সবটাই চেনা অচেনার দুঃসহ খেলা

জার্মানদের স্নো হোয়াইট রূপকথায় একটা আয়নার কথা ছিল। সে আয়না সবসময় সত্য কথা বলতো। ঠিক রূপকথা দ্বারা আয়নার জার্মানির বাভারিয়া অঞ্চলের লোর এলাকার লোকেরা প্রভাবিত হয়েছিল কিনা জানি না। তবে এই লোকেরা একসময় বিশ্বাস করতো যে, আয়না সর্বদা সত্য কথা বলে। তবে এমন একটা আয়না যদি পাওয়া যেতো, তবে মানুষকে চেনাটা খুব সহজ হতো। কারণ পৃথিবীতে সবচেয়ে কঠিন কাজ মানুষকে চেনা। একটা পুরাতন সময়ের গান মনে পড়লো। গানটি ছিল

‘ডোরা কাটা দাগ দেখে বাঘ চেনা যায়,
বাতাসের বেগ দেখে মেঘ চেনা যায়,
মুখ ঢাকা মুখোশেরই দুনিয়ায়,
মানুষকে কী দেখে চিনবে বল…’

১৯৭৪ সালে মুক্তি পাওয়া ‘মাসুদ রানা’ চলচিত্রের গান এটি। গানের কথাগুলো মনে ধরার মতো। কিন্তু চেনা মানুষের অচেনা মনটা চেনা যে খুব কঠিন। যেমন আমরা জানতাম মাসুদ রানা সিরিজের লেখক হচ্ছেন কাজী আনোয়ার হোসেন। সবাই এতদিন তাই জানত। কিন্তু শেখ আবদুল হাকিম নিজেকে এই সিরিজের অধিকাংশ বইয়ের লেখক হিসেবে দাবি করে কপিরাইট আইনে মামলা করেন। মামলার রায় দেখে তো চোখ কপালে উঠলো। মামলার রায়ে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা সিরিজ মাসুদ রানার প্রথম ১১টি বইয়ের পরের ২৬০টি বইয়ের লেখক কাজী আনোয়ার হোসেন নন। এর লেখক হলেন শেখ আবদুল হাকিম। যার ফলে দাবিকৃত মাসুদ রানা সিরিজের ২৬০টি এবং কুয়াশা সিরিজের ৫০টি বইয়ের লেখক হিসেবে কপিরাইট স্বত্ব পেতে যাচ্ছেন শেখ আবদুল হাকিম।

 

এতদিন পর আমরা মাসুদ রানা সিরিজের লেখকের নামটা জানলাম। তার মানে এখন আমরা যা জানছি, বিশ্বাস করে নিশ্চিত হয়ে বসে আছি সেটা তা ছিলে না। হয়তো একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখব যাকে যেভাবে দেখেছি ও ভেবেছি সে তা ছিল না।

বিস্মিত চোখ সেদিন হয়তো চিন্তার কাছে হার মেনে আত্মসমর্পণ করলেও করতে পারে। হয়তো এভাবেই সত্য মিথ্যা হয়ে  যায়, আবার মিথ্যা সত্য হয়ে যায়। কাজী আনোয়ার হোসেনই যে ‘মাসুদ রানা’র জনক, তা স্বীকার করেন লেখক শেখ আবদুল হাকিম।

একটা পত্রিকায় শেখ আবদুল হাকিমের কাজী আনোয়ার হোসেন সম্পর্কে কিছু জবানবন্দি পেলাম। সেখানে শেখ আবদুল হাকিম বলছেন, ‘তিনি সত্যিকারের একজন ভদ্রলোক। গোপন করে তো উনি কিছু করেননি। ওনার নামে বই ছাপা হোক, তাতে আমার সম্মতি ছিল। আমি তো তখন আইন জানতাম না। উনি যেটা বলেছেন, সেটা মেনে নিয়েছি। বলেছেন, ওনার নামে ছাপলে বেশি বিক্রি হবে, আমরা মেনে নিয়েছি। আমি তো একা না। অনেকেই তো এভাবে লিখেছেন। একটা মানুষ, যিনি পরের নামে লেখেন, তার তো নিডি অবস্থা। আমাকে লিখতে হয়েছে। আমাকে যদি কেউ প্রশ্ন করেন, আপনি জেনেশুনে কেন অন্যের নামে লিখেছেন। এর উত্তর দেওয়া যাবে না। আমি করতে বাধ্য হয়েছি। আমি লিখলাম, উনি কিনে নিলেন। দয়া করে আমাকে বছরের পর বছর টাকা দিয়েছেন। একবার তো দিচ্ছেন, আবার তিন মাস পরপর টাকা দিচ্ছেন। চাইলে টাকা দেন, না চাইলেও টাকা দেন। যখন আইন জানলাম, তখন আমার চোখ খুলে গেছে।’

পুরোটা পরে রহস্যের একটা গন্ধ হয়তোবা পেলাম। তা হলো কে কার প্রয়োজন ছিল, কে ছিল না নাকি পরস্পর পরস্পরের প্রয়োজন ছিল তা হয়তো চেনা গেলো, জানা গেলো, বোঝাও গেলো। কিন্তু ফেলে আসা সময়টা তো অচেনা থেকে গেলো। চেনা-অচেনার এই সময়টাতে রবীন্দ্রনাথের সোনার তরী কবিতাটা আত্মাকে কেমন করে যেন ধাক্কা দিলো। খণ্ডিত হলো চোখের চেনার সাথে মনের চেনা। ভাঙন ধরা নদী টুকরো টুকরো হয়, অসহায় ঢেউগুলো থামতে চায় তারপরও নিজের কাছে অচেনা হয়ে নদীকে ধরে রাখা মাটিকে আঘাত করে চোখের জলে। যেমন কবি লিখেছেন-

গান গেয়ে তরী বেয়ে কে আসে পারে,
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।
ভরা পালে চলে যায়,
কোনো দিকে নাহি চায়,
ঢেউগুলি নিরুপায়
ভাঙে দু ধারে-
দেখে যেন মনে হয় চিনি উহারে।

চেনাতেও একটা শঙ্কা। আশঙ্কা। অধরাকে ধরার অর্থহীন চেষ্টা।

নজরুল ইসলাম বাবুর লেখা গানটা  মনে পড়লো। গানটা যেন কানের কাছে শব্দগুলো নিয়ে এসে বললো।

দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা
বন্ধু চিরকাল
রেল লাইন বহে সমান্তরাল
বহে সমান্তরাল

পিরিতের ঘর বানাইয়া অন্তরের ভেতর
দুই দিগন্তে রইলাম দুইজন
সারা জীবন ভর

হইলো না তো সুখের মিলন
হইলো না সুখ সাথির দর্শন
এমনি কপাল।

যেখানে মানুষ কাছাকাছি থেকেও যেন যোজন-যোজন দূরে বাস করে। মানুষ মানুষের কাছে থাকলে, সে মানুষদের মন কি কখনো কাছাকাছি বাস করে। হয়তো করে না। কিংবা করে। তবে সেটা চোখ দিয়ে যেমন বোঝা যায় না, মন দিয়েও তেমনি বোঝা যায় না। একটা কি যেন বোঝার জন্য লাগে সেটাও চেনা যায় না। সেখানে বিচ্ছেদ মানুষ মানুষকে চেনাতে শেখায় আর মিলন মানুষে মানুষে ঝাপসা ঝাপসা দেওয়াল গড়ে স্বার্থের সাথে অলিখিত চুক্তি করে।

এই আধুনিক সময়ে এসেও মানুষ প্রতিদিন বোকা হচ্ছে। যদিও মানুষ নিজেকে বোকা বলে কখনো স্বীকার করতে চায় না। যেমন একটা পাগল নিজেকে কখনো পাগল বলে মানতে পারে না। একটা সাম্প্রতিক সময়ের গল্প বলবো। ঠিক গল্প না, সত্য ঘটনা। একটা লোক দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর বলে দাবি করে আসছিলে। মানুষও তো এখন এমন হয়েছে যে যাচাই-বাছাই, যুক্তি-তর্ক কোনো কিছুর ধারের কাছেও নেই বরং কেমন যেন গা ছাড়া একটা ভাব।

লোকটাকে সমাজের সব স্তরের লোকজন নবাব সলিমুল্লাহ খানের বংশধর হিসেবে মেনেই নিয়েছিল। কারণ মানুষ তো মানুষকে মানুষ হিসেবে যাচাই করে না বরং মানুষটা তার মতো করে যে অর্থ-বিত্ত-বৈভব দেখায় সেটা দিয়ে মানুষ এখন মানুষকে বিচার করে। তার মানে এখন মানুষের কাছে মানুষের কোনো দাম নেই, দাম আছে তার সম্পদের। আর সেটা অবৈধ হলে তো আর কথাই নেই।

বড় বড় লোকদের ঘোল খাইয়ে যে লোকটা এতদিন প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল শেষ পর্যন্ত জানা গেলো সে একটা প্রতারক | তার সাথে নবাব সলিমুল্লাহ খানের দূরতম সম্পর্কও নেই। লোকটার নাম আলী হাসান আসকারী। বড় বড় কথা বলে বেড়াতেন তিনি। যেমন : দুবাইয়ে আছে তার গোল্ডের কারখানা। বাবা ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান, থাকেন নিউ ইয়র্কে। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের মালিকানায় অংশীদারি রয়েছে তাদের। বাবার কোটি কোটি টাকার ব্যবসা পরিচালনা করেন তিনি নিজেই। তার ফেসবুক প্রোফাইলে রয়েছে মন্ত্রী-এমপিসহ সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ছবি। চলেন বডিগার্ড নিয়ে। নিজে থাকেন নেদারল্যান্ডসে। বছর পাঁচেক ধরে দেশে এসেছেন। দানবীর। এ রকম আরো অনেক পরিচয় তার। কিন্তু আসলে সবই ভুয়া।

এই ভুয়া মানুষটার কাঁধে কারা কারা ভর করে উপরে উঠেছে তা হয়তো একদিন ইতিহাস হবে। সে ইতিহাস হয়তো কাগজে থাকবে না, বাতাসের তরঙ্গে থাকবে না। কোথায় থাকবে কেউ জানে না। কারণ চেনা মানুষ অচেনা হয়ে সেটাকে হয়তো মাটি দিয়ে চাপা দেবে। বোবা বানিয়ে ক্রীতদাস করে রাখবে। যেমন সত্য প্রতিদিন মিথ্যার পায়ের নিচে চাপা পড়ে। অযোগ্যরা ভানুমতির খেল দেখিয়ে যোগ্য হয়। আর যোগ্যদের অযোগ্য বানিয়ে আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করা হয়। মেধাবীরা অমেধাবীদের অর্থ আর ক্ষমতার বোঝায় চাপা পড়ে যায়।

এমন অনেক নামহীন ভুয়া মানুষ, প্রতারক চোখ আমাদের চারপাশটা কিনে ফেলেছে। সেটা নিয়ে প্রতিদিন তারা খেলছে। যেমন খুশি নাচাচ্ছে | এমন অসম্ভবটাই ঘটছে। হয়তো সন্তর্পণে, অদৃশ্য আবরণে।

যখন যেমনটাই ঘটুক, যেভাবে ঘুটুক, সেটা যেন মাটি ফুঁড়ে বেরিয়ে এসে আমাদের সত্যকে চিনিয়ে যায়। মানুষ যেন মানুষকে চিনতে পারে। পোড়ামাটি যেন পুড়তে পুড়তে একদিন দোহন জ্বালা শেষ  খাঁটি সোনা হয়ে উঠে। জীবনের মৃতপ্রায় মূল্যবোধগুলো যেন নগর থেকে নগরে আবার নতুন করে জেগে উঠে। স্বপ্ন দেখা মানুষ যেন আবার স্বপ্ন দেখার বিশ্বাস নিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। সেটা যেন এমন হয় যেটা আমরা জানি না কিন্তু আমাদের জানিয়ে যায়। আত্মার ভেতরে, দেহের শেকড়ে। সত্য কী সেটা খুঁজতে গিয়ে তমসার তীরে উদ্বিগ্ন বাল্মীকি। রামায়ণের কাহিনি তিনি অন্তর দিয়ে অনুধাবন করে ফেলেছেন।

কিন্তু সত্যকে সত্য দিয়ে খুঁজতে গিয়ে তিনি যদি সত্যভ্রষ্ট হন, এই আশঙ্কা তাকে তাড়া করে ফিরছে। ঠিক এই সময়টিতে তার সাথে দেখা হলো নারদের। বাল্মীকি-নারদের সেই অভূতপূর্ব সাক্ষাৎ দৃশ্যেকে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন এভাবেই , ‘নারদ কহিলা হাসি, ‘‘সেই সত্য যা রচিবে তুমি, ঘটে যা তা সব সত্য নয়।’’ সেটাই হয়তো আমাদের খুঁজতে হবে যতক্ষণ খুঁজে না পাওয়া যায়।

 

অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান চৌধুরী

 

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন