শিক্ষায় ভ্রান্তি বিনাশ থেকে ভ্রান্তি বিলাস

ব্রিটিশ অধিকৃত অবিভক্ত বঙ্গদেশ থেকে শুরু করে ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর প্রথমে পূর্ববঙ্গ, অতঃপর পূর্ব পাকিস্তান নামের ভূখণ্ডে একাধিক শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। তখনকার সরকার শিক্ষা কমিশন গঠন করে দৃশ্যত শিক্ষার উন্নয়নের জন্য। আসলে উন্নয়নের নামে নিজেদের অভিসন্ধি পূরণের উদ্দেশ্য থাকায় জনগণ আশানুরূপ উপকৃত হয়নি। শিক্ষার অর্থ তো মগজে স্তূপীকৃত জ্ঞান নয়, বিকশিত মানসলোক তৈরি। তখন শুধু বাইরের দিকটি দেখা হয়েছে, এ নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি।

জেনারেল আইয়ুব খান পূর্ববঙ্গকে পাকাপোক্তভাবে প্রায় করদরাজ্য করার লক্ষ্যে (ছাপ্পান্নর সংবিধান অনুসারে) পূর্ববঙ্গের নাম বদল করে নতুন নাম দিলেন পূর্ব পাকিস্তান। এরপর নানা দুরভিসন্ধি তৈরি হতে থাকে। ১৯৫৯ সালে পেশকৃত শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ১৯৬০ সালে অনুমোদিত হলে ১৯৬২ সালে তা কার্যকর করার অধ্যাদেশ জারি হয়। পূর্ব পাকিস্তানের তরুণ ছাত্রসমাজ কমিশনের কূটকৌশল আঁচ করে আন্দোলন গড়ে তোলে, যার চূড়ান্ত রূপ প্রতিফলিত হয় ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৬২।

বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে রক্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের এক দশকের মধ্যেই বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন। এসবের এক দশকের মধ্যেই নিজেদের অস্তিত্বের আবাসভূমির প্রতিষ্ঠা। একুশ, ১৭ সেপ্টেম্বর, একাত্তরজুড়ে আমরা যত রক্ত দিয়েছি তার খতিয়ান দিতে বসিনি। পথচলার বাঁকে বাঁকে ‘কী পাইনি তার হিসাব মেলাতে’ আমরা যাব না। শুধু ফিরে দেখব আমাদের স্বকৃত ব্যর্থতা।

বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষা সংস্কারের নামে মুক্তচিন্তার সংকোচন এবং ডিগ্রির পর্যায়কে এক বছর প্রলম্বিতকরণ। অর্থাৎ দুই বছর থেকে তিন বছর করা। শিক্ষা কমিশনে কিছু ক্লাসিক ভাষা তুলে দিয়ে এবং পৃথকভাবে ইতিহাস, ভূগোল ইত্যাদি পাঠের পরিবর্তে সমন্বিতভাবে সমাজবিজ্ঞান পাঠের বাধ্যবাধকতার বিধান রাখা হয়েছিল। আগের শিক্ষার্থীরা বাধ্যতামূলক বাংলা-ইংরেজি ছাড়াও অপর একটি ক্লাসিক ভাষা; যেমন—আরবি, ফারসি, সংস্কৃত, উর্দু, পারসি ইত্যাদি ভাষা সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারত। নতুন পাঠক্রমে ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হলো। আরবি-সংস্কৃত না জানলে ইসলাম ও সনাতন ধর্মের মৌলিক বিষয়গুলো জানা কঠিন হয়। উদ্দেশ্য মূর্খ মৌলবাদী সমর্থক তৈরি করা। দৃশ্যত এই সুপারিশে মনে করা হলো, শিকড় কেটে কাণ্ডে জল ঢালার মতো। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সংস্কৃত, ফারসি, উর্দু, আরবি বিষয়ে অনার্স-মাস্টার্স, এমনকি পিএইচডি ডিগ্রি বিতরণের সুযোগ বহাল থাকল।

ইতিহাস-ভূগোল পৃথক পাঠ্য বিষয় থাকায় জগতের এগিয়ে চলা এবং পৃথিবীর অবস্থান সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের জানা সহজ হতো। তা বন্ধ হয়ে গেল, এখনো বন্ধ আছে। এখানেও দেখা যাচ্ছে, ইতিহাস-ভূগোলে উচ্চশিক্ষা চালু আছে। অনেকেই মনে করেন, এসব বিষয়ে আগের মতো মেধাবীরা আকর্ষণ অনুভব করছেন না। যাঁরা বেরিয়ে আসছেন, তাঁরা গড়পড়তা; যার সূচনা বাষট্টি থেকে। তবে কিছু অসাধারণ ব্যতিক্রমও আছে, যারা দূরবীক্ষণীয়।

বিচিত্রমুখী জ্ঞানের যেটুকু সুযোগ ছিল, তা আর থাকল না। শিক্ষার্থীরা এই আসল বিষয়টির চেয়ে ওই তিন বছরের ডিগ্রি পরিক্রমকে আবার দুই বছরে নামিয়ে আনার আন্দোলন জোরদার করে, যেন ‘শর্টকাটে’ সনদ পাওয়া যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে সরকার শিক্ষার্থীদের অপ্রয়োজনীয় দাবি মেনে নিল। বিপুল শিক্ষার্থী পরীক্ষা না দিয়ে ডিগ্রি পেয়ে গেল। এ যে আপাতমধুর, তা আর বুঝল না। একসময় তাদের অটো গ্র্যাজুয়েট বলে বাঁকা চোখে দেখা হতো। অবশ্য তা যে সর্বনাশা ছিল, তা বোঝেনি।

ডিগ্রি দুই বছরে সমাপ্ত করার সুযোগ পেল শিক্ষার্থীরা, তবে ৩০০ নম্বর ইংরেজি উধাও হয়ে গেল। ইংরেজি জানা ডিগ্রিধারী মানুষ কমতে থাকল। এর ধারাবাহিকতা বজায় আছে এখনো। একদা এন্ট্রান্স পাস করেই ব্যারিস্টারি পড়ার সুযোগ হতো। এখন তথাকথিত এমএ পাস করে আমাদের অগ্রগতি কতটুকু? যে ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছি আর যে ভাষার পথ ধরে স্বাধীনতা পেয়েছি—সেই ভাষাকে আমরা মর্যাদাহীন করে তুলছি।

আমরা আরোপিত শিক্ষা আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে পথ হারিয়ে ফেলছি না তো! স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পার করছি আমরা। দৃশ্যমান উন্নতি আমাদের কম হয়নি। তবে যে ভাষা ও শিক্ষা আন্দোলন আমাদের কল্পলোকের অস্তিত্বকে বাস্তবে রূপ দিয়েছে, তার স্বরূপের ভাবনা কি আমাদের মাথায় এসেছে?

লেখা বাহুল্য, শিক্ষার পুরোধা যথার্থ শিক্ষক। বিষয়টি দুর্ভাগা দেশে মূল্য দেওয়া হয় না। একদা সরকারি-বেসরকারি চাকরির আকালের দিনে অনেক শিক্ষিত মেধাবীকে শিক্ষকতায় আনা হতো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এখন শিক্ষকতায় কাউকে আনতে হয় না। শ্রমহীন কাজে সনদপ্রাপ্তরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভিড় জমান। খালি পাত্রের খয়ের খাঁ মেকিরা মুরব্বি ধরে রাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় সমাসীন হচ্ছেন। অথচ এখান থেকেই দেশপ্রেম আর মুক্তচিন্তার বিকাশ হওয়ার কথা। বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনের নেপথ্যের মহৎ উদ্দেশ্য তা-ই ছিল। তার কতটুকু প্রতিফলন ঘটেছে। আমাদের শিক্ষা আন্দোলনের আদর্শ লজ্জায় মুখ ঢাকছে।

একদা যাঁরা শিক্ষা আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ শিক্ষকতায় এসেছেন, তাঁরা অতীত বেমালুম ভুলে গেছেন। আর শিক্ষক নিয়োগ কর্মকাণ্ডে যাঁরা যুক্ত, তাঁরা জাতীয় স্বার্থ ভুলে ক্ষমতার স্বার্থে ঘুরপাক খাচ্ছেন। দেখা যাচ্ছে, কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সেরা মেধাবীকে উপেক্ষা করে তোষণমূলক গড়গড়তাকে গদিনশিন করা হচ্ছে। এর পরিণতি যে শুভ হয় না, তার পরীক্ষা বহুবার হয়ে গেছে। শিক্ষা দিবস আমরা স্মরণ করব ভ্রান্তি বিনাশের জন্য, ভ্রান্তি বিলাসের জন্য নয়। তবু এসব ফিরে দেখার মাধ্যমে মাঝেমধ্যে যদি শুভবোধের উদয় হয়, সেখানেই সান্ত্বনা।

লেখক : সাবেক শিক্ষক, রাজশাহী কলেজ

 

সূত্রঃ কালের কণ্ঠ