সিংড়ায় সাত দিন ধরে সমাজচুত্য একটি পরিবার

নিজস্ব প্রতিবেদক,নাটোর:
নাটোরের সিংড়া উপজেলার শেরকোল ইউনিয়নের তেলীগ্রামে গ্রাম্য প্রধানদের নির্দেশে রমজান আলী (৭০) নামের ওই পরিবারকে সাত দিন যাবত সমাজচ্যুত (একঘরে) করে রাখা হয়েছে। গত ১৭ মে থেকে সামাজিকভাবে ওই পরিবারের সাথে কথাবার্তা বলা,চলাফেরা সহ সকল প্রকার লেনদেন থেকে বিরত রয়েছে গ্রামের মানুষরা।

 
সামাজিক চাপ সৃষ্টির কারনে তার ছেলেকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। চার বছরের নাতিকেও দেয়া হয়নি খাবার পানি। যারা ওই পরিবারের সাথে কোন প্রকার লেনদেন বা সম্পর্ক রাখবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে লোক দিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘোষণা দেয়া হয়েছে।

 
শালিশে উপস্থিত না হওয়া ও গ্রামপ্রধানদের নিয়ে কটুক্তি করায় ওই পরিবারকে এই শাস্তি দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে এ বিষয়ে এখনো উপজেলা প্রশাসন, থানা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি অবগত নয়। ভুক্তভোগী পরিবার এ বিষয়ে মোকাম নাটোরের বিজ্ঞ নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে আব্দুস সাত্তার, রফিকুল মোল্লা, খলিল মোল্লা, মজিবর রহমান, ফরহাদ আলী, কেতাব আলী, শফির উদ্দিনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করেছে। সরেজমিনে এলাকায় গিয়ে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে।

 
রমজান আলী সিল্কসিটিনিউজকে বলেন, সম্প্রতি আব্দুস সাত্তার নামে এক গ্রাম্য প্রধানের সাথে কথা কাটাকাটি নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। তারপর গ্রামে এ নিয়ে শালিশী বৈঠকের দিন ধার্য্য করা হয় যা আমরা জানতাম না। শালিশী বৈঠকে উপস্থিত না হওয়ায় আমার পরিবারকে সমাজচ্যুত করা হয়েছে। বর্তমানে সামাজিক চাপে পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছেলেকেও চাকুরীচ্যুত করা হয়েছে। চার বছরের নাতিকে খাবার পানিও দেয়া হচ্ছে না। এক রকম মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

 
রমজান আলীর ছেলে জহুরুল সিল্কসিটিনিউজকে বলেন, আমি একজন সাধারণ ভ্যান চালক। ভ্যান চালানোর পাশাপাশি স্থানীয় একটি ধানের গোডাউনে কাজ করতাম। কয়েকটি সমিতি থেকে ঋণ নেয়া আছে। কাজ করেই ঋণ পরিশোধ করতে হয়। বর্তমানে কাজ না থাকায় অনাহারে অর্ধাহারে দিনাতিপাত করতে হচ্ছে।

 
জহুরুল আরও বলেন, আমার চার বছরের তৃষ্ণার্ত ছেলে তামিম প্রতিবেশী সেলিমের বাড়িতে পানি পানের জন্য গেলে তাকে পানি দেয়া হয়নি।

 
ধান ব্যবসায়ী স্থানীয় হুমায়ন কবির বলেন, সামাজিক ভাবে চাপের কারনে তাকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে তার কাছ থেকে যাবতীয় দায়িত্ব বুঝে নেয়া হয়।

 
তেলীগ্রাম,বামনহাট ও বক্তারপুর গ্রামের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি ওই পরিবারের সাথে কোন প্রকার লেনদেন বা সম্পর্ক রাখবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে লোক দিয়ে বাড়ি বাড়ি বলানোর বিষয়টির সত্যতা স্বীকার করেছেন।

 
গ্রাম প্রধান আব্দুস সাত্তার সিল্কসিটি নিউজকে বলেন, আমরা তাকে একঘরে করিনি। তাকে সামাজিক ভাবে বয়কট করা হয়েছে। সমাজে প্রায় ৩০০ টি পরিবার রয়েছে। তারা সমাজ মানেনা এ জন্য তাদের বিরুদ্ধে সবাই একজোট।

 
তিনি আরও বলেন, সম্প্রতি এক মহিলার সাথে দূর্ব্যবহার করায় রমজানের ছেলে জহুরুলের বিরুদ্ধে ওই মহিলা অভিযোগ দেয়। কিন্তু এবিষয়ে জহুরুলকে বারবার ক্ষমা চাওয়ার কথা বলা হলে সে নতি স্বীকার করেনি। বরং তারা গ্রাম প্রধান সম্পর্কে কটুক্তি করেছে। যার কারনে সামাজিকভাবে তাদের সাথে সকল সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করা হয়। তবে অভিযোগকারী মহিলার নাম জানতে চাইলে তিনি কোন উত্তর দিতে পারেননি।

 
সিংড়া উপজেলা মানবাধিকার কমিশনের সাধারণ সম্পাদক রাজু আহমেদ বলেন, কাউকে সামাজিকভাবে বয়কট করার অধিকার গ্রাম্য প্রধানদের নেই। এটা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামিল।

 
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান লুৎফুল হাবিব রুবেল জানান, বেশ কিছুদিন এলাকায় না থাকার কারনে বিষয়টি আমার জানা নাই। ঘটনাটি যদি ঘটেও থাকে তবে তা অমানবিক হয়েছে।

 
সিংড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নই। তবে এ ঘটনা বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার বিপরীত এবং আইনসম্মত নয়।

 
উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ভারপ্রাপ্ত) মুশফিকুর রহমান সিল্কসিটি নিউজকে জানান, বিষয়টি জানা ছিল না। তিনি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে বিষয়টি দ্রুত নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণের আশ্বাস দেন।

স/শ