শীতে বাংলার বিচিত্র রূপ

‘শীতের বনে কোন সে কঠিন আসবে ব’লে

শিউলিগুলি ভয়ে মলিন বনের কোলে।

আমলকী-ডাল সাজল কাঙাল, খসিয়ে দিল পল্লবজাল,

কাশের হাসি হাওয়ায় ভাসি যায় যে চলে।’

শীত এলে বাঙালির মনে কবিতার এ চরণগুলো মনে পড়বেই। পৌষ-মাঘ শীতকাল। এ সময় গ্রামবাংলা শীতের চাদর মুড়ি দেয়। কুয়াশায় ঢেকে যায় প্রতিদিনের ভোরবেলা। গ্রামবাংলায় নতুন ধানের গন্ধ ভেসে বেড়ায়।

শীতের এই ঋতুতে প্রায় সর্বত্র চলে নবান্ন উৎসব। অনেকেই বেড়াতে যান দেশের আকর্ষণীয় কোনো না কোনো স্থানে। এছাড়া মামাবাড়ি, দাদাবাড়ি, খালাবাড়ি বেড়ানোর মৌসুমও এই শীতকাল।

তাই এ সময় অন্তত একবার কোথাও না কোথাও বেরিয়ে পড়তে না পারলে মনের অনুশোচনা যে ঘোচে না। শীতে উত্তরের জনপদ ঠাকুরগাঁওয়ে কুয়াশা চাদর গায়ে দিয়ে আসে। পৌষে ঠাকুরগাঁও গেলে শীত কাকে বলে তা হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যায়। হিমালয়ের আদুরে স্পর্শে লালিত জনপদ এই ঠাকুরগাঁও। টাংগন নদীতীরে এক সুন্দর সাজানো-গোছানো শহর।

ঠাকুরগাঁওয়ের আকর্ষণ টাংগন নদী, এর উপরে রয়েছে ব্রিজ। নাম তার টাংগন ব্রিজ। বলাকা উদ্যান নামে পিকনিক কর্নারও রয়েছে সেখানকার খোঁচাবাড়িতে। বিকাল হতে না হতেই সেখানে শীত জেঁকে বসে। এদিকে সকাল ১০টা বাজলেও কুয়াশা কাটে না।

পড়ন্ত বিকালে নদীতীরে এসে টাংগনকে বড় আপন করে পাওয়া যায়। তখন কি মনে পড়বে না- ‘হে সন্ন্যাসী, হিমগিরি ফেলে নিচে নেমে এলে কিসের জন্য। কুন্দমালতী ঝরিছে মিনতি, হও প্রসন্ন’- কবিতার এই চরণগুলো! প্রকৃতি প্রেমিকের কাছে এটাই তো স্বাভাবিক।

ঠাকুরগাঁও থেকে বেশি দূরে নয় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া। এর পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মহানন্দা নদী। ওপারে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ। মহানন্দা তীরের ডাকবাংলোটি দেখার মতো। নির্জন-নিরিবিলি এই তেঁতুলিয়ায় পৌষ-মাঘে তীব্র শীত পড়ে।

ডাকবাংলোটি দেখে অভিভূত না হয়ে পারা যায় না। এর নির্মাণকৌশল অনেকটা মধ্যযুগীয় জমিদার বাড়ির মতো। সেখানে রয়েছে স্বাধীনতার এক স্মৃতিসৌধ। তেঁতুলিয়ার উত্তরে বাংলাদেশের শেষ সীমান্তে বাংলাবান্ধা। সেখানে রাত্রিযাপন করার জন্য রয়েছে ডাকবাংলো। বাংলাবান্ধায় গিয়ে দূরের হিমালয়কে অনেকটা স্পষ্টভাবে দেখা যায়।

শীতে উত্তরের আরেক জনপদ নীলফামারীও বেশ আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। নীলফামারী পৌঁছে শীতকে বড্ড আপন করে পাওয়া যায়। নীলফামারীর অন্যতম আকর্ষণ নীল সাগর। নীলফামারী রেলস্টেশন থেকে ১৪ কিলোমিটার দূরে এই নীল সাগর।

এটি বিরাট এক দিঘি। নীলফামারীর সর্ব উত্তরে চিলাহাটি। সেখানে ট্রেনে যাওয়া যায়। শীতে চিলাহাটির সবুজ-শ্যামল রূপ মনকে আন্দোলিত করে।

দেশের দক্ষিণে বরিশালের বাখেরগঞ্জ থানার কয়েক মাইল দূরে লোহালিয়া নদী আর এর ওপারেই পটুয়াখালী। সেখানকার প্রধান আকর্ষণ পায়রাকুঞ্জ, কৃষি কলেজ আর দ্বীপাঞ্চল।

পটুয়াখালীর বাউফল, আমতলী, কুয়াকাটা, গলাচিপা, মির্জাগঞ্জ, খেপুপাড়া- যেদিকে পা দেবেন, সেদিকেই শীতের পরশ খুঁজে পাবেন।

শীতে গোটা বাংলার রূপ যেন হিমেল হাওয়ার ছোঁয়া দিয়ে যায়। বছর ঘুরে শীত পেয়ে প্রকৃতি প্রেমিকের মনে পড়ে ‘পৌষ তোদের ডাক দিয়েছে, আয় রে চলে, আয় আয় আয়’ গানের এই কথাগুলো।

শীতের ক্ষণে বাংলার রূপে মুগ্ধ হয়ে হয়তোবা বলবেন, ‘সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে/সার্থক জনম, মা গো, তোমায় ভালোবেসে।’

লিয়াকত হোসেন খোকন : প্রাবন্ধিক

 

সুত্রঃ যুগান্তর