‘স্কুলটি শত্রুতে পরিণত হলো বুঝতে পারছি না’

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: দুর্বৃত্তের আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ায় এখন খোলা আকাশের নিচেই পাঠদান চলছে গাইবান্ধার সদর উপজেলায় ব্রহ্মপুত্র নদী ঘেঁষা চরাঞ্চলের একমাত্র মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কুন্দেরপাড়া গণ উন্নয়ন একাডেমিতে। আগুনে স্কুলের অফিস রুমসহ ৭টি ক্লাস রুম পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় অজ্ঞাত কয়েকজনকে আসামি করে শুক্রবার রাতে মামলা দায়ের করেছেন স্কুলের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান আসাদ। তবে দুইদিনেও হামলাকারীদের বিষয়ে কোনও তথ্য জানাতে পারেনি পুলিশ।

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ছকমল হোসেন বলেন, ‘তিলতিল করে গড়া বিদ্যালয়টি এলাকায় শিক্ষা প্রসারে কাজ করে আসছে। বিশেষ করে নারী শিক্ষায় বিদ্যালয়টি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। স্কুলের ৫৯৭ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে মেয়ের সংখ্যাই বেশি। কী কারণে বিদ্যালয়টি কারও শত্রুতে পরিণত হবে তা ভাবতে পারছি না’। আর প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘কারও সঙ্গে কোনও ধরনের দ্বন্দ্ব-কলহ নেই। কিন্তু তারপরেও কেন এ ঘটনা ঘটেছে তা বুঝতে পারছি না।’ অগ্নিকাণ্ডের পরও পাঠদান চলছে সেই স্কুলে

শনিবার সকালে একাডেমি চত্বরে খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ী শেড ও চটের ওপর বসে শত শত শিক্ষার্থী পাঠদানে অংশ নেয়। অফিস কক্ষসহ ক্লাস রুম পুড়ে গেলেও শিক্ষার্থীর উপস্থিতি কোনও কমতি ছিল না বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।

নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী নাজমা খাতুন জানায়, ‘আগুনে স্কুলের সব ক্লাস রুম পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ফলে সকাল থেকে খোলা আকাশের নিচে লেখাপড়া করতে হচ্ছে আমাদের। তবে পড়তে পারলেও চটের ওপর বসে লিখতে সমস্যা হচ্ছে। যারা এ কাজ করেছে তাদের তাড়াতাড়ি ধরে শাস্তি দেওয়া উচিত।’

নবম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী আলমগীর জানায়, ‘আমাদের সব বেঞ্চ, টেবিল ও ব্ল্যাক বোর্ড পুড়ে গেছে। এখন খোলা আকাশের নিচে কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হচ্ছে।’ আগুনে পড়ে ছাই হয়ে যাওয়া স্কুল

এসএসসি পরীক্ষার্থী নুর আলম বলেন, ‘বৃহস্পতিবার স্কুলে আমাদের বিদায় অনুষ্ঠান হয়। অনুষ্ঠান শেষে বিকালে আমরা বাড়ি ফিরি। এরপর রাতের আঁধারে কে বা কারা স্কুলে আগুন দেয়। আগুনে স্কুলে থাকা প্রবেশ পত্র, রেজিস্ট্রেশন কার্ড পুড়ে গেছে। এখন আমাদের এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেওয়াই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।’

স্থানীয় বাসিন্দা মোজাম্মেল হক বলেন, ‘এলাকায় মাদক, জুয়া, মদ ও যাত্রার নামে নগ্ন নাচ গানের আসর চলে আসছিল।  এ নিয়ে বৃহস্পতিবার কুন্দেরপাড়া গণ উন্নয়ন একাডেমি মাঠে সুধী সমাবেশ হয়। এ সুধি সমাবেশের কারণে দুর্বৃত্তরা ক্ষিপ্ত হয়ে আগুন দিতে পারে বলে ধারণা করছি আমরা।’

কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুস সালাম বলেন, ‘ব্রহ্মপুত্র নদী চরাঞ্চলের কুন্দেরপাড়ায় প্রতিষ্ঠিত গণ উন্নয়ন একাডেমী শিক্ষার মান ও আবাসিক সুবিধা থাকায় চরাঞ্চলের শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে। এ কারণে কোনও স্বার্থন্বেষী মহল শত্রুতা করে আগুন দিয়েছে। তবে কারা আগুন দিয়েছে সেব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হওয়া যায়নি।’ ধ্বংসস্তুপে আলামত সংগ্রহের কাজ চলছে

বিদ্যালয়ের এসএমজি সদস্য মিয়াজান মিয়া বলেন, ‘গভীর রাতে লাগিয়ে দেওয়া আগুনে স্কুলের সব পুড়ে গেছে। যারা শিক্ষার আলোয় আলোকিত নয় তারা এবং শিক্ষার প্রসার যাতে না ঘটে এ কারণে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা আগুন দিয়েছে। তবে যেই বিদ্যালয়ে আগুন দিয়ে থাকুক না কেন তাদের খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনতে হবে।’

অভিভাবক  মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘চরাঞ্চলের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এলাকার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে আসছিলো। এই বিদ্যালয়ের কারণে আমাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া করে মানুষ হচ্ছিলো। কিন্তু কোন শত্রুতার জের ধরে আগুন দেওয়া হলো তা বোধগম্য নয়।’

বিদ্যালয়ের সাবেক ছাত্র মিজানুর রহমান মিজান বলেন, ‘গত ১৬ বছর ধরে বিদ্যালয়টি সুষ্ঠভাবে পরিচালিত হয়ে আসছে। এখানে লেখাপড়া করে অনেক শিক্ষার্থী বড় বড় চাকরি করছেন। এই বিদ্যালয়ের কারণে চরাঞ্চলের অবহেলিত মানুষরা তাদের সন্তানদের শিক্ষা দিতে পারছেন। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি এ অঞ্চলে শিক্ষা প্রসারে অগ্রণি ভূমিকা পালন করছে। অথচ এমন একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হলো।’

বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সদস্য ছকমল হোসেন বলেন, ‘বিদ্যালয় পরিচালনা, শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ নিয়ে কারও সঙ্গে কোনও দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু কী কারণে কারা এ ঘটনা ঘটিয়েছে তাও বোঝা যাচ্ছে না। তবে অপরাধী যেই হোক তাদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।’

বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, ‘আগুনের ঘটনার পর থানায় মামলা করেছি। পুলিশ আগুনের ঘটনার রহস্য উন্মোচনে কাজ করছে। গত ১৬ বছর ধরে বিদ্যালয়টি সুষ্ঠভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মচারী ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এ অঞ্চলের মানুষের আত্মার সম্পর্ক রয়েছে। কারও সঙ্গে কোনও ধরনের দ্বন্দ্ব-কলহ নেই। কিন্তু তারপরও কেন এ ঘটনা ঘটেছে তা বুঝতে পারছি না।’

তিনি আরও জানান, বিদ্যালয় আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর শনিবার সকাল থেকে খোলা আকাশের নিচে চটের ওপর শিক্ষার্থীদের নিয়ে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। কোনোভাবেই পাঠদান কার্যক্রম বন্ধ থাকবে না। এছাড়া দ্রুত ক্লাস রুম ও বেঞ্চসহ আসবাবপত্রের ব্যবস্থা করা হবে।

গাইবান্ধা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) একেএম মেহেদী হাসান বলেন, ‘প্রধান শিক্ষকের অভিযোগ আমলে নিয়ে মামলা রুজু করা হয়েছে। আগুনে বিদ্যালয় পুড়ে যাওয়ার আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। আলামত পরীক্ষার জন্য বিশেষজ্ঞ টিম ঘটনাস্থলে আসবে। এছাড়া আগুন দেওয়ার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করতে বিভিন্ন দিক দিয়ে তদন্ত চালানো হচ্ছে। এছাড়া তাদের গ্রেফতার করতে পুলিশ তৎপর রয়েছে।’

প্রসঙ্গত ২০০৩ সালে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা গণউন্নয়ন কেন্দ্রের সহায়তায় বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। বৃহস্পতিবার গভীর রাতে গণউন্নয়ন একাডেমিতে আগুনের ঘটনা ঘটে। এতে বিদ্যালয়ে অফিস কক্ষসহ ৭টি ক্লাস রুম পুড়ে ছাই হয়ে যায়। এছাড়া আগুনে এসএসসি পরীক্ষার্থীদের প্রবেশপত্র, রেজিস্ট্রেশন কার্ড, আসবাবপত্র, শিক্ষা সরঞ্জাম ও অফিস কক্ষের আলমারিতে রাখা ১২ বছরের অন্তত ২০ হাজার স্কুল সার্টিফিকেট এবং নম্বরপত্র পুড়ে ছাই হয়। এতে প্রায় কোটি টাকার সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়।’

 

সূত্র: বাংলাট্রিবিউন