লিখিত পরীক্ষায় ফিরছে নতুন পাঠ্যক্রম

সিল্কসিটি নিউজ ডেস্ক

অভিভাবকদের ক্ষোভ সামাল দিতে নতুন পাঠ্যক্রমে লিখিত পরীক্ষায় ফিরছে মূল্যায়ন পদ্ধতি। ৫০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হবে। বাকি ৫০ নম্বরের এক্সার্সাইজ হবে। তবে পরীক্ষা মানে গতানুগতিক প্রশ্নের উত্তর লিখতে হবে না। পাঠ-এক্সার্সাইজ থেকে লিখতে হবে সৃজনশীল অনুধাবন করে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত ‘শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্তকরণ সংক্রান্ত কমিটি’র সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে।

নতুন শিক্ষাক্রমের পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার পর মাধ্যমিক পরীক্ষায় লিখিত অংশে নম্বর বাড়ানো হচ্ছে। নতুন পাঠ্যক্রমে পরীক্ষা নেই, নম্বর নেই। শিক্ষার্থীরা কিছু শিখছে না। লেখাপড়া থেকে দূরে সরে যাচ্ছে ছেলেমেয়েরা- এমন সব অভিযোগ অভিভাবকদের। এই পাঠ্যক্রমের বিরোধিতা করে সোস্যাল মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনা করেছেন। প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশ পর্যন্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আটকও হয়েছেন কয়েকজন অভিভাবক। এরপর শিক্ষাক্রম বাস্তবায়ন ও মূল্যায়ন পদ্ধতি চূড়ান্ত করতে এই কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।

জানা গেছে, এসএসসির মূল্যায়ন পদ্ধতি ঠিক করতে গঠিত উচ্চপর্যায়ের কমিটি ‘লিখিত পরীক্ষায়’ ৫০ শতাংশ নম্বর রাখার সুপারিশ প্রস্তুত করেছে।

এতে বলা হয়েছে, নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে ৫০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং বাকি ৫০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। তবে সরকারের কর্মকর্তারা বলছেন, লিখিত অংশ থাকলেও সেটি আগের পরীক্ষার মতো হবে না।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (শিক্ষাক্রম) অধ্যাপক মো. মশিউজ্জামান বলেন, পরীক্ষা না রাখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত থাকলেও অভিভাবকদের চাপে লিখিত পরীক্ষা রাখা হচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষা বলতে এমন একটা অবস্থা হয়ে গেছে যে কে কত ভালো কে কত খারাপ- সেটা নির্ধারণ করা হয়। আসলে ব্যাপারটা মোটেও তা না। মূল বিষয় হচ্ছে, শিখন যাচাই করা। কে কতটুকু শিখেছে বা শিখতে পারেনি। আমরা এটিকে মূল্যায়ন বলছি। আমাদের এখানে একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতা আমাদের সমস্ত কিছু নষ্ট করে দিচ্ছে। আমরা এটিকে মূল্যায়ন বলেছিলাম, মানুষকে প্রতিযোগিতার মনোভাব থেকে বের করার জন্য। কিন্তু যেহেতু এখন সবারই পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা, তাই এটিকে পরীক্ষাই বলছি। সবার যে ডিমান্ড ছিল, সেটা আমরা পূরণ করছি। নতুন শিক্ষাক্রমে দশম শ্রেণি শেষে যে পাবলিক পরীক্ষা রাখা হচ্ছে সেটির নাম সেকেন্ডারি স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষাই (এসএসসি) রাখা হচ্ছে।

অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, ১০টি বিষয়ের এসএসসি পরীক্ষা হবে। ৫০ শতাংশ হবে বছরজুড়ে শিখনকালীন মূল্যায়নে আর ৫০ শতাংশে হবে লিখিত পরীক্ষা। এই লিখিত পরীক্ষা দুই ভাগে নেওয়া হবে। প্রথম ভাগ সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত হবে। সেখানে পারদর্শিতা যাচাই করা হবে, সেজন্য তাকে কিছু টাস্ক দেওয়া হবে।

কাজগুলো করার পরে এক ঘণ্টার একটি বিরতি থাকবে। তারপর সে পরীক্ষার হলের মতো বসে পরীক্ষা দেবে। সে তিন ঘণ্টায় যা করেছে সেটার ভিত্তিতে সে লিখবে। কাজটা কীভাবে করল, সেটা থেকে তার ফাইন্ডিংসে কী আসল- সেটা সে লিখবে। এই পরীক্ষাটা সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টায় হবে।

অন্য শ্রেণিতে মূল্যায়ন কীভাবে

নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না। তাদের শতভাগ শিখনকালীন মূল্যায়ন করা হবে। চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে ৬০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং ৪০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে। বাকি বিষয়গুলোতে শিখনকালীন শতভাগ মূল্যায়ন করা হবে। এই শ্রেণিগুলোতে ষান্মাসিক ও বার্ষিক পরীক্ষার মাধ্যমে হবে সামষ্টিক মূল্যায়ন।

নবম ও দশম শ্রেণিতে বাংলা, ইংরেজি, গণিত, বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে ৫০ শতাংশ শিখনকালীন মূল্যায়ন এবং বাকি ৫০ শতাংশ সামষ্টিক মূল্যায়ন করা হবে।

এ ছাড়া জীবন ও জীবিকা, ডিজিটাল প্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, ধর্ম শিক্ষা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি বিষয়ে শতভাগ মূল্যায়ন করা হবে। দশম শ্রেণি শেষে দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ওপর পাবলিক পরীক্ষা হবে।

নতুন শিক্ষাক্রমে একজন শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন নম্বর বা গ্রেডের পরিবর্তে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ ও বৃত্ত ব্যবহার করে করা হবে। ত্রিভুজ হচ্ছে সবচেয়ে ভালো, বৃত্ত হচ্ছে মোটামুটি ভালো এবং চতুর্ভুজ অর্থ উন্নতি প্রয়োজন। এনসিটিবির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, নৈপুণ্য অ্যাপের মাধ্যমে হবে মূল্যায়ন।

তিনি বলেন, সারা বছরে যে ফলাফল হবে, বোর্ডের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফলটাও যুক্ত হয়ে মূল রেজাল্ট হবে। শিক্ষার্থীদের ফলাফলে আইকনগুলোর নিচে একটি মন্তব্য লেখা থাকবে। যেটা থেকে ওই বাচ্চার অগ্রগতি বা অবনতি বোঝা যাবে। কিন্তু অ্যাপে এতকিছু লেখার সুযোগ নেই। অ্যাপে আইকনগুলোই থাকবে।

তবে অভিভাবকদের এমন প্রতীকী মূল্যায়ন নিয়েও আপত্তি ছিল। এ বিষয়ে কমিটির একজন সদস্য জানান, এর বিকল্প তারা খুঁজে পাচ্ছেন না। অভিভাবকদের মনস্তাত্ত্বিক প্রতিযোগিতা থেকে বের হতে হবে- এ জন্য আক্ষরিক নম্বরভিত্তিক ফল থেকে মুক্তি মিলবে। অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্য কোচিং প্রাইভেট নিয়ে দৌড়ঝাঁপ করছেন অভিভাবকরা।

নতুন কমিটির সুপারিশে এখনো পরীক্ষা সময় নির্ধারণ নিয়ে মতৈক্য রয়েছে বলে জানা গেছে। কেউ বলছেন পাঁচ ঘণ্টার পরীক্ষা। কেউ চাচ্ছেন তিন ঘণ্টার পরীক্ষা হবে কেন্দ্রে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক ফরহাদুল ইসলাম বলেন, বলা হচ্ছে পাঁচ ঘণ্টায় এসএসসি পরীক্ষা হবে। কিন্তু সেটা আসলে চাহিদার ওপর নির্ভর করে। কোনো বিষয়ের পরীক্ষা দুই ঘণ্টায়ও হয়ে যেতে পারে। সর্বোচ্চ পাঁচ ঘণ্টার কথা বলা হচ্ছে।

উল্লেখ্য, নতুন কারিকুলামের উল্লেখযোগ্য বিষয়সমূহ- বাতিল হচ্ছে সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতি। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা থাকছে না। প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী ও জেএসসি-জেডিসি পরীক্ষা থাকছে না। প্রাথমিক শ্রেণিতে সবার জন্য ৮টি বই এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে ১০টি বই পড়তে হবে। শুধু এসএসসিতে গিয়ে প্রথম পাবলিক পরীক্ষা হবে। এসএসসি পর্যায়ে কোনো বিভাগ থাকবে না। একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির দুইটি পাবলিক পরীক্ষার সমন্বয়ে ফলাফল হ্ওয়ার কথা রয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সাপ্তাহিক ছুটি থাকবে দুইদিন (শুক্র ও শনিবার)।