রেল উন্নয়ন প্রকল্পের গোড়ায় গলদ

‘ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে ৩য় ও ৪র্থ ডুয়েল গেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ’ প্রকল্প ৮ বছর আগে অনুমোদন পেয়েছে। এ দীর্ঘ সময়ে রেলপথ নির্মাণে বিশদ নকশা, টেন্ডারিং সার্ভিসসহ মূল কাজের অনেকগুলোই হয়নি।

আর সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে মাত্র ৩৬ শতাংশ। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে প্রকল্পটির গোড়াতেই গলদ রয়েছে- এমন মন্তব্য সংশ্লিষ্টদের।

এ পর্যায়ে এখন চুক্তির বাইরে নতুন করে অতিরিক্ত অর্থ দাবি করছে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাড়তি অর্থ দেয়ার বিধান আছে কিনা- তা খতিয়ে দেখছে রেলপথ মন্ত্রণালয়।

প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ইতোমধ্যেই একবার ২৫৮ কোটি ২ লাখ টাকা ব্যয় বাড়িয়ে সংশোধন করে ১ হাজার ১০৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা করা হয়েছে। ৩০ জুলাই অনুষ্ঠিত প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির সভায় উল্লিখিত জটিলতার বিষয়টি উঠে এসেছে।

বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এরকম একটি প্রকল্প নেয়ার আগে অবশ্যই সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হওয়ার কথা।

যদি সেটি হয়ে থাকে তাহলে এ পর্যায়ে এসে এত জটিলতা থাকবে কেন? অবশ্যই প্রকল্পটির ‘গোড়ায় গলদ’ ছিল। প্রথমেই যদি চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করা যেত তাহলে হয়তো এত বাড়তি সময় ও অর্থ লাগত না।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব মো. মোফাজ্জেল হোসেন শনিবার  বলেন, গোড়ায় গলদ বলা যাবে না। কেননা সম্ভাব্যতা যাচাই করেই প্রকল্পটি হাতে নেয়া হয়।

কিন্তু পরে বেশ কিছু বড় বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। যেগুলো সমাধানে আমি অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছিলাম। এমনকি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পর্যন্ত সিদ্ধান্তের জন্য যেতে হয়েছিল। সেসময় কিছু সমস্যা সমাধান হয়েছে। কিন্তু এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান।

এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নির্ধারিত সময়ে এটির বাস্তবায়ন শেষ হবে কিনা সেটি বলা যাচ্ছে না। কেননা করোনা মহামারীর কারণে এমনিতেই ৪-৫ মাস কোনো কাজই করা যায়নি। তার ওপর বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো তো রয়েছেই।

সূত্র জানায়, ‘ঢাকা-টঙ্গী সেকশনে ৩য় ও ৪র্থ ডুয়েল গেজ লাইন এবং টঙ্গী-জয়দেবপুর সেকশনে ডুয়েল গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ’ প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ছিল ৮৪৮ কোটি টাকা।

পরে প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ১ হাজার ১০৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে ২০৪ কোটি ১৭ লাখ টাকা এবং ভারতীয় ঋণ থেকে ৯০২ কোটি ৬৩ লাখ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে।

এছাড়া মূল অনুমোদিত প্রকল্পের মেয়াদ ছিল ২০১২ সালের জুলাই থেকে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। পরে মেয়াদ বাড়িয়ে ২০১৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।

এতেও বাস্তবায়ন না হলে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়। এখন আবারও নতুন করে ব্যয় ও মেয়াদ বৃদ্ধির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

১৭ আগস্ট জারি করা স্টিয়ারিং কমিটির সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, প্রকল্প পরিচালক ওই সভায় বলেছেন- প্রকল্পের আওতায় রেল লাইন নির্মাণ কাজের বিশদ ডিজাইন ও টেন্ডারিং সার্ভিস এবং সুপারভিশনের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয় ২০১৫ সালের ২ জুন।

পরামর্শক প্রতিষ্ঠান কাজ শুরু করেন ২০১৬ সালের ১৫ মার্চ। কিন্তু এ কাজ নির্ধারিত ৬ মাসের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। তাই পরামর্শক প্রতিষ্ঠান টাইম ওভার রানের জন্য অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেছে।

এ পর্যায়ে পরামর্শকের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তিতে এরূপ অতিরিক্ত অর্থ পরিশোধের সংস্থান বা সুযোগ রয়েছ কিনা, তা পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।

এছাড়া গত বছরের এপ্রিলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ) থেকে হরাইজন্টাল (অনুভূমিক) ও ভার্টিক্যাল (উল্লম্ব) ক্লিয়ারেন্স আপত্তি জানায়।

ফলে তুরাগ নদের ওপর টঙ্গী রেল সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ওই বৈঠকে প্রকল্প পরিচালক আরও জানান, মন্ত্রিপরিষদ সচিবের সভাপতিত্বে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করা হয়।

সেখানে তুরাগ নদের উপর নতুন দুটি সেতুর ক্ষেত্রে কমপক্ষে ২ মিটার উচ্চতার ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্সের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। ফলে নতুন দুটি সেতুর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে বিদ্যমান দুটি সেতুর ভার্টিক্যাল ক্লিয়ারেন্স বৃদ্ধিসহ সেতু দুটি ভেঙে পুনর্নির্মাণের প্রয়োজন দেখা দেয়।

এক্ষেত্রে বিদ্যমান সেতু দুটির পুনর্নির্মাণের জন্য পুনর্ডিজাইনের প্রয়োজন। এ বিষয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান পুনর্ডিজাইনের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এজন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠান অতিরিক্ত অর্থ দাবি করেছে।

এছাড়া অনুমোদিত ডিপিপিতে প্যাকেজ ডব্লিউডিআই এর নির্মাণ সময়কাল ২৪ মাস হলেও কাজের পরিধি বিবেচনায় দরপত্র তৈরির সময় এ প্যাকেজের মেয়াদ ২৪ মাসের পরিবর্তে ৩৬ মাস করা হয়েছে।

এ কারণে নির্মাণ কাজের সুপারিভিশনের মেয়াদ বড়ানো হয়। এক্ষেত্রে মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির সুযোগ আছে কিনা তা পরীক্ষা করে দেখা প্রয়োজন।

স্টিয়ারিং কমিটির সভার কার্যবিবরণী থেকে আরও জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে বিমানবন্দর স্টেশন ইয়ার্ড রিমডেলিংয়ের জন্য সিভিল এভিয়েশনের রেকর্ডভুক্ত ৫ দশমিক ৪৬ একর জমির প্রয়োজন।

এজন্য অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার সিদ্ধান্ত মতে, গত বছরের ২৫ আগস্ট ভূমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়েছে।

এছাড়া সেই জমিতে কাজ শুরুর জন্য অনুমতি চেয়ে প্রকল্প পরিচালক বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে গত বছরের ১০ জুলাই অনুরোধপত্র দেন।

এ বিষয়ে এখনও কোনো অগ্রগতি হয়নি। এর বাইরে বাংলাদেশ রেলওয়ের তেজগাঁও-ঢাকা-ক্যান্টনমেন্ট সেকশনে মহাখালী রেল ক্রসিং হতে ডিওএসএইচ হয়ে সেনামালঞ্চ অংশে এবং বনানী লেভেল ক্রসিং এলাকায় সেনাবাহিনী মেসের বাউন্ডারি ওয়ালের ভেতর পর্যন্ত ভূমি ব্যবহারের প্রয়োজন।

এ বিষয়ে ১১ মার্চ অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সভায় নেয়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী কার্যক্রম চলছে। খিলগাঁও রেল গেট হতে মালিবাগ রেল ক্রসিং পর্যন্ত অংশে বিদ্যমান আপ লাইনের দক্ষিণ পাশে এবং ডাউন লাইনের উত্তর পাশে রেলভূমিতে ৩য় ও ৪র্থ রেল লাইন নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।

কিন্তু সরেজমিন দেখা গেছে- তৃতীয় লাইনের জন্য নির্ধারিত জমিতে বিদ্যমান আপ লাইনের দক্ষিণ পাশ বরাবর ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের একটি রাস্তা রয়েছে।

এক্ষেত্রে রাস্তার একাংশ আবশ্যিকভাবে প্রয়োজন। ফলে সিটি কর্পোরেশনের সঙ্গে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করা হয়। সেখানে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল সেগুলোর বিষয়ে সিটি কর্পোরেশন থেকে এখনও লিখিত কোনো মতামত পাওয়া যায়নি।

এছাড়া টঙ্গী-ধীরাশ্রম-জয়দেবপুর সেকশনে বনমালা লেভেল ক্রসিং থেকে জয়দেবপুর রেল স্টেশন পর্যন্ত গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের একটি রাস্তা রয়েছে।

এটি রেলওয়ের জমিতে নির্মিত হওয়ায় অ্যামব্যাংকমেন্টসহ নতুন রেল লাইন নির্মাণ করা যাচ্ছে না। রাস্তাটি স্থানান্তরের বিষয়ে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনকে অনুরোধ জানানো হলেও কোনো উদ্যোগ নেয়নি গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন।

 

সূত্রঃ যুগান্তর