রেলে ১২ কোটি টাকার নিয়োগ বাণিজ্য! ঈদের ছুটিতে ফল

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

বাংলাদেশ রেলওয়েতে সহকারী স্টেশন মাস্টার (এএসএম) নিয়োগে নজিরবিহীন অনিয়ম-দুর্নীতি হয়েছে। এতে প্রায় ১২ কোটি টাকার বাণিজ্য হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশ্নপত্র ফাঁস, কোটা অগ্রাহ্য, রেজিস্টার না মেনে নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করাসহ নানাবিধ অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, ২৭০টি সহকারী স্টেশন মাস্টার পদের বিপরীতে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার পর গত ৩ জুলাই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ ২৫৭ জনের তালিকা ঈদের বন্ধের মধ্যে অনেকটা চুপিসারেই প্রকাশ করে নিয়োগ কমিটি।

প্রকাশিত ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, নিয়োগের ক্ষেত্রে জেলা কোটা মানা হয়নি। লিখিত পরীক্ষায় বেশি নাম্বার পেয়েও চাকরি হয়নি অধিকাংশ প্রার্থীর। অথচ লিখিত পরীক্ষায় নাম্বার কম পেয়েছে এমন প্রার্থীরাই চাকরিতে নিয়োগ পেয়েছে বেশি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, লিখিত পরীক্ষায় যারা ভাল করেছে তারা মৌখিক পরীক্ষায় খারাপ করার কথা নয়। কিছু ক্ষেত্রে হয়তো ব্যতিক্রম হতে পারে। লিখিত পরীক্ষা খারাপ করলেও মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মৌখিক পরীক্ষায় ভালো নাম্বার দিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, ফেনী জেলায় ৩ জনের স্থলে ৬ জন, রাজশাহী বিভাগে ৩৫ জনের কোটায় ৪০ জন ও খুলনা বিভাগে ৩২ জনের বিপরীতে ৩৩ জন, লক্ষীপুরে ৪ জনের বিপরীতে ১জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অনিয়মের মাধ্যমে বরিশালের জেলার লোকজনকে অন্য জেলায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এসব অনিয়মে কমিটির আহ্বায়ক রোকনুজ্জামান এবং সদস্য রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের ডেপুটি সিসিএম(ভাড়া) জাকির হোসেনের প্রত্যক্ষ হাত রয়েছে রেলওয়ের একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলানিউজকে জানিয়েছেন। অভিযুক্ত ওই দুই কর্মকর্তারই বাড়ি বরিশাল জেলায়।

তবে নীতিমালা মেনেই নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে বলে একবার দাবি করলেও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মো.আবদুল হাই এও স্বীকার করেছেন যে, বিষয়টি তিনি ভালোভাবে জানেন না।

নিয়োগ প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হওয়ার কিছুদিন আগে জিএম হিসেবে যোগ দিয়েছেন জানিয়ে আবদুল হাই বলেন, ‘বিষয়টি আমি ভালভাবে বলতে পারবো না, নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ভাল বলতে পারবেন।’

বিভিন্ন জেলায় কোটার অতিরিক্ত নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে মহাব্যবস্থাপক বলেন, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান জেলায় প্রার্থী না থাকায় পোষ্য কোটা সমন্বয় করতেই কয়েকটি জেলায় বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে রোকনুজ্জামানসহ রেলের আরও কয়েকজন কর্মকর্তা গত ১৮ জুলাই চীন সফরে গেছেন। তারই দেশে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন মহাব্যবস্থাপক।

তিনি বলেন, কমিটির আহ্বায়ক বিদেশ থেকে আসুক। অনিয়ম করে থাকলে সেটা দেখবো। তিনি আরও বলেন, নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে ভালভাবে জানতে হলে অফিসে আসতে হবে।

অন্যদিকে উঠেছে নিয়োগ পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের অভিযোগ। রেলের একাধিক শ্রমিক নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাহাড়তলী রেলওয়ে স্কুলে কেন্দ্রে যারা পরীক্ষা দিয়েছে তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই পাশ করেছে। অথচ অন্য কেন্দ্রের এ হার অনেক কম। তাদের অভিযোগ, এ কেন্দ্রে প্রার্থীদের আগেই প্রশ্নপত্র দেওয়া হয়েছিল।
অভিযোগকারীদের দাবি, যারা লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় পাশ করে নিয়োগ পেয়েছে তাদের কাছ থেকে আগের প্রশ্নে আবার পরীক্ষা নেওয়া হলে নিশ্চিত ফেল করবে। কারণ তাদের টাকার মাধ্যমে চাকরি হয়েছে।

এ বিষয়ে জিএম আবদুল হাই বলেন, তখন আমি ছিলাম না। প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় উচ্চ আদালতে মামলা হয়েছে বলে আমিও শুনেছি। তবে এখনো কোন আনুষ্ঠানিক অভিযোগ পাইনি।

রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, ২৫৭ জনের মধ্যে অন্তত ১২০ জনের কাছ থেকে গড়ে ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। সে হিসেবে অন্তত ১২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে নিয়োগ কমিটির কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা একটি চক্র।

দায়িত্বশীল সূত্র নিশ্চিত করেছে, নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ও পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত সিওপিএস মো. রোকনুজ্জামান, চিফ পার্সোনাল অফিসার অজয় কুমার পোদ্দার, কমিটির সদস্য সচিব সিনিয়র পারসোনাল অফিসার শেখ কামালসহ কমিটির পাঁচ সদস্য এই চক্রে রয়েছেন। আর নিয়োগ প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করে দিয়েছেন ওয়েলফেয়ার বিভাগের প্রধান সহকারী মামুন ও পাহাড়তলী অফিসের ট্রেন কন্ট্রোলার সাইদ হোসেন খোকন। এরমধ্যে মামুন উৎকোচের টাকা তুলেছেন রোকনুজ্জামানের হয়ে  এবং অজয় কুমার পোদ্দার ও সাইদ হোসেন কমিটির সদস্য জাকির হোসেনের হয়ে কাজ করেছেন। চাকরির প্রার্থীর সঙ্গে যোগাযোগ এবং টাকা সংগ্রহ তাদের মাধ্যমে হয়েছে। সর্বোচ্চ ১৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

সূত্র জানায়, মেধার ভিত্তিতে অর্ধশতাধিক নিয়োগ পেলেও বেশির ভাগ মোটা অংকের টাকা দিয়ে, আবার অনেকে মন্ত্রি-এমপি’র নাম ভাঙিয়ে এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির সুপারিশে নিয়োগ পেয়েছেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। তা নিয়ে এখন পূর্বাঞ্চল রেলওয়েতে তোলপাড় চলছে।

রেলের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, ২৫৭ জনের মধ্যে একজন প্রভাবশালীর সুপারিশে ৮৭ জনের নিয়োগ হয়েছে। এছাড়া পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের মহাব্যবস্থাপকের সুপারিশে ২৭ জন, সহকারী স্টেশন মাস্টার নিয়োগ কমিটির আহ্বায়ক ও পূর্বাঞ্চল রেলওয়ের অতিরিক্ত সিওপিএস মো. রোকনুজ্জামানের ২৭ জন এবং ওই কমিটির সদস্য সচিব পূর্বাঞ্চল রেলের পার্সোনেল অফিসার শেখ আবুল কালামসহ অপর তিন কর্মকর্তা ডিইএন-২ আবুল কালাম, জাকির হোসেন ও পশ্চিমাঞ্চলের এজিএম সুজিত কুমার ১০ থেকে ১৫ জন করে নিশ্চিত চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছেন ।

অভিযুক্তদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে তারা প্রথমে অভিযোগ অস্বীকার করলেও বাংলানিউজের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে চা খেতে বসার অফার দিয়েছেন।

সূত্র: বাংলানিউজ