সেই বালিশ কাণ্ডের হোতা রাজশাহী অঞ্চলে বাগিয়েছেন দেড়শ কোটি টাকার কাজ

নিজস্ব প্রতিবেদক:

কখনো দরপত্রে ইচ্ছেমতো শর্ত জুড়ে দিয়ে, কখনো গোপনে প্রাক্কলিত মূল্য দিয়ে, আবার কখনো বেশি কাজের অভিজ্ঞতার (টার্নওভার) অজুহাতে একের পর এক কাজ দেওয়া হয়েছে রুপপুর পারমণবিক বিদ্যুতকেন্দ্রের বালিশ কাণ্ডের হোতা শাহাদত হোসেন ওরফে সাজিনকে। সবমিলিয়ে রাজশাহী, নাটোর ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে গত তিন বছরে বিতর্কিত এই ঠিকাদারকে অন্তত দেড়শ কোটি টাকার কাজ দেওয়া হয়েছে রাজশাহী গণপূর্ত বিভাগ থেকে।

মোহনপুর সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (টিটিসি), বাঘা-চারঘাট, ও রাজশাহী সদরে তিনটি মসজিদ, রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ভবন নির্মাণ, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সাবস্টেশন নির্মাণ, শিবগঞ্জ ও নাটোরে মসজিদ নির্মাণসহ ১০-১২টি বৃহৎ প্রকল্পের আওতায় একে একে অন্তত দেড়শ কোটি টাকার কাজ বাগিয়ে নিয়ছেন শাহাদত হোসেন নামের এই প্রতারক। সাজিন এন্টার প্রাইজের নামে যে কাজগুলোর তিনি বাগিয়ে নিয়েছেন, তার অধিকাংশই গত দুই-তিন বছরে অর্ধেকও শেষ করতে পারেননি তিনি। আবার কোনো কোনোটি এখনো শুরুই করা যায়নি এই প্রতারকের গাফলতির কারণে।

মোহনপুরে এখানেই মসজিদ নির্মাণের কথা রয়েছে। কিন্তু এখনো কাজ শুরুই হয়নি।

অভিযোগ উঠেছে, যেসব কাজ সম্পন্ন করেছেন, সেগুলোতেও বড় ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছেন প্রতারক শাহাদত হোসেন। এমনকি রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রোগীদের জন্য সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার জেনারেটরেও বড় ধরনের অনিয়মের চেষ্টা করেন সাজিন এন্টার প্রাইজ। এ নিয়ে কালের কণ্ঠে একটি সংবাদ প্রকাশ হওয়ার পরে আটকে যায় তার সেই প্রতারণার চেষ্টাটি। তবে প্রতারণা করার চেষ্টার কারণে এখনো চালু করা যায়নি রামেক হাসপাতালের সেই সাবস্টেশনটি। এই সাবস্টেশনটি টেন্ডারের সময় অতিরিক্ত শর্তজুড়ে দেওয়া হয়। যাতে করে বিতর্কিত প্রতিষ্ঠান সাজিন এন্টারপ্রাইজই কাজটি পাই।

২০০৮ সালের আগস্টে এই টেন্ডারের অনিয়ম নিয়ে একটি অনুসন্ধানী খবর প্রকাশ হয়েছিল। কিন্তু তার পরেও সাজিনকেই কাজটি দেওয়া হয়ে। রামেক হাসপাতালে নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য এক হাজার কেভি সাবস্টেশন নির্মাণ ও ৫০০ কেভি জেনারেটর সরবরাহের জন্য প্রায় ১৫ কোটি টাকা ব্যয়ের কাজটি সাজিনকে দিতে নিয়ম বহির্ভূতভাবে সংশোধনীর মাধ্যমে বাড়তি অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। তাতে নয় কোটি টাকার ভবন নির্মাণ অভিজ্ঞতাসহ একটি জেনারেটর ও ট্রান্সফরমার সরবরাহ কাজের অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়।

এই অভিজ্ঞতার বলে শেষ পর্যন্ত এককভাবে ওই টেন্ডারে অংশ নেয় সাজিন এন্টার প্রাইজ। আবার কাজটি করতে গিয়ে প্রতিষ্ঠানটি জেনারেটর ও বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য যে কেবল দেওয়ার কথা ছিলো, সিডিউল অনুযায়ী সেটি না করে নিম্নমাণের কেবল ও জেনারেটর সরবারহ করে। কোটি টাকা মূল্যের জেনারেটর সরবরাহের জায়গায় ভুয়া এলসি দেখিয়ে নিম্নমাণের জেনারেটর সরবরাহ করা হয়।

এ নিয়ে গত বছরের ১৬ জুলাই আরেকটি অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশ হয়। এরপর জেনারেটরটি না নিতে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দেয় গণপূর্ত রাজশাহী ডিভিশন-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী ফেরদৌস শাহ কান্তা। এরপরও নানাভাবে টালবাহানা শুরু করেন। ফলে এখনো এই সাবস্টেশনটি রামেক হাসপাতালের রোগীদের উপকারে আসেনি।

সূত্র মতে, রাজশাহীর মোহনপুরেও একই কায়দায় প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে টিটিসি নির্মাণকাজটি দেওয়া হয় একই ২০১৭ সালে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই কাজের অর্ধেক কাজও সম্পন্ন করতে পারেনি সাজিন এন্টার প্রাইজ। এই কাজের দরপত্রেও রুপপুরের বালিশ কাণ্ডের মতো কোনো কোনো কাজের জন্য উচ্চ দরর দেওয়া হয়েছে। আবার যেসব মালামাল সাপ্লাই কম দিতে হবে, সেগুলো দর দেওয়া হয়েছে কম। সেই সঙ্গে এখানে কাজ করতে গিয়েও নানা অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। ফলে কয়েকবার কাজ বন্ধ করেও দেন স্থানীয় এমপি আয়ন উদ্দিন।

এরপর গত বছর এই উপজেলাতে প্রায় ১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে মডেল মসজিদ নির্মাণের ফের সাজিন এন্টার প্রাইজকে কাজ দেওয়া হয়। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানটিকে কাজ নিতে স্থানীয় এমপি আয়েন উদ্দিনের পক্ষ থেকে বার বার নির্দেশনা দেওয়া হয় ওই সময় গণপূর্ত বিভাগের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের। কিন্তু সেই নির্দেশনা উপেক্ষা করেই টার্নওভারে এগিয়ে থাকায় শেষ পর্যন্ত সাজিনকেই কাজটি দেওয়া হয়। কিন্তু এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও এখনো সেই কাজ শুরুই করতে পারেনি সাজিন এন্টার প্রাইজ। দেড় বছর মেয়াদি এই কাজটি কতদিন নাগাদ শেষ হবে তা নিয়ে সংশয়ে খোদ গণপূর্ত বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারাও।

মোহনপুরের স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধ আসলাম উদ্দিন বলেন, ‘কতদিন ধরে মসজিদ হবে শুনছি। কিন্তু এখনো কাজই শুরু করতে পারলো না, তাহলে কবে নাগাদ কাজ শেষ হবে? শখ ছিলো শেখ হাসিনার দেওয়া উপহার এই উন্নত মসজিদে একদিনের জন্য হলেও নামাজ আদায় করবো। কিন্তু আমার জীবনে মনে হয় আর সেই আশা পূরণ হবে না।’

এদিকে রাজশাহী নগরীর উপশহরে যে মডেল মসজিদের কাজটি পেয়েছে সাজিন এন্টার প্রাইজ। সেটির এখনো বেজমেন্ট ঢালায় সম্পন্ন করতে পারেনি। প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে তিন বছর মেয়াদি এই কাজটিরও এরই মধ্যে প্রায় এক বছর শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু যে গতিতে কাজ চলছে, তাতে আগামী তিন বছরেও শেষ হবে না বলে দাবি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা মাহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘কিভাবে আশে-পাশের ভবনের কাজগুলো তর তর করে উঠে যাচ্ছে, অথচ মসজিদের কাজটি চলছে শম্বুক গতিতে।’

রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের ১৭ কোটি টাকা ব্যয়ের কাজটিও তিন বছরের বেশি সময় পার হলেও এখনো শেষ করতে পারেনি একই সাজিন এন্টার প্রাইজ। প্রায় চার কোটি টাকা ব্যয়ে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমীর কাজের দরপত্রেও রুপপুরের বালিশ কেনার মতো কোনো কোনো কাজে উচ্চ দর দেওয়া রয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।


এ ব্যাপারে জানতে চাইলে গণপূর্ত বিভাগের রাজশাহী-১ সার্কেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদ রানা বলেন, ‘কোনোটাতে উচ্চ দর দেওয়া হয়েছে। আবার কোনোটাত খুবই কম দর দেওয়া হয়েছে। যেসব মালামাল সরবরাহে কম দর দেওয়া হয়েছে, আমরা আগে সেগুলোই কিনতে বাধ্য করেছি। ফে কাজ করতে গিয়ে কোনো অনিয়ম করার সুযোগ দেওয়া হয়নি।’

এর বাইরে বাঘা ও চারঘাটে প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি মডেল মসজিদ, কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী পুলিশ লাইনস রেশন স্টোর এবং নাটোর এবং শিবগঞ্জে আরও প্রায় ২৫ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি মডেল মসজিদ নির্মাণসহ কাজ বাগিয়ে নিয়েছেন নানা অনিয়মের মাধ্যমে।

এর মধ্যে প্রায় ১২ কোটি টাকা ব্যয়ে নাটোর জেলা মসজিদটি কাজটি পেয়েছেন শাহাদত হোসেন জেলে বসেই গত প্রায় তিন মাস আগে। কিন্তু এখনো কাজ শুরু করতে পারেননি তিনি। বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে গণপূর্ত বিভাগের নাটোরর জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদ ইসলাম বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী কাজটি দেওয়া হয়েছে। তবে গণপূর্তের কালো তালিকাভূক্ত সাজিন এন্টার প্রাইজকে কাজটি দেওয়া হয়নি। কাজটি পেয়েছে সাজি কন্সট্রাকশন নামের আরেকটি প্রতিষ্ঠান।’

তিনি বলেন, যখন টেন্ডার আহ্বান করা হয়, তখন সাজিন কন্সট্রাকশন লিমিটেডের মহা-পরিচালক শাহাদত হোসেন বাইরেই ছিলেন। তবে টেন্ডারের অনুকূলে যখন কার্যাদেশ দেওয়া হয়, তখন তিনি গ্রেপ্তার হয়ে জেলখানার ভিতরে ছিলেন বলে শুনেছি। তবে যেহেতু ইজপিতে টেন্ডার দাখিল করেছেন তিনি এবং সমস্ত শর্ত পূরণ করেই সেটি দাখিল ছিলো ফলে তাকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। তবে তিনি এখনো কাজ শুরু করতে পারেননি। তার পক্ষে কার্যাদেশে স্বাক্ষর করেছেন সাজিন কন্সট্রাকশন লিমিটের পরিচালক। তাঁকে শাহাদত হোসেন ক্ষমতা দিয়ে রেখেছেন। তাই তাঁর সঙ্গে আমরা চুক্তি স্বাক্ষর করেছি।’
স/আর