছেন। কত নম্বর থাকলে পছন্দের কলেজে ভর্তির সম্ভাবনা রয়েছে, তা জানতে সশরীরে কলেজে যাচ্ছেন শিক্ষার্থী-অভিভাবকরা।
শিক্ষকরা বলছেন, ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর চেয়ে কলেজে আসন সংখ্যা বেশি। তবে সব প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন নয়। হাতেগোনা কিছু কলেজ সবার পছন্দের শীর্ষে। সবাই পছন্দের কলেজে ভর্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে। এতে শেষ পর্যন্ত কলেজ পেতেও বেগ পেতে হয় তাদের। জিপিএ-৫ পেয়েও অনেকে কাঙ্ক্ষিত কলেজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়। পরে অনেকে অন্য কলেজ কিংবা পলিটেকনিকে ভর্তি হতে বাধ্য হয়।
ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীর চেয়ে আসন বেশি
চলতি বছরের এসএসসি ও সমমান পরীক্ষায় চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডে মোট পাস করেছে ১ লাখ ২০ হাজার ৮৬ জন শিক্ষার্থী। অথচ চট্টগ্রামের সরকারি-বেসরকারি কলেজে আসন রয়েছে ১ লাখ ৬৭ হাজার। সেই হিসাবে সব শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও ফাঁকা থাকবে ৪৬ হাজার ৯১৪টি আসন।
চট্টগ্রাম মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক জাহেদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের অধীনে ২৮৫টির মতো কলেজে একাদশ শ্রেণিতে শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ রয়েছে। মোট আসন সংখ্যা ১ লাখ ৬৭ হাজারেরও কিছু বেশি।
যে কারণে প্রত্যাশিত কলেজ পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা
গত তিন বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ঘোষিত তিন ধাপে ভর্তি শেষ করতে চাইলেও তা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক সময় জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীরাও তিন ধাপে ভর্তির আবেদন শেষে কোনো কলেজ বরাদ্দ পান না।
কারণ হিসেবে ভর্তি কার্যক্রমে যুক্ত শিক্ষাবোর্ড কর্মকর্তারা বলছেন, আবেদনের সময় শিক্ষার্থীরা ১০টি কলেজ পছন্দক্রম দেওয়ার সুযোগ পায়। তারা বারবার পছন্দের কলেজগুলো পছন্দের তালিকায় রাখে। ওই কলেজগুলোতে তাদের নম্বর অনুযায়ী আসন মেলে না। এতে একেবারে শেষ ধাপ পর্যন্ত কিছু শিক্ষার্থী ভালো ফল করেও কলেজ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেজাউল করিম বলেন, ‘আমরা সব শিক্ষার্থীকে ভর্তি করাতে চাই। শিক্ষার্থীরা পছন্দের কলেজ না পেয়ে বারবার একই কলেজ পছন্দের তালিকায় রাখে। এতে তারা নির্ধারিত তিন ধাপে কলেজ বঞ্চিত হয়। তবে অনেক সময় বিশেষ ধাপে আমরা তাদের ভর্তি করিয়ে নিই’।
এসএসসি পরীক্ষায় এবার জিপিএ-৫ পেয়েছে মোট ১০ হাজার ৮২৩ জন। অধিকাংশের লক্ষ্য দেশসেরা কলেজগুলোতে ভর্তি হওয়া। গ্রামের স্কুল থেকে এসএসসিতে অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়েও অনেকে বাড়তি প্রত্যাশা নিয়ে চট্টগ্রামে আসে। এতে চট্টগ্রামের খ্যাতনামা কলেজ হিসেবে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে একপ্রকার লড়াই চলে। শেষ পর্যন্ত জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থীও পছন্দের কলেজ না পেয়ে হতাশ হন।
গত বছর তিন ধাপে ভর্তির আবেদন করেও কলেজ জুটেনি অনেক শিক্ষার্থীর। তাদের মধ্যে জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীও ছিলেন। প্রথম ধাপে ৮ হাজার ৭০১ জন শিক্ষার্থী আবেদন করেও তালিকায় কলেজ পায়নি। অন্যদিকে, চট্টগ্রামে সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ পাওয়া ১১ হাজার ৬১২ জনের মধ্যে একাদশে ভর্তির জন্য আবেদন করে ১১ হাজার ৫৭৩ জন শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে প্রথম তালিকায় স্থান পেয়েছে ১১ হাজার ৭২ জন। জিপিএ-৫ পেয়েও প্রথম ধাপে কলেজ পায়নি ৫০১ জন।
চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের কলেজ পরিদর্শক অধ্যাপক জাহেদুল হক বলেন, একাদশে ভর্তির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ দশটি কলেজে আবেদনের সুযোগ রয়েছে। কিন্তু জিপিএ-৫ পাওয়া অনেক শিক্ষার্থী পছন্দের ক্ষেত্রে ৫-৬টির বেশি কলেজ দেয়নি। তাদের ধারণা ছিল ৫-৬টি কলেজে আবেদন করলে তাদের নাম চলে আসবে। কিন্তু যেসব কলেজে তারা আবেদন করেছে, সেসব কলেজে তাদের তুলনায় বেশি নম্বর পাওয়া আবেদনকারীর সংখ্যা হয়তো বেশি ছিল। সে কারণে যারা ৫-৬টি কলেজের বেশি পছন্দ দেয়নি, তাদের একটিতেও সুযোগ হয়নি। কিন্তু দশটি কলেজে আবেদন করলে এ সমস্যা হয়তো হতো না।
তিনি বলেন, একাদশে ভর্তির আবেদন চলাকালীন সর্বোচ্চ সংখ্যক কলেজ পছন্দ দিয়ে আবেদন করতে শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের প্রতি আমরাও বারবার অনুরোধ জানিয়েছিলাম। কিন্তু অনেকেই তা করেননি। অতি আত্মবিশ্বাসের কারণেও এটি হয়েছে। যে কারণে সর্বোচ্চ জিপিএধারী হয়েও তারা প্রথম পর্যায়ের ফলাফলে ভর্তির জন্য কোনও কলেজে মনোনীত হয়নি।
চট্টগ্রামে ২৮৫টিরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির সুযোগ থাকলেও সবার আগ্রহের কেন্দ্রে হাতেগোনা কিছু কলেজ। এর মধ্যে চট্টগ্রাম নগরের কলেজগুলোতে আগ্রহ বেশি। চট্টগ্রামের ভালো কলেজ বলে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোতে সর্বসাকুল্যে ৯ থেকে ১০ হাজার শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ রয়েছে। চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামের বাইরের কলেজগুলোতে সবমিলিয়ে আসন ১ লাখ ৬৭ হাজারের মতো। ফলে ভালো কলেজ বলে পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোতেই ভর্তির জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা হবে।
ছাত্র-ছাত্রীদের পছন্দের কলেজগুলোর মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রাম কলেজ। এ কলেজে বিজ্ঞান বিভাগে ৬০০ ও মানবিকে ৩৮০ জনসহ মোট ১ হাজার ৪০ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান। চট্টগ্রাম কলেজের অধ্যক্ষ মুজাহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, আমাদের আসন সীমিত। এরমধ্যে আবেদনকারী সবাই জিপিএ-৫ পাওয়া। তখন নম্বরের ওপর ভিত্তি করে শিক্ষার্থী নেওয়া হয়। এটা কেন্দ্রীয়ভাবে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি কমিটিই করে থাকে।
শিক্ষার্থীদের আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা আরেকটি কলেজ হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ। এখানে একাদশ শ্রেণিতে বিজ্ঞান বিভাগে ৬৬০ জন, মানবিকে ৪৫০ জন ও ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগে ৬১৫ জনসহ মোট ১ হাজার ৭২৫ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ পান।
হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম বলেন, ‘যারা আবেদন করে, সবাই মেধাবী। আমাদের আসন সীমিত। সেজন্য সবাইকে ভর্তির সুযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না। আমি মনে করি, সব কলেজে শিক্ষার মান নিশ্চিত করতে পারলে এ প্রতিযোগিতা কমে যাবে’।
তিন ধাপে ভর্তি আবেদন, ফি ১৫০ টাকা
প্রতি বছর একাদশ শ্রেণিতে ভর্তির নীতিমালা করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এবারও নীতিমালার খসড়া করা হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে বৈঠক করে তা চূড়ান্ত করা হবে। খসড়া নীতিমালা অনুযায়ী-এবারও একাদশ শ্রেণিতে তিন ধাপে ভর্তির আবেদন নেওয়া হবে। ২৬ মে থেকে আবেদন শুরু হয়ে চলবে ১১ জুন পর্যন্ত।
চট্টগ্রাম মহানগরের ৮টি সরকারি কলেজে ভর্তিতেই মেধাবীদের বেশি আগ্রহ থাকে। এগুলো হলো- চট্টগ্রাম কলেজ, হাজী মুহাম্মদ মহসিন কলেজ, সিটি কলেজ, কমার্স কলেজ, মহিলা কলেজ, বাকলিয়া কলেজ, চট্টগ্রাম মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজ এবং কলেজিয়েট স্কুল অ্যান্ড কলেজ। এসব কলেজে মানবিক বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্য আসন রয়েছে ২ হাজার ৭৪০টি, ব্যবসায় শিক্ষা বিভাগের জন্য ৩ হাজার ৭৭০টি এবং বিজ্ঞান বিভাগের জন্য আসন রয়েছে ৩ হাজার ৫৯০টি। এসব কলেজে প্রতিবারের মতো এবারও আসনের বিপরীতে কয়েক গুণ বেশি আবেদন জমা পড়বে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়াও রয়েছে চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক কলেজ, হাজরা তজু ডিগ্রি কলেজ, নৌবাহিনী স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ক্যাটনমেন্ট ইংলিশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ইস্পাহানি পাবলিক কলেজ, হাটহাজারী কলেজ, হালিশহর ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজ, গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ।