সোমবার , ৬ মে ২০২৪ | ১৩ই জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
  1. অন্যান্য
  2. অপরাধ ও দুর্নীতি
  3. অর্থ ও বাণিজ্য
  4. আইন আদালত
  5. আন্তর্জাতিক
  6. কৃষি
  7. খেলা
  8. চাকরীর খবর
  9. ছবিঘর
  10. জাতীয়
  11. তথ্যপ্রযুক্তি
  12. দুর্ঘটনা
  13. ধর্ম
  14. নারী
  15. নির্বাচিত খবর

সুন্দরবনে আগুন লাগে না, লাগানো হয়!

Paris
মে ৬, ২০২৪ ১২:৪৮ অপরাহ্ণ

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

বন্যপ্রাণী নিধন ও গাছ উজাড়সহ নানান বিপদে আক্রান্ত সুন্দরবনের জন্য আরেক উপদ্রব হয়ে উঠেছে বারবার আগুন লাগা। সর্বশেষ গত শনিবার সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের জিউধারা স্টেশনের আমোরবুনিয়া টহল ফাঁড়িসংলগ্ন বনাঞ্চলে আগুন লাগে। স্থানীয় গ্রামবাসী, স্বেচ্ছাসেবী, বন বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, কোস্ট গার্ড, নৌ ও বিমানবাহিনীর সদস্যদের সম্মিলিত চেষ্টায় ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় পর আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও পুরোপুরি নেভেনি। এরই মধ্যে ঝলসে গেছে বনের বিস্তর এলাকা।

সুন্দরবনে আগুন লাগার ঘটনা নতুন নয়। বন বিভাগের তথ্য বলছে, ২০০২ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত ২২ বছরে প্রায় ২৫ বার আগুন লেগেছে সুন্দরবনে। আর এসব অগ্নিকান্ডে ৭৬ একর বনজ সম্পদ (সুন্দরী গাছসহ বিভিন্ন লতাগুল্ম) পুড়ে গেছে।

তবে বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবাদীরা বলছেন, সুন্দরবনের যে বৈশিষ্ট্য তাতে প্রাকৃতিকগতভাবে সেখানে আগুন লাগার সম্ভাবনা খুবই কম। আগুনের যেসব ঘটনা ঘটছে, তার অধিকাংশই মানুষের দ্বারা।

২০০২ সালে শরণখোলা রেঞ্জের কটকা অভয়ারণ্যে আগুন লাগে। এতে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় প্রায় এক একর বন। ২০০৪ সালের ২৫ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী ক্যাম্পের মাদ্রাসারছিলা অঞ্চলের ৩ একর বন আগুনে পুড়ে যায়। একইভাবে ২০০৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর আড়ুয়ারবেড় অঞ্চলে পুড়ে যায় ৯ শতক বন। ২০০৫ সালের ৮ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের কলমতেজী অঞ্চলে পুড়ে যায় আড়াই একর বন। একই বছরের ১৩ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের তুলাতলায় পোড়ে ৪ একর বন।

এরপর ২০০৬ সাল থেকে লাগাতার বন পুড়তেই থাকে। ওই বছর ১৯ মার্চ শরণখোলা রেঞ্জের তেরাবেকায় পোড়ে এক একর বন। এরপর ১১ এপ্রিল চাঁদপাই রেঞ্জের আমোরবুনিয়া টহল ফাঁড়ি অঞ্চলে পোড়ে ৫০ শতক বন। পরদিন ১২ এপ্রিল কলমতেজী টহল ফাঁড়ির খুটাবাড়িয়া এলাকায় পোড়ে দেড় একর। পরের মাসে একই রেঞ্জের নাংলী ফাঁড়ির পচাকুড়ালিয়া এলাকায় পোড়ে ৫০ শতক বন এবং ৪ মে ধানসাগর স্টেশনসংলগ্ন এলাকায় পুড়ে ছাই হয় আড়াই একর বন।

২০০৭ সালেও তিনবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। ওই বছর ১৫ জানুয়ারি শরণখোলার ডুমুরিয়া ক্যাম্প এলাকায় ৫ একর, ১৯ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের নাংলী এলাকায় ২ একর এবং একই অঞ্চলে ২৮ মার্চ পুড়ে যায় ৮ একর বন। ২০১০ সালের ২০ মার্চ চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের গুলিশাখালী এলাকায় পুড়ে যায় ৫ একর বন।

২০১১ সালেও তিনবার আগুন লাগে। ১ মার্চ নাংলী অঞ্চলের ২৫ নম্বর কম্পার্টমেন্টে পোড়ে প্রায় ২ একর এবং একই বছর ৮ মার্চ আড়ুয়ারবেড় অঞ্চলে পুড়ে যায় ৩ একর বন। এরপর ২০১৪ সালের ২৫ মার্চ আবারও ভোলা নদী থেকে প্রায় দুই কিলোমিটার ভেতরে চাঁদপাই রেঞ্জের গুলিশাখালীর পঁয়ষট্টিছিলা অঞ্চলে আগুনে ১০ একর বন পুড়ে যায়।

২০১৬ সালের ২৭ মার্চ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত ধানসাগর স্টেশনের এই নাংলী ক্যাম্পেরই পচাকুড়ালিয়া, টেংরা ও তুলাতুলী এলাকার ম্যানগ্রোভ বন আগুন দিয়ে ঝলসে দেয় দুর্বৃত্তরা। ২০১৭ সালের ২৬ মে চাঁদপাই রেঞ্জের ধানসাগর স্টেশনের নাংলী ক্যাম্পের আবদুল্লাহরছিলা এলাকার প্রায় ৫ একর বনভূমি আগুনে পুড়ে যায়। ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ধানসাগর এলাকায় এবং ৩ মে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের দাসের ভাড়ানি এলাকায়ও আগুন লেগেছিল।

আগুন লাগার কারণ ও ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে প্রতিবারের মতো এবারও চাঁদপাই রেঞ্জের সহকারী বন সংরক্ষককে প্রধান করে জিউধারা ও ধানসাগর স্টেশন কর্মকর্তাদের নিয়ে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগ। কমিটিকে এক সপ্তাহের ভেতর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

তবে পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, বরাবরের মতোই এ কমিটি এবারের আগুন লাগার ঘটনারও কোনো সুষ্ঠু তদন্ত করতে পারবে না। যার ফলে হবে না ন্যায়বিচারও। তাদের ভাষ্য, বনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা নজরদারির ঘাটতির কারণেই আগুন লাগার ঘটনা ঘটছে। একই সঙ্গে গাছ চুরি বা প্রাণী হত্যার ঘটনাও প্রায়ই ঘটছে।

পরিবেশবাদী ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব কারণে আগেও বনে আগুন লেগেছে, সেসব বিষয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে। বনে মানুষের অবাধ প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। বনজীবীদের আগুন লাগার বিষয়ে সচেতন করতে হবে। তা না হলেও আরও অরক্ষিত হয়ে পড়বে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জলাবনটি।

এবার ক্ষতি ৫ একর বনের : আমোরবুনিয়া টহল ফাঁড়িসংলগ্ন বনাঞ্চলে লাগা আগুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসাইন চৌধুরী গতকাল খুলনায় সাংবাদিকদের বলেন, সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের ওই এলাকায় এর আগেও একাধিকবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে। প্রতিবার তদন্ত প্রতিবেদনে ওই জায়গায় পানির পাম্প ও পাইপ বসানোসহ বেশ কিছু সুপারিশ আসে। সেই সুপারিশের আলোকে পাম্প ও পাইপ বসানো হয়। এ কারণে উপরিভাগের আগুন সহজে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে।

তিনি আরও বলেন, ওই এলাকার খাল শুকিয়ে গেছে। ভূমিরূপের পরিবর্তন হয়েছে। পাতা শুকিয়ে বড় স্তর তৈরি হয়েছে; যা তুষের মতো কাজ করেছে। ফলে কোনো উৎস থেকে আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ছে ও তীব্র হচ্ছে।

প্রধান বন সংরক্ষক জানান, এবারের আগুনে ৫ একর বনের ক্ষতি হয়েছে। কী কারণে আগুন লেগেছে তা এখনো জানা সম্ভব হয়নি। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। এ ছাড়া আগুনের সূত্রপাত ও ক্ষতি নিরূপণে আজ সোমবার বন সংরক্ষকে প্রধান করে সাত সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হবে। কমিটি ১০ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দেবে।

সুন্দরবনের পূর্বাঞ্চলে কেন বারবার আগুন : একক আয়তনের বৃহত্তম জোয়ার-ভাটার বনভূমি সুন্দরবন। ভৌগোলিক ও প্রতিবেশগত কারণে এখানে প্রাকৃতিকভাবে বনে আগুন লাগার কোনো কারণ নেই। কিন্তু বছরের পর বছর সুন্দরবনে আগুন লেগেই চলছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ছালেহ আহমদ বলেন, ‘সুন্দরবনের যে বৈশিষ্ট্য তাতে প্রাকৃতিকগতভাবে সেখানে আগুন লাগার সম্ভাবনা খুবই কম। সুন্দরবনে যে আগুন লাগার ঘটনা আমরা দেখাতে পাচ্ছি, এটা স্পষ্টই বলা যায় এগুলো মানুষের দ্বারাই ঘটছে।’

সুন্দরবনে আগুন লাগার পেছনে কিছু কারণ দাঁড় করিয়েছে বন বিভাগ। যদিও তাদের সঙ্গে দ্বিমত রয়েছে পরিবেশবাদীদের। বন বিভাগের ২৪টি তদন্ত প্রতিবেদনের প্রায় ১৫টিতেই বলা হয়েছে অসাবধানতাবশত জেলে-মৌয়ালদের ফেলে দেওয়া কোনো কিছু থেকেই আগুন লেগেছে। এ ছাড়া পাঁচবার মাছ মারার জন্য দুষ্কৃতকারীদের দেওয়া আগুনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর বাইরে প্রচ- তাপপ্রবাহ এবং ইচ্ছাকৃত অগ্নিসংযোগের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ হয়েছে চারবারের প্রতিবেদনে।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, যেসব অঞ্চলে আগুন বেশি লাগছে সেখানে নদী, খাল ও পানিপ্রবাহ কম। কেউ কেউ এ সময়টাতে আগুন লাগিয়ে সুন্দরবনের খাঁড়ি ও খালগুলো থেকে একতরফাভাবে মাছের বাণিজ্য করে। এ ছাড়া সুন্দরবনের গাছ এবং বন্যপ্রাণী বাণিজ্যের মতো বিষয়কে আড়াল করতেই এসব ঘটনা ঘটানো হচ্ছে।

এ বিষয়ে প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রতিবেশবিষয়ক গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ‘সুন্দরবনের সঙ্গে বনজীবীদের একটি আধ্যাত্মিক সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু বন বিভাগ তাদের প্রতিবেদনে একতরফাভাবে বনজীবীদের ওপর দায় চাপিয়ে দিতে চাইছে। মধু সংগ্রহের সময় বনজীবীদের নৌকায় যখন রান্না হয় তখন বনজীবীরা শুধু সাবধানতার সঙ্গেই সেই আগুন ব্যবহার করে না, বরং তাদের প্রতি পদে পদে এক পবিত্র এলাকার প্রতি নতজানু থাকতে হয়। আর সেই বনজীবীরা ২৫ বছর ধরে সুন্দরবনকে পুড়িয়ে মারছে! এটা কি কোনোভাবে হতে পারে?’

তিনি আরও বলেন, ‘বনজীবীরা যদি আগুন লাগাত তাহলে সবচেয়ে বেশি আগুন লাগার কথা পশ্চিম সুন্দরবনে। কারণ সেখানে বনজীবীর সংখ্যা বেশি। অন্যদিকে পূর্বাংশে মাত্র ১ শতাংশ।’

পাভেল পার্থ জানান, সুন্দরবনের মতো জায়গায় আগুন লাগলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বনতল। তিনি বলেন, ‘সুন্দরবনের ক্ষেত্রে তার প্রাথমিক খাদ্যগুলো বনতলে তৈরি হয়। এখানে আগুন লাগার ফলে যখন বনতল নষ্ট হয়ে যায় তখন প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদনকারীরা মরে যায়। খাদ্যশৃঙ্খল বিপর্যস্ত হয়ে যায়। যেখানে আগুন লাগছে সেখানে হারগোজা, ধানচি, বাঘ-ফার্ন, সিংড়া, বলা, কালিলতা, গোলপাতা, কেয়া, হেন্তাল, আঙ্গুরলতা, বাওয়ালিলতারই আধিক্য বেশি থাকে। এটিই সুন্দরবনের বৃক্ষসমাজের অবস্থান বৈশিষ্ট্য। সুন্দরবনের জন্য এই বনতল খুবই গুরুত্ববহ এবং এখানকার সব প্রাণসম্পদ পুরো বনের টিকে থাকা ও বিকাশের সঙ্গে সম্পর্কিত।’

সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ডে বিভিন্ন চক্রের সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে মনে করেন ধরিত্রী রক্ষায় আমরা (ধরা)-এর সদস্য সচিব শরীফ জামিল। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছরই এ সময়ে সুন্দরবনে অগ্নিকাণ্ড হচ্ছে। এখানে বিভিন্ন চক্র রয়েছে যারা এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকে। এদের বড় একটি অংশ মাছ ধরা প্রাণী ও কাঠবাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত। আমরা মনে করি, সুন্দরবনের এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ ষড়যন্ত্রকে রুখে দিতে বন বিভাগকে আরও সচেষ্ট হতে হবে। দ্রুত দোষীদের খুঁজে বের করে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের অগ্নিকাণ্ড থেকে সুন্দরবনকে রক্ষা করা যায়।’

সুন্দরবন রক্ষায় বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নে জোর দেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি বেলার নির্বাহী প্রধান সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ‘প্রতি বছর স্বল্পমাত্রায় হলেও সুন্দরবনে আগুন লাগে, সুন্দরবন রক্ষায় আমাদের তাই বাড়তি সাবধানতা প্রয়োজন। তদন্ত কমিটি সরকারি পর্যায়ে করে যে কোনো লাভ হয় না, তা তো অতীতের ঘটনা থেকে প্রমাণিত। এবার তাই কারণ কী, সেটা উদঘাটনের পাশাপাশি, আগামীতে করণীয় নির্ধারণে বিশেষজ্ঞ দিয়ে কর্মপরিকল্পনা করা আর তা বাস্তবায়ন জরুরি।’

 

 

সর্বশেষ - জাতীয়