সীমান্তে মর্টার শেল: মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে তলব করে প্রতিবাদ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

জর্জ অরওয়েল, আসল নাম এরিক আর্থার ব্লেয়ার, ১৯০৩ সালে ভারতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। পরে তাঁর পরিবার ইংল্যান্ডে ফিরে এলে জর্জ পড়াশোনার জন্য এটনে যান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রথমে তিনি ব্রিটিশ হোম গার্ড এবং পরে বিবিসির জন্য কাজ করেছেন। ১৯৪৫ সালে তাঁর রাজনৈতিক রূপকধর্মী উপন্যাস, ‘এনিম্যাল ফার্ম’ এবং ১৯৪৯-এ ‘নাইনটিন এইটিফোর’ প্রকাশিত হলে তিনি বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেন।

জর্জ অরওয়েল ১৯৫০ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে মারা যান। তাঁর অন্য অনেক রচনার মধ্যে ‘নাইনটিন এইটিফোর’ বিশ্বখ্যাতি অর্জন করার পেছনে ছিল রাজনীতিগতভাবে এক অবদমিত একনায়কতন্ত্র ও মহাপরাশক্তির উত্থানের কথা। ১৯৪৯-এ প্রকাশিত ‘নাইনটিন এইটিফোর’ ছিল জর্জ অরওয়েলের শেষ গ্রন্থ। যদিও সে গ্রন্থে রুশ বিপ্লবের ক্লেদাক্ত পরিণতি তুলে ধরা জর্জ অরওয়েলের মূল উদ্দেশ্য ছিল, তবু তিনি সেখানে থেমে থাকেননি। সমাজতন্ত্রের নামে একনায়কতন্ত্র কিংবা গণতন্ত্রের নামে আধিপত্যবাদ এবং পক্ষান্তরে গণবিরোধী স্বৈরাচারের চিত্র তিনি তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। রাজনৈতিক আদর্শ প্রচারের অন্তরালে বিশ্বকে বিভক্ত করার তৎকালীন বহু অপপ্রয়াসকেও অরওয়েল স্থান দিয়েছেন তাঁর লেখায়। বিংশ শতাব্দীর পথপরিক্রমায় ১৯৫২-৫৩ সালে সংঘটিত এবং স্নায়ুযুদ্ধ নামে পরিচিত কোরীয় যুদ্ধের প্রেক্ষাপট বর্ণনা করতে গিয়ে লেখক তাঁর জীবদ্দশায়ই বিশ্বকে তথাকথিত আদর্শের ভিত্তিতে দুই শিবিরে বিভক্ত করার ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। অরওয়েলের রচনা বামপন্থীদের নয়, বামের চূড়ান্ত বামধারাকে নিয়েও বিন্যস্ত হয়েছে। এমনকি তিনি যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত মুক্ত সমাজে ‘ম্যাকার্থি যুগের’ গণবিরোধী ভূমিকা এবং সাম্যবাদবিরোধী বাড়াবাড়িকেও তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। সে কারণে তিনি স্পেনের শাসক ফ্রাংকো এবং তাঁর নািস সমর্থক ফ্যাসিবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে ১৯৩৭ সালে মাদ্রিদে গিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

জর্জ অরওয়েল একনায়কতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ এবং এমনকি গণতান্ত্রিক বিশ্বে বিরাজিত আধিপত্যবাদ ও পুঁজিবাদী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধেও কলম ধরেছেন। অরওয়েল স্পষ্টতই গণতান্ত্রিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তিনি তাঁর রচিত ‘এনিম্যাল ফার্ম’-এ নেপোলিয়ন ও স্নোবলের চরিত্র কিংবা ‘নাইনটিন এইটিফোর’-এ স্তালিন ও ট্রটস্কির যে সামাজিক দ্বন্দ্ব ও আদর্শিক সংঘাতগুলো তুলে ধরেছেন, মূলত সেগুলোই মানবসমাজকে সবচেয়ে বেশি আন্দোলিত করেছে। স্তালিনের সাম্যবাদ বা সমাজতন্ত্রের ধারণা এবং একদলীয় ফ্যাসিবাদী শাসনের যে চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন, তাতে তিনি তাঁর নিজস্ব পরিসরে দেখানোর চেষ্টা করেছেন যে সেখানে মানুষের রাজনৈতিক অধিকার কিংবা অর্থনৈতিক মুক্তি সন্তোষজনকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। ‘নাইনটিন এইটিফোর’-এর দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে গোঁফওয়ালা যে ‘বিগ ব্রাদার’ বা বড় কর্তার অবয়ব অরওয়েল চিত্রিত করেছেন, তাঁকে পাঠকরা তাৎক্ষণিকভাবেই স্তালিনের প্রতিচ্ছবি বলে ধরে নিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাকার্থি যুগে যখন বিশ্বব্যাপী একটি ভীতি হিসেবে সাম্যবাদের বিরুদ্ধে সরকারিভাবে প্রচার-প্রপাগান্ডা চলছিল, তখন অরওয়েলের ‘নাইনটিন এইটিফোর’ সংক্রামক ব্যাধির মতো আমেরিকা ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু অরওয়েলের বক্তব্য এবং মন-মানসিকতা ছিল ভিন্নতর। তিনি একদলীয় কমিউনিস্ট শাসন কিংবা তাকে ঠেকাতে গিয়ে গণতন্ত্রের নামে আধিপত্যবাদ কিংবা ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করে মানুষের মৌলিক অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। সে কারণেই তিনি ইউরোপে নািসবাদ কিংবা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে স্পেনে সংগ্রাম করেছেন। মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির প্রশ্নে তিনি যেমন আদর্শ হিসেবে সমাজতন্ত্রকে অপাঙক্তেয় মনে করেননি, তেমনি মানুষের চিন্তার স্বাধীনতা কিংবা অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে গণতন্ত্রকে স্বৈরাচার কিংবা আধিপত্যবাদীদের হাত থেকে মুক্ত রাখতে সোচ্চার হয়েছিলেন। চেয়েছিলেন অর্থনৈতিক মুক্তি ও চিন্তার স্বাধীনতার সর্বোত্তম সমন্বয় ঘটাতে। কিন্তু যে যেভাবেই চেয়েছে, সেভাবেই অরওয়েলকে ব্যবহার করার প্রয়াস পেয়েছে।

জর্জ অরওয়েল প্রগতিশীল বামধারায় বিশ্বাস করলেও তিনি ছিলেন এক ভিন্ন মতাবলম্বী বামপন্থী মানুষ, যিনি স্তালিনের ইস্পাতকঠিন একনায়কতান্ত্রিক কমিউনিজমের সঙ্গে ব্রিটিশ লেবার পার্টির বৈসাদৃশ্য খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশ লেবার পার্টিতে চেয়েছিলেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে সংগ্রাম করতে। কিন্তু লেবার পার্টি সেটিকে গৌণ করে নিজেদের ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতেই নিবিষ্টচিত্ত হয়ে পড়ে। তারা মুখে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ও একটি আদর্শ ‘কল্যাণ রাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠার কথা বললেও ক্রমে ক্রমে তা আর তাদের মূল লক্ষ্য থাকেনি। সে ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কোরীয় যুদ্ধ বা শীতল লড়াইকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র সমগ্র বিশ্বকেই দুই ভাগে বিভক্ত করার প্রয়াসে লিপ্ত হয়। রুশ বিপ্লবের পর থেকেই মস্কোর নেতৃত্বে গঠিত সোভিয়েত সামাজিক প্রজাতন্ত্রের নেতৃত্বাধীন দেশগুলোকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস চলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে উল্লিখিত এ বলয়কে মিত্র শক্তি হিসেবে গ্রহণ করা হলেও কোরীয় যুদ্ধকে কেন্দ্র করে বিশ্ব দৃশ্যত দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো দুই বিশ্বের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতকে তাদের সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী স্বার্থের কারণেই আরো তীক্ষতর করে তোলার প্রয়াস পায়। তথাকথিত মুক্ত বিশ্ব কিংবা পুঁজিবাদী বিশ্বের চক্রান্তের কারণে শেষ পর্যন্ত ১৯৯১-এর ২৬ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ে এবং পর্যায়ক্রমে জন্ম হয় ১৫টি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রের। নতুন জন্ম নেওয়া সে রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে ‘কমনওয়েলথ অব ইনডিপেনডেন্ট স্টেটস (সিআইএস)’ এবং কালেকটিভ সিকিউরিটি স্ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিএসটিও)’ গঠিত হলেও পশ্চিমা মুক্তবাজার অর্থনীতির কারণে সেগুলোর কোনো কার্যকর ভূমিকা থাকে না। সব মিলেমিশে যায় পশ্চিমা সুখ-স্বপ্নের জোয়ারে। ভেঙে পড়ে কমিউনিস্ট শাসনের কাঠামো। চীন সে সময় এর বাইরে থাকলেও মুক্তবাজার অর্থনীতির ফায়দা লুটতে তাদের রাজনৈতিক দূরত্ব আরো ঘুচিয়ে আনে। কিন্তু পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সদস্য পদ নিয়ে তখন থেকেই শুরু হয়েছিল আরেক নবতর চক্রান্ত। এর আগে রাশিয়ার নতুন নেতৃত্ব, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পশ্চিমা জোটে যোগ দেওয়ার আগ্রহ ব্যক্ত করেছিলেন। কিন্তু সাম্রাজ্যবাদীরা ‘এক বিশ্বব্যবস্থা’ চায় না। সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী কারণেই তাদের চাই এক বিভক্ত বিশ্ব, যেখানে তারা তাদের স্বার্থ ষোলো আনা বাস্তবায়ন করতে পারবে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা ও বাণিজ্য লড়াইয়ে অন্যদের বাজার দখল করে নিতে পারবে।

চীনের উত্তরোত্তর সামরিক ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে অগ্রগতির কাছে কোনো মতেই যুক্তরাষ্ট্র তার প্রথম পরাশক্তিগত অবস্থান আর ধরে রাখতে পারছিল না। সে কারণেই রাশিয়া ও ইউক্রেনকে তাদের ইচ্ছার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে এক অপরিণামদর্শী যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তাতে ইউরোপ, এশিয়া কিংবা আফ্রিকার সাধারণ মানুষের জীবনে, বিশেষ করে জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে কী দুর্যোগ নেমে আসবে সে চিন্তা সাম্রাজ্যবাদী ও স্বার্থপর যুক্তরাষ্ট্রের ছিল না। তারা একের পর এক অর্থনৈতিক অবরোধ কিংবা নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সম্পূর্ণ পরিস্থিতিকে আরো জটিল থেকে জটিলতর করে তুলছে। প্রেসিডেন্ট বাইডেনের ইউরোপীয় তল্পিবাহকরা শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রকে সমর্থন দিলেও শীতের আগমন যতই ঘনিয়ে আসছে জ্বালানি ও খাদ্য সংকটের কারণে ততটাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছে। ইউরোপসহ সারা বিশ্বেই এখন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সর্বত্র এখন এক মহামন্দার আলামত দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। জর্জ অরওয়েলের ভাষায়, জো বাইডেন এখন ‘বিগ ব্রার্দার’-এ পরিণত হয়েছেন। তাঁর কর্মকাণ্ড অরওয়েলের হেভি গোঁফওয়ালা ইস্পাতকঠিন ও সুঠামদেহী সেই ব্যক্তিটির কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, যিনি আঙুল উঁচিয়ে বলতেন, ‘বিগ ব্রাদার ওয়ান্টস ইউ (বড় ভাই তোমাকে চায়)। ’ তাঁর ডাকে সাড়া না দিয়ে বাঁচার কোনো উপায় নেই। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অবস্থা এখন তেমন। তাঁর ডাকে সাড়া না দিলে অর্থনৈতিক অবরোধে ফেলা হবে এবং একঘরে করে রাখা হবে। তিনি এখন বিশ্বের একমাত্র নেতা। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিনপিং ছাড়া আর সব বড় দেশের নেতারা এখন তাঁর হুকুমবরদার। জর্জ অরওয়েল এ আধিপত্যবাদ ও স্বেচ্ছাচারিতার আশঙ্কাই করেছিলেন। আজ গণতান্ত্রিক বিশ্বও চরম একনায়কতান্ত্রিক রাজনীতির দিকে চলে যাচ্ছে। কেউ যেন তা ঠেকাতে পারছে না। প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসছে না।

ওপরে উল্লিখিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এখন সীমিতভাবে হলেও কথা বলা শুরু হয়েছে। ইউরোপের ফ্রান্স ও জার্মানি থেকে এখন এমন কথাও বলা হচ্ছে যে আর বেশি দিন হয়তো ইউক্রেনকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা সম্ভব না-ও হতে পারে। রাশিয়ার সঙ্গে তাদের (ইউরোপের) কোনো দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল না। রাশিয়ার জ্বালানি ও খাদ্য সরবরাহ তাদের জন্য অপরিহার্য। এ ছাড়া শিল্পোৎপাদনের জন্য অন্যান্য সূত্রে প্রাপ্ত জ্বালানির পরিমাণ অত্যন্ত অপ্রতুল। এভাবে অনাদিকাল পর্যন্ত চলতে পারে না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে বর্তমান বিশ্ব এখন একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সুতরাং রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতের দ্রুত নিষ্পত্তি প্রয়োজন। জোড়াতালি দিয়ে আগামী শীত মৌসুমের জন্য জ্বালানিসংকট মোকাবেলা করা গেলেও ভবিষ্যতে কী হবে? খাদ্যশস্য সরবরাহের বিষয়টি সাময়িক নয়। এসব ভেবে ইউরোপের মানুষ এখন ক্রমে ক্রমে অস্থির হয়ে উঠছে। উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ছে সমগ্র এশিয়া ও আফ্রিকাবাসী। অন্য কোনো এক দূরবর্তী মহাদেশের কোনো এক রাষ্ট্রপ্রধানের ইচ্ছা-অনিচ্ছায় সব কিছু চলতে পারে না। সুতরাং অরওয়েলের ভাষায়, ‘বিগ ব্রাদার’কে রুখে দাঁড়ানোর এখনই যথার্থ সময়।

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক
gaziulhkhan@gmail.com

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ