সংক্রমণ ঠেকাতে ৪ কৌশল

সংক্রমণের দ্বিতীয় ঢেউ এখন পড়তির দিকে। শনাক্ত তিন সপ্তাহ আগের তুলনায় অর্ধেকেরও নিচে নেমে গতি মন্থর হয়ে পড়েছে কয়েক দিন ধরে, তবে মৃত্যু একটু কমছে তো আবার বাড়ছে। চলতি মাসের শুরুতে দৈনিক শনাক্তের হার প্রায় ২৪ শতাংশে উঠে এখন সেটা ৯ শতাংশের ঘরে নেমেছে। সংখ্যার হিসাবে শনাক্ত দিনে সাত হাজারে উঠেছিল, এখন তিন হাজারের কাছাকাছি ওঠানামা করছে।

এ রকম অবস্থায় সরকারের কভিড-১৯সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গত বুধবার এক সভায় ভারতের করোনার ‘ডাবল ভেরিয়েন্ট’ বাংলাদেশে প্রবেশ করলে পরিস্থিতি সংকটময় হতে পারে বলে আশঙ্কা জানিয়েছে। সভায় ভারত থেকে আসা সব যাত্রীকে ১৪ দিন প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনে থাকা নিশ্চিত করা, বর্ডার দিয়ে প্রবেশ নিয়ন্ত্রণে নজরদারি জোরদার করার সুপারিশ করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লকডাউনব্যবস্থা তিন সপ্তাহ ধরে যেমন ধারায় চলছিল, তাতেই সংক্রমণ অর্ধেকে নেমেছে, যদি কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা পুরো মাত্রায় কার্যকরের সঙ্গে টিকা প্রয়োগ কার্যক্রম আরো দ্রুত করা যেত, তবে নিশ্চিতভাবেই দ্বিতীয় ঢেউ আরো নিচে নামিয়ে ফেলা যেত। তাঁরা উদাহরণ দেন, যুক্তরাজ্যসহ অনেক দেশেই দ্বিতীয় ঢেউ যেমন দ্রুত উঠেছে, তেমনই আবার দ্রুতই নেমেছে।

বিশেষজ্ঞরা এখন প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউয়ের মূল্যায়ন করতে গিয়ে স্পষ্টতই বলছেন, নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা কঠোর থাকলে সংক্রমণরেখা নিচে নামে আর ঢিলেঢালা হলেই তা আবার ওপরে উঠে যায়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক নিজেই কয়েক দিন ধরে এ ব্যাপারে সতর্কতা জানিয়ে আসছেন।

বিশেষজ্ঞরা প্রধানত চারটি কৌশল একসঙ্গে চালিয়ে দ্বিতীয় ঢেউয়ের বিস্তার রোধের পথ খুঁজছেন। তাঁরা বলছেন, দেশে মানুষের জীবন-জীবিকায় সমান্তরাল ভারসাম্য রাখতে গেলে ক্ষণে ক্ষণেই সংক্রমণ ওপরে ওঠার আর নিচে নামার চিত্র দেখতে হবে, যার প্রভাব বারবারই পড়বে স্বাস্থ্যব্যবস্থার ওপরে। ফলে দ্বিতীয় ঢেউ এখন যেভাবে তুলনামূলক নমনীয় পর্যায়ে আছে, সেখান থেকেই পরবর্তী ঊর্ধ্বমুখী ঢেউ মাথায় রেখে তা মোকাবেলার পরিকল্পনা এবং আগাম প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

কভিড-১৯ মোকাবেলায় সরকার গঠিত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ কয়েক দিন আগে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশের এবং দেশের বাইরে বিভিন্ন জায়গায় শুরু থেকে এ পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যায়, আমাদের এখানে এখন দ্বিতীয় ঢেউ যতটুকু দুর্বল হয়ে এসেছে, সেটা কিন্তু আবার সুযোগ পেলেই আগের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে তৃতীয় ঢেউয়ে রূপ নিতে পারে। সামনে ঈদ ঘিরে যদি আবার ব্যাপক মাত্রায় মানুষের অসতর্ক চলাচল ও সমাগম ঘটে, তাহলে ঈদের পরে যেকোনো সময় সেটা মাথাচাড়া দেবে। আমরা এ জন্য এরই মধ্যে সরকারকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছি। বলেছি, প্রধান চারটি কৌশল একসঙ্গে কাজে লাগাতে পারলেই সাফল্য আসবে, যে কাজ শুরু করতে হবে এখন থেকেই।’

অধ্যাপক শহীদুল্লাহ বলেন, ‘আমরা প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ তুঙ্গে থাকার সময় স্বাস্থ্যব্যবস্থার নানা সংকট দেখি। সামনে যাতে এমনটা না হয়। এর মধ্যে সুনির্দিষ্টভাবে বলব, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা, সবার টিকা নিশ্চিত করা, ঈদের পর পর্যন্ত যতটা সম্ভব নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বহাল রাখা, সর্বাত্মক না হলেও যেসব এলাকায় সংক্রমণ বেশি সেসব এলাকায় কঠোর লকডাউন নিশ্চিত করা; বাইরে থেকে দেশে যাতে কেউ না আসতে পারে এবং জরুরি কারণে এলেও তাদের কোয়ারেন্টিন ও আইসোলেশন নিশ্চিত করা, হাসপাতালগুলোর চিকিৎসক, নার্স, টেকনোলজিস্ট, সাপোর্ট স্টাফসহ প্রয়োজনীয় জনবল বৃদ্ধি, আইসিইউসহ সব ধরনের বেড বৃদ্ধি, অস্থায়ী হাসপাতাল প্রস্তুত রাখা, হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনব্যবস্থা নির্বিঘ্ন করতে অন্ততপক্ষে বড় হাসপাতালগুলোতে স্বয়ংসম্পূর্ণ অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন সবচেয়ে বেশি জরুরি।’

মেডিসিন সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতি ও মুগদা মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবীর  বলেন, ‘সংক্রমণ যত বড়ই হোক, হাসপাতালগুলোতে পর্যাপ্ত অক্সিজেন সাপোর্ট যদি নিশ্চিত ও নির্বিঘ্ন করা যায় তবে মৃত্যু অনেক কমে যাবে। যদি কোনো কারণে অক্সিজেন সরবরাহ বিঘ্নিত হয়, তবে বড় বিপদ ঘটে যাবে।’

এই মেডিসিন বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘প্রতিটি করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে দিনে লাখ লাখ লিটার অক্সিজেন লাগছে, অনেক হাসপাতালেই এখন তাদের অক্সিজেন ট্যাংক দিনে দু-তিনবার করে রিফিল করতে হয়। তাতে সরকারের খরচও অনেক বেশি হচ্ছে। অথচ আমরা যদি প্রতিটি হাসপাতালে স্বতন্ত্র ও স্বয়ংক্রিয় অক্সিজেন প্লান্ট স্থাপন করতে পারি, তবে সরকারের খরচও বহুভাগ কমে যাবে আর কোনো ঘাটতির চিন্তা থাকবে না।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ও মিডিয়া সেলের প্রধান অধ্যাপক ডা. নাসিমা সুলতানা  বলেন, ‘হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে করোনা আবার বাড়তে পারে, আমরা সেই চিন্তা মাথায় রেখে এগোচ্ছি। তবে জনবলসংকট কাটানো অনেকটাই জটিল ব্যাপার। বিশেষ করে আইসিইউয়ের জন্য অপরিহার্য অ্যানেসথেটিস্ট আমাদের দেশে কখনোই পর্যাপ্ত ছিল না। এই বিষয়ে পড়াশোনায়ও আগ্রহ কম। কারণ এই বিভাগের বিশেষজ্ঞরা মনে করে থাকেন, তাঁরা অন্য চিকিৎসকের মতো সমান মর্যাদা পান না, বরং তাঁদের সাধারণত সার্জারির চিকিৎসকদের ওপর নির্ভরশীল থাকতে হয় বেশির ভাগ সময়। তবে এখন চেষ্টা চলছে বিভাগটিকে আরো শক্তিশালী করার। এ ছাড়া জনবলসংকটের আরেক বড় কারণ হচ্ছে প্রতিবছর জানুয়ারি ও জুলাইয়ে চিকিৎসকদের একটি বড় অংশ উচ্চশিক্ষার ছুটিতে থাকে। এটা চিকিৎসকদের অধিকারও। কিন্তু তাঁদের পদগুলোতে তো আর অন্য কাউকে নিয়োগ দেওয়া যায় না। এ ছাড়া নিচের দিকে টেকনোলজিস্ট বা সহায়ক কর্মীদের ক্ষেত্রে আবার বড় ঝামেলা থাকে আইনগত নানা জটিলতার কারণে। এ ছাড়া কখনোই শতভাগ পদে নিয়োগও দেওয়া হয় না।’

তবে সব বিশেষজ্ঞ ও কর্মকর্তা সবচেয়ে জোর দিয়ে বলেছেন, অন্য যা কিছুই থাকুক আর না থাকুক, এখন পর্যন্ত করোনা প্রতিরোধে প্রধান ঢাল হচ্ছে মাস্ক এবং তার পরই টিকা।

জাতীয় কমিটির সভায় নতুন সুপারিশ

সরকারের কভিড-১৯সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির গত বুধবারের সভায় বলা হয়, ভারত থেকে আসা ১০ জন সংক্রমিত ব্যক্তি হাসপাতাল থেকে পালিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। তাদের চলাচলের সময় তারা যাদের সংস্পর্শে গেছে তাদের চিহ্নিত করে কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করতে বলা হয়েছে। একই সঙ্গে উচ্চ সংক্রমণশীল যেকোনো দেশ থেকেও বাংলাদেশে যাতায়াত বন্ধ বা সীমিত করা প্রয়োজন এবং ওই সব দেশ থেকে আসা যাত্রীদেরও ১৪ দিনের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা দরকার।

সভায় বলা হয়, করোনা টেস্টের জন্য প্রয়োজনীয় কিটের দাম প্রায় তিন হাজার টাকা থেকে কমে ৮০০-১০০০ টাকায় নেমে গেছে। তাই বেসরকারি পর্যায়ে টেস্টের ফি ১৫০০-২০০০ টাকার মধ্যে নির্ধারণের পরামর্শ দেওয়া হয়।

কমিটি করোনাকালীন সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের একটানা দায়িত্ব পালনের ক্লান্তি কাটাতে আরেক দল চিকিৎসক (নিউ সেট) প্রস্তুত করার সুপারিশ করেছে। লকডাউনের সময় চিকিৎসকদের যাতায়াত সহজ রাখা, মানসম্মত পিপিই পর্যাপ্ত সরবরাহ করা এবং তাঁরা তা পাচ্ছেন কি না, সেটা মনিটর করা প্রয়োজন বলে মতামত তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়, চিকিৎসক ছাড়াও অন্য জনবলের সংকট রয়েছে। ওই সভায় সরকারের কাছে নার্স নিয়োগেরও সুপারিশ করা হয়। কমিটির সভাপতি অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ সহিদুল্লাহ ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন।

কমিটি করোনা সংক্রমণ রোধে আরো কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা করার সুপারিশ দিয়েছে সরকারকে। বলা হয়, যদিও বাংলাদেশে সংক্রমণ এখন নিম্নমুখী তবু পার্শ্ববর্তী দেশের সংক্রমণের কারণে বাংলাদেশের অবস্থান পরিবর্তিত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অক্সিজেনের দিকে বেশি নজর রাখতে বলা হয়। এ ছাড়া সরকারি প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী বিভিন্ন হাসপাতালে করোনা আক্রান্ত গর্ভবতীদের সেবা কার্যক্রম দ্রুত বাস্তবায়ন, জেলার হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ এবং সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবস্থা বাড়ানো, জনবল তৈরিতে জোর দিতে বলা হয়।

 

সুত্রঃ কালের কণ্ঠ