লকডাউন শিথিল: স্বাস্থ্য না অর্থনীতি? আমাদের করণীয় ।। সিরাজুল ইসলাম


গত প্রায় চার মাস থেকে চিনের উহান শহর থেকে শুরু করে (৫০ থেকে ২০০ ন্যানোমিটার আকারের) করোনা ভাইরাস সংক্রমণে আজ সমগ্রবিশ্বের প্রায় সকল মানুষ সেচ্ছায়/ভয়ে/ বাধ্য হয়ে নানবিধ কোয়ারেন্টাইন/আইসোলেশনে রয়েছে। সমগ্রবিশ্ব আজ একত্রিত করোনা মোকাবেলা জন্য। মাত্র কয়েক মাসের ব্যবধানে থমকে গেছে সকল যুদ্ধ। নেই কোনো সংহিসতা (যদিও পারিবারিক সংহিসতা বেড়েছে)।

এই সাম্যবাদী ভাইরাসের ভয়াবহতায় বিশ্বের বড় বড় নেতরা ট্রাম্প, পুতিন, কিম, জিনপিং মোদী সকলে আজ কুপোকাত, নেই কোন রাজনৈতিক মিটিং মিছিল, এদশের সকল মাস্তান, টপটেরর, গডফাদার সকলেই হোম কোয়ারেন্টাইনে অথবা স্বেচ্ছায় গৃহে। পশ্চিমা বিশ্ব সর্ব্বোচ্চ প্রযুক্তির ব্যবহার করেও লাশের মিছিল থামাতে পারছেনা, ভেঙ্গে পরছে স্বাস্ব্য ব্যবস্থা ও অর্থনীতি, রেড়েছে দারিদ্যতা; হাহাকার করছে অনুন্নত দেশের শ্রমিকশ্রেণী , দিনমজুর , ছিন্নমূল ও নিম্নআয়ের মানুষ।

দাবি করা হচ্ছে যে, একদিকে পরিবেশ মারাত্বক উন্নতি হয়েছে। অন্যদিকে লকডাউনে নানাভাবে সমস্যায় পড়ছে মানুষ। আমাদের দেশে কভিড-১৯ এর চেয়ে নন কোভিড রোগী বেশি মারা যাচ্ছে। কোভিড আক্রান্তদের নানবিধ সামাজিক আক্রামণের স্বীকার হতে হচ্ছে।

বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, নিকট ভবিষ্যতে কারোনা মহামারি নিরাময় সম্ভব না। যদি কভিড-১৯ খুব তাড়াতাড়ি বিশ্ব থেকে বিদায় না হয়, তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়- স্বাস্থ্য না অর্থনীতি কোনটা জরুরি? অর্থনীতিকে চালু রাখতে ইতমধ্যে কিছু দেশ লকডাউন শিথিলের কাজ শুরু করছে। বিভিন্ন দেশ কভিড-১৯ এর টিকা আবিস্কার করছে। তবে পরীক্ষা শেষে সকল দেশের জনগোষ্ঠীকে এর প্রয়োগ বেশ সময়সাপেক্ষ বিষয়।

যে কারণে কম সংক্রমণমাত্রা বাংলাদেশে:
এ পর্যন্ত যে সকল ধারণা আমাদের দেশে আলোচিত বা সমালোচিত হয়েছে যেমন – বেশিমাত্রায় সংক্রমণের জন্য আবহাওয়া একটা বড় বিষয়। বর্তমানে একটু গরম ও হিউমিডিটি বেশি। সাধারণত ২৪ থেকে ৩০ এর তাপমাত্রায় এর সংক্রমণ কম ঘটে। আমাদের দেশের বেশিরভাগ লোক এসিতে থাকে না। অধিকাংশ মানুষ শ্রমজীবি ও মাঠে ঘাটে কাজ করে। আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের বিসিজি টিকা দেওয়া হয়েছে। মোট জনসংখার মধ্যে কর্মক্ষম জনসংখ্যা বেশি। কোন কাজ না থাকলেও ঘড়ে বসে থাকা মোটেই পছন্দ করে না। যে কারণে ভিটামিন –ডি এর অভাব নেই ও প্রাকৃতিকভাবে এদেশের মানুষের ইমিউনিটি বেশি। যে কারণে আক্রান্তের হার বাড়লেও কম লোকের হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয়।

বেচে থাকার উপায় কি?
বর্তমান পরিস্থিতিতে সঠিক পরিকল্পনার সমন্বয়ের অভাব। ঠিকমত স্বাস্থ্য সেবা পাচ্ছে কিনা, কীট আছে কিনা, পিপিই মানসম্মত কিনা, টেস্ট সঠিক করা হচ্ছে কিনা, সঠিক তথ্য পাচ্ছে কিনা, ত্রাণ চুরি ও বিতারণে সমন্বয়ের অভাব , মার্কেট ও গারমেন্টস খোলা সঠিক কিনা, করোনা নিয়ে বিভিন্ন বিভাগের মধ্যে সমন্বয়হীনতা, নানবিধ প্রশ্ন রয়েছে। যার গঠনমূলক সমালোচনা ভাল এবং এর ফলে সরকার যথাযথ পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হবে।

অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ধীরে ধীরে লকডাউন/ ছুটি তুলে নিতে হবে, কর্মস্থলে যেতে হবে, স্কুল/কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দিতে হবে, বাজারে যেতে হবে, কারখানা খুলে দিতে হবে, নামাজ পড়তে মসজিদে যেতে হবে; ব্যাংকে যেতে হবে- এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো কোন ধরণের উপসর্গ নেই এমন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তি আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াবে ও সংক্রমিত করবে ব্যাপকভাবে। যার বড় প্রভাব পড়বে পরিবারের বয়স্ক লোকদের উপর।

করোনা থাকবে, কিভাবে আমাদের চলতে হবে ও বাঁচতে হবে –?

আমাদের প্রাকৃতিক উপায় আমাদের যোগ্যতম করে তুলতে হবে। সকল প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ মুখে হাত পরিস্কার করার ব্যবস্থা করতে হবে। টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে ননকোভিড রোগের চিকিৎসা দিতে হবে। সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে অসহায় মানুষের পাশে থাকতে হবে। মোট কথা সমাজ ও দেহকে কার্যকরী করে রাখতে হবে।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, মাস্ক পরতে হবে। সামাজিক দূরত্ব মানতে হবে (আমাদেও মত দেশে নিম্নশ্রেণী ও দিনমজুর এর ক্ষেত্রে অবাস্তব ভাবনা)। ঘন ঘন হাত পরিস্কার করতে হবে। হ্যান্ড সেনিটাইজার ব্যবহার করা, নিজে ও পরিবারের অন্যদের ইমিউনিটি বাড়াতে হবে; নিয়মিত কমপক্ষে ৩০ মিনিট ব্যায়াম করতে হবে। মানসিক শান্তি বজায় রাখতে হবে। বাড়িতে কোন ধরনের মানসিক আশান্তি সৃষ্টি করা যাবে না। পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। প্রতিদিন কমপক্ষে ২০ মিনিট রোদে থাকতে হবে। ভিটামিন সি ও ডি যুক্ত খাবার বেশি করে গ্রহণ করতে হবে। গরম পানি ও চা খেতে হবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিধি মানতে হবে। অভ্যাসের পরিবর্তন করে সাহস রাখতে হবে। ভয় নয়, অভ্যাসের পরিবর্তন, সচেতনতা ও সাহসের মাধ্যমে এই বিশ্ব মহামারিকে জয় করতে হবে।

লেখক: শিক্ষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।