সামাজিক অসন্তোষের আশঙ্কা করছে পুলিশ

রাজধানীর মগবাজার এলাকার একটি এটিএম বুথ থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে ১৫ হাজার টাকা তোলেন এক ব্যক্তি। বুথ থেকে বের হয়ে সামনে দেখতে পান ম্লান মুখে দাঁড়িয়ে আছেন অন্য আরেক ব্যক্তি। এগিয়ে এসে তিনি ছলছল চোখে জানালেন, তিন মাস ধরে আয়-রোজগার বন্ধ। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বড় কষ্টে আছেন। দয়া করে যদি কিছু সাহায্য করেন। বুথ থেকে টাকা তোলা ব্যক্তি ৫০০ টাকার একটি নোট বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘আমার আর্থিক অবস্থাও ভালো না। অ্যাকাউন্টে কিছু টাকা জমা ছিল, সেই টাকাও শেষ হওয়ার পথে।’

করোনাভাইরাসের প্রভাবে জীবিকা নিয়ে রাজধানীতে নানা পেশার মানুষ বিচিত্র ধরনের অনিশ্চয়তায় পড়েছেন। এ নিয়ে দেখা দিয়েছে সামাজিক অস্থিরতা। সরকার ঘোষিত সাধারণ ছুটির পর সীমিত পরিসরে সব কিছু খুলে দেওয়ার পরও এখনো স্বাভাবিক হচ্ছে না পরিস্থিতি। বন্ধ থাকায় অনেক বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতন পাচ্ছেন না। মার্কেটগুলো খুলে দেওয়া হলেও ক্রেতাসাধারণের উপস্থিতি নগণ্য। আর সড়কে গণপরিবহন নামলেও যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। ফুটপাতে হকাররা পসরা নিয়ে বসলেও ক্রেতা নেই। আবার অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চলছে কর্মী ছাঁটাই। এমন পরিস্থিতিতে সামাজিক অসন্তোষের পাশাপাশি নানা ধরনের অপরাধ বেড়ে যেতে পারে বলে আভাস দিয়েছে মাঠ পর্যায়ের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এ পরিস্থিতি মোকাবেলায় কর্মপন্থা ঠিক করতে মাঠ পর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে সম্প্রতি বৈঠক করেছেন ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম। করোনাকালে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দিতে না পারলে আসছে কোরবানির ঈদের আগেই পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে বলে মনে করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে আপাতদৃষ্টিতে  রাজধানীর প্রায় প্রতিটি এলাকা শান্ত। মাঝেমধ্যে দু-একটি এলাকায় বেতন-ভাতার দাবিতে পোশাক শ্রমিকরা রাস্তায় নামছেন। তবে রাজধানীর এই শান্ত পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠার আশঙ্কা করছেন মাঠ পর্যায়ের পুলিশ ও গোয়েন্দারা। বিষয়টি তাঁরা ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের জানিয়েছেনও।

সূত্র মতে, রাজধানীতে বেসরকারি হাই স্কুল ও কলেজ, কিন্ডারগার্টেন এবং কোচিং সেন্টারে তিন লাখের বেশি শিক্ষক-কর্মচারী রয়েছেন। এর মধ্যে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষকসংখ্যাই এক লাখের বেশি। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানের বেশির ভাগ শিক্ষক-কর্মচারীর বেতন বন্ধ।

রাজধানীর মধ্য বাড্ডার প্রগতি সরণির গ-৭২/১ নম্বর হোল্ডিংয়ে রয়েছে ন্যাশনাল স্কুল। গতকাল দুপুরে ওই স্কুলে গিয়ে গেট বন্ধ পাওয়া গেছে। ফোনে জানতে চাইলে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান শিক্ষক এস এম ফায়জুল হক  বলেন, ‘আমাদের স্কুল বন্ধ রয়েছে। গত মার্চ মাস থেকে আর বেতনও দিতে পারছি না। স্কুলের ৩২ জন শিক্ষকের মধ্যে অধিকাংশ গ্রামে চলে গেছে।’

সরকারের সাধারণ ছুটির পর সড়কে গণপরিবহন নামলেও যাত্রী স্বল্পতায় কোনো কোনো পরিবহনের তেলের খরচই উঠছে না। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ হানিফ খোকন  বলেন, ‘রাজধানীতে ২০ লাখের বেশি পরিবহন শ্রমিক রয়েছেন। পরিবহন চলতে শুরু করলেও যাত্রী না থাকায় তেলের খরচ তোলা যাচ্ছে না। ফলে ভীষণ আর্থিক কষ্টে আছেন পরিবহন শ্রমিকরা। ভয়াবহ পরিস্থিতির দিকে এগোচ্ছি আমরা।’ গুলিস্তান টু মিরপুর চলাচলকারী শিকড় পরিবহনের চালক শোভন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘অর্ধেক যাত্রীও পাই না কোনো ট্রিপে।’

সিএনজিচালিত অটোরিকশার (ঢাকা মেট্রো-থ-১৩-৫৩০৮) চালক আলমগীর হোসেন জানান, গতকাল সকাল ৮টায় সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে বেরিয়ে দুপুর ২টা পর্যন্ত মাত্র ৪০০ টাকা ভাড়া পেয়েছেন। অটোরিকশার মালিককে দিতে হবে এক হাজার টাকা। কোথা থেকে কী করবেন বুঝতে পারছেন না তিনি।

এদিকে অনেক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চলছে কর্মী ছাঁটাই। ফলে হঠাৎ করে কর্মহীন হয়ে পড়ছেন অনেকে। রাজধানীজুড়ে কয়েক লাখ হকার ফুটপাতে ব্যবসা করেন। বর্তমানে ফুটপাতে পসরা সাজিয়ে বসলেও সেভাবে ক্রেতা না পাওয়ায় সংকটে আছেন তাঁরাও।

গতকাল গুলিস্তানে কথা হয় কয়েকজন হকারের সঙ্গে। হকার মোহাম্মদ লালু মিয়া ২৬ বছর ধরে গুলিস্তানের ফুটপাতে জুতা বিক্রি করেন। তিনি জানালেন, ক্রেতা না থাকায় সারা দিনে ২০০ টাকাও রোজগার করতে পারছেন না। তাঁর বাসাভাড়া ১২ হাজার টাকা। চার মাস ধরে বাড়িভাড়া দিতে পারছেন না। বাড়ির মালিক বাসা ছেড়ে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছেন। পরিবারের পাঁচ সদস্য নিয়ে বড় কষ্টে কাটছে তাঁর দিন। অশ্রুসজল চোখে লালু মিয়া জানালেন, সকাল থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্ত সামান্য দানাপানিও পড়েনি তাঁর পেটে।

সব মিলিয়ে বর্তমান পরিস্থিতিতে চলমান অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে নতুন নতুন অপরাধ। এমন আশঙ্কাই করছে পুলিশ।

নাম প্রকাশ না করে পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, বাড়িভাড়া অর্ধেক করা, চাকরি থেকে ছাঁটাই বন্ধের আন্দোলন, গার্মেন্ট শ্রমিকদের আন্দোলন, নিম্ন আয়ের মানুষের চুরি-ছিনতাই-ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়াসহ নানা অপরাধ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম  বলেন, ‘সামাজিক অপরাধ বাড়তে পারে। স্বামী-স্ত্রীর বিরোধ, যৌতুকের জন্য চাপ, পারিবারিক অপরাধ, চুরি-ছিনতাই এসব বাড়তে পারে। তবে আমরা নজরদারি বাড়িয়েছি। অপরাধ রোধে প্যাট্রল বাড়ানো, আসামি ধরা অব্যাহত রয়েছে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সম্প্রতি সব থানার ওসিদের নিয়ে মিটিং করেছি। সেখানে অপরাধ বাড়তে পারে—এই বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। অপরাধ রোধে যে যে কৌশল রয়েছে সেসব প্রয়োগ করা হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘আয় কমে গেলে সব মানুষ কিন্তু অপরাধ করে না। যারা অপরাধ করবে তাদের আইনের আওতায় আনতে মাঠ পর্যায়ে আগে থেকেই প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’

মাঠ পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তা  বলেন, ‘করোনার সময়ে দেশে অপরাধ অনেক কমেছে। কিন্তু গত চার মাস অনেক প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আমরা রাজধানীতে বিভিন্ন ধরনের আন্দোলনের আঁচ পাচ্ছি। অনেক পরিবহন শ্রমিক দিনে গাড়িতে কাজ করে রাতে ছিনতাই করছে। এ শ্রেণিটাকে নিয়ে ভয় আছে।’

সূত্রাপুর থানার ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী বলেন, ‘অনেক আসামি ধরেছি, যারা দিনে গাড়ির হেলপারি করে আর রাতে করে ছিনতাই।’

রাজধানীর আরেকটি থানার ওসি নাম প্রকাশ না করে  বলেন, ‘আর দু-তিন মাস পর মধ্যবিত্তের জমানো টাকা ফুরিয়ে যাবে। বেসরকারি চাকরি যাঁরা করেন, তাঁদের অনেকের চাকরি থাকবে না। এ ক্ষেত্রে শুধু গার্মেন্টকর্মী নয়, মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও রাস্তায় নেমে পড়তে পারে। বাড়িভাড়া অর্ধেক করা, গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানির বিল কমানোর আন্দোলন হতে পারে। ফলে আমরা পরিস্থিতি সামাল দিতে এখন থেকেই কর্মপদ্ধতি ঠিক করে রাখছি।’

এসব বিষয়ে মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ ও পুলিশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ওমর ফারুক  বলেন, ‘করোনায় অর্থনৈতিক সংকটের কারণে সম্পত্তিসংক্রান্ত অপরাধ, প্রতারণা বাড়তে পারে। সম্পত্তির ঘটনা সহিংসতার দিকে যেতে পারে। আর ঈদুল আজহার আগে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি প্রকট হতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অপরাধ দমনের বিষয়ে এখনই ভাবতে হবে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাঁটাই বন্ধসহ সরকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা দিতে না পারলে অবস্থার অবনতি ঘটা অস্বাভাবিক নয়।’

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ