জনদুর্ভোগ লাঘবে কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ জরুরি

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সমগ্র বিশ্ব এখন এক কঠিন সময় অতিক্রম করছে। বর্তমানে বিশ্ব যে ধরনের সংকটকাল অতিক্রম করছে তেমনটা নিকট-অতীতে খুব একটা দেখা যায়নি। এমনকি ২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী যে ভয়ংকর অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছিল, তখনো বিশ্ব এ রকম ভয়ংকর সংকটে পড়েনি। তখন মূলত উন্নত বিশ্বের আর্থিক খাত বড় ধরনের ঝাঁকুনি খেয়েছিল এবং সেই সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে নেমে এসেছিল এক ধরনের স্থবিরতা।

অনেকে চাকরি হারিয়েছিলেন, ফলে বেকারত্বের হার বেড়ে গিয়েছিল কিন্তু মূল্যস্ফীতি সেভাবে বৃদ্ধি পায়নি। সেই সমস্যাও ছিল মূলত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে; যদিও সব উন্নত দেশ সেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। যেমন—কানাডায় সেবারের মন্দার কোনো আঁচড় লাগেনি। এর পরও বিশ্বে অন্য কোনো সমস্যা না থাকায় এবং বিগত বেশ কয়েক বছর মন্দা দেখা না দেওয়ায় সেসব উন্নত দেশের সরকার সর্বশক্তি নিয়ে সেই সমস্যা মোকাবেলায় সহযোগিতা করতে পেরেছিল। ফলে সেই মন্দা কাটিয়ে উঠতে আদৌ কোনো বেগ পেতে হয়নি। কিন্তু এবারের সমস্যার ধরন সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিগত দুই বছর করোনা মহামারির কারণে স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতি সরকারি প্রণোদনা এবং প্রযুক্তি খাতের রমরমা অবস্থার কারণে সচল রাখা গেলেও অর্থনীতির মৌলিক উপাদানগুলো বেশ দুর্বলই ছিল, যা মারাত্মক আকারে দেখা দিয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে। এই যুদ্ধের কোনো রকম সুরাহা না হতেই নতুন করে দেখা দিয়েছে চীন-তাইওয়ান উত্তেজনা, যার উসকানিদাতা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে বিশ্বে যে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে তা লাঘবের পরিবর্তে ক্রমেই আরো ঘনীভূত হতে শুরু করেছে। আর এই পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে উন্নত-অনুন্নত সব দেশকেই হিমশিম খেতে হচ্ছে এবং একের পর এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে, যা প্রকারান্তরে জনদুর্ভোগ বাড়িয়ে চলেছে।

সমগ্র বিশ্বের মতো আমাদের দেশকেও এই কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে এবং এই সংকট মোকাবেলায় বেশ কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে, যা সাধারণ মানুষকে অবর্ণনীয় কষ্টের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। দ্রব্যমূল্যের মাত্রাতিরিক্ত ঊর্ধ্বগতি, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস এবং লোড শেডিং কার্যকর করা, অফিস সময় হ্রাসের মাধ্যমে কৃচ্ছ্রসাধনসহ অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত সরকারকে নিতে হয়েছে। এই মুহূর্তে এ রকম কিছু কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্পও ছিল না, যদিও এর ফলে জনগণকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। কঠিন সময়ে কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে—এ কথা সবাই জানে এবং জনগণ তাদের কষ্টের বিনিময়ে সেই বাস্তবতা মেনেও নেয়। কিন্তু কঠিন সময়ে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তের পাশাপাশি যখন অপ্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয় তখনই বিপত্তিটা ঘটে। ঠিক সে রকমটাই ঘটেছে আমাদের দেশে।

বর্তমান আর্থিক সংকট মোকাবেলায় অনিবার্য কারণে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত সরকার গ্রহণ করেছে, যা হয়তো খুবই স্বাভাবিক এবং এক ধরনের বাস্তবতা। কিন্তু সেই সঙ্গে এমন কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যা জনগণের ভোগান্তির মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে কয়েক গুণ। অথচ সেসব সিদ্ধান্ত এই সংকটময় মুহূর্তে না নিলেও চলত। জনগণের কষ্ট হবে জেনেও সংকটকালে কিছু সিদ্ধান্ত অত্যাবশ্যকীয়ভাবে গ্রহণ না করে উপায় থাকে না। সে কারণে অর্থনৈতিক মন্দা বা আর্থিক সংকটের সময় অপ্রয়োজনীয় বা অত্যাবশ্যক নয় এমন সিদ্ধান্ত, তা সে যত গুরুত্বপূর্ণই হোক না কেন তা গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকতে হয়, যাতে জনগণের বাড়তি কষ্ট না হয়। কিন্তু অপ্রিয় হলেও সত্য যে সিদ্ধান্ত গ্রহণের এই সাধারণ নিয়মটি আমাদের দেশে আদৌ অনুসরণ করা হয় না। বরং আমাদের দেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে উল্টোটাই ঘটে। যেমন—যে মুহূর্তে জনগণ আর্থিকভাবে এক কঠিন সময় পার করছে, ঠিক তখনই প্রতিটি ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমা দেওয়ার বিধানকে বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে জনগণের ভোগান্তি পৌঁছেছে চরমে। এ রকম বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে, যার কোনো প্রয়োজন এই মুহূর্তে ছিল না।

কিছুদিন আগে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে যে এখন থেকে অত্যাবশ্যক কিছু সেবা গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আয়কর রিটার্ন জমা দেওয়ার প্রমাণপত্র বাধ্যতামূলকভাবে প্রদান করতে হবে। এই সিদ্ধান্ত এখন কার্যকর করা হয়েছে এবং এর ফলে সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগের সম্মুখীন হচ্ছেন। যাঁদের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়া আছে তাঁরা সেই ঋণ নবায়ন করতে পারছেন না। যাঁদের সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা আছে তাঁরা সেই সঞ্চয়পত্র নবায়ন করতে পারছেন না। এমনকি স্থায়ী আমানতও পুনর্বিনিয়োগ বা নবায়ন করতে পারছেন না। ফলে যাঁরা সঞ্চয়পত্র বা স্থায়ী আমানতের ওপর অর্জিত সুদ বা লভ্যাংশ দিয়ে জীবন নির্বাহ করতেন তাঁরা পড়েছেন চরম সংকটে। এমনকি এই দুর্দিনে উপায়ান্তর না পেয়ে ঋণের টাকা থেকে কিছু নিয়ে সংসার চালানোর যে সুযোগ তা-ও আটকে গেছে এই সিদ্ধান্তের কারণে। শুধু তা-ই নয়, কোথায়, কিভাবে এই আয়কর রিটার্ন জমা দিতে হবে তা ভেবে দেশের বেশির ভাগ সাধারণ মানুষ দিশাহারা। অথচ জনগণের কষ্ট লাঘবে এই সিদ্ধান্তটি এই মুহূর্তে না নিলে এমন কোনো ক্ষতি হতো না।

জনগণকে আয়কর রিটার্ন দাখিলের আওতায় আনতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার আগে আয়কার রিটার্ন দাখিলব্যবস্থাকে আধুনিক করে গ্রামগঞ্জে বসে খুব সহজে অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিলের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অথচ সে রকম ব্যবস্থা না করে আকস্মিক সব কিছুতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র সরবরাহের সিদ্ধান্ত নিয়ে জনগণের দুর্ভোগ বাড়ানোর কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেই হয় না। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের মধ্যেই আছে সার্থকতা। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে বিস্তারিত অবগত নন। তিনি জানলে এ ধরনের সিদ্ধান্ত কোনো অবস্থায়ই নিতে দিতেন না। জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে অনতিবিলম্বে সব কিছুতে আয়কর রিটার্ন দাখিলের প্রমাণপত্র জমাদানের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করা প্রয়োজন। সবার জন্য যদি না-ও হয়, সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তত এক কোটি টাকা পর্যন্ত এই রিটার্ন দাখিলের বাধ্যবাধকতা প্রত্যাহার করা প্রয়োজন এবং পর্যায়ক্রমে ধাপে ধাপে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।

একইভাবে সব কিছুতে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের বিষয়টি বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থাৎ জাতীয় পরিচয়পত্র ছাড়া কোনো কিছুই করা সম্ভব নয়। উদ্যোগটি ভালো নিঃসন্দেহে, কিন্তু এর ফলে অনেককেই চরম ভোগান্তির সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কেননা এখনো শতভাগ মানুষের জাতীয় পরিচয়পত্র নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। বিশেষ করে বেশির ভাগ প্রবাসী বাংলাদেশির জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, কারণ সরকার প্রবাসীদের মাঝে জাতীয় পরিচয়পত্র প্রদানের কাজটি সেভাবে শুরুই করেনি। এ ছাড়া একটি মাত্র ডকুমেন্ট কখনোই বাধ্যতামূলক আইডি বা পরিচয়পত্র হতে পারে না। জন্মনিবন্ধন পত্র বা পাসপোর্টকেও বিকল্প আইডি হিসেবে গ্রহণের ব্যবস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। প্রবাসীদের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্রের পাশাপাশি পাসপোর্টকেও আইডি হিসেবে গ্রহণের সিদ্ধান্ত থাকা প্রয়োজন। তা না হলে যেসব প্রবাসী বাংলাদেশির জাতীয় পরিচয়পত্র নেই তাঁরা দেশে বৈদেশিক মুদ্রা প্রেরণ করে ওয়েজ আরনারস ডেভেলপমেন্ট বন্ড বা ডলার বন্ড ক্রয় করতে পারবেন না। এমনকি এরই মধ্যে ক্রয় করা বন্ড নবায়ন করতে পারবেন না। ফলে সেই অর্থ বিদেশে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হবেন, যা দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একইভাবে দেশে যাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র নেই, তাঁরাও এক কঠিন সমস্যার মধ্যে আছেন। এসব কারণে জাতীয় পরিচয়পত্রের পাশাপাশি বিকল্প কোনো ডকুমেন্ট আইডি হিসেবে গ্রহণের বিধান থাকা প্রয়োজন এবং এই সিদ্ধান্ত অনতিবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে, যাতে জনগণকে উটকো ঝামেলা পোহাতে না হয়।

এ রকম আরো কিছু সিদ্ধান্ত আছে, যা এই মুহূর্তে জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে গ্রহণ করা প্রয়োজন। যেমন—প্রয়োজনীয় প্রভিশন রাখার বিধান নিশ্চিত করে ব্যক্তিগত ঋণ ও ক্রেডিট কার্ডের ব্যবহার অবারিত করা প্রয়োজন। এর ফলে জনগণের হাতে খরচ করার মতো অর্থ থাকবে এবং অসহায় নিরীহ মানুষ গ্রাম বা মফস্বল শহরের দুষ্ট লোকের ঋণের ফাঁদে পড়ে সর্বস্বান্ত হবে না। দেশের ডলারের ওপর থেকে চাপ কমানোর জন্য বিলাসদ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে শতভাগ মার্জিন ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রায় জমা দিয়ে এলসি খোলার বিধান কার্যকর করতে হবে অনতিবিলম্বে। এতে দুটি লাভ হবে। এক. দেশে ডলার বা বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ কমবে। দ্বিতীয়ত, উন্নত বিশ্ব যারা এই সংকটের স্রষ্টা এবং এই সংকট জিইয়ে রেখে অন্য দেশকে কাবু করতে চেষ্টা করছে, তারাও কিছুটা হলেও চাপে থাকবে। কেননা তাদের রপ্তানি হ্রাস পাবে। এর পাশাপাশি আমাদের রপ্তানি বহুমুখীকরণের সক্রিয় উদ্যোগ এখন থেকেই নিতে হবে।

জনগণের দুর্ভোগ যাতে কিছুটা হলেও লাঘব করা যায় সে জন্য এই সিদ্ধান্তগুলো অনতিবিলম্বে গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ ছাড়া ভবিষ্যতে সংকট দীর্ঘ হলে যেন আগে থেকেই প্রস্তুতি নিয়ে রাখা যায়। কেননা এই সংকট খুব দ্রুতই কাটবে বলে মনে হয় না। যদিও বর্তমান গভর্নর মাস তিনেক পরই মুদ্রাস্ফীতি স্বাভাবিক হওয়ার ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন এবং আমরাও তেমনটাই আশা করি। কিন্তু বাস্তব অবস্থা, বিশেষ করে উন্নত বিশ্ব, যারা এই সংকট সৃষ্টি করেছে এবং যারা এই সংকটের সমাধান করতে পারে তাদের অবস্থা কিন্তু তা বলে না। ফলে সংকট যে দীর্ঘ হবে তা মোটামুটি নিশ্চিত করেই বলা যায়। আর এই সংকট মোকাবেলার জন্য ভালো প্রস্তুতি গ্রহণ এবং সংকটকালে জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে এই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

লেখক : সার্টিফায়েড অ্যান্টি-মানি লন্ডারিং স্পেশালিস্ট ও ব্যাংকার, টরন্টো, কানাডা
Nironjankumar_roy@yahoo.com

 

 

সূত্রঃ কালের কন্ঠ