রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়ক বর্ধিতকরণকাজে ব্যাপক অনিয়ম, জনদুর্ভোগ চরমে

নিজস্ব প্রতিবেদক:

কোথাও কার্পেটিং করার পর পরই রাস্তায় দেখা দিয়েছে ফাটল, কোথাও খোয়া ফেলে রেখে মাসের পার মাস জনদুর্ভোগ তৈরী করা হচ্ছে। আবার কোথাও নিম্নমাণের সামগ্রি দিয়ে হচ্ছে নির্মাণকাজ। কোনো অংশে কাজের মেয়াদ শেষ হতে চললেও ঠিকাদারের কোনো খোঁজ নাই। এভাবেই শম্বুক গতিতে চলছে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়ক বর্ধিতকরণকাজ। দীর্ঘদিন ধরে কাজ শেষ না হওয়ায় এই রাস্তার প্রায় সাড়ে ২১ কিলোমিটার অংশ এখন যেন দুর্ভোগের অপর নামে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এরই মধ্যে ঠিকাদারদের প্রায় ২৩৩ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। জনদুর্ভোগ চরম আকার ধারণ করায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছে সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের মাঝেও।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তার কার্পেটিং হতে না হতেই কোথাও কোথাও দেখা দিয়েছে ফাটল। যদিও এটি ছোট একটি অংশে দেখা দেয়। পরে দ্রুত সংস্কার করে নেন ঠিকাদার। কিন্তু কোথাও স্মবুক গতিতে কাজ করার চলার কারণে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কটি এখনোই দুর্ভোগের অপর নামে পরিণত হয়েছে। রাস্তাটির রাজশাহীর অংশেই সবচেয়ে অনিয়মের ছোঁয়া লক্ষ্য করা গেছে। নওহাটার পর থেকে একে বারে মান্দা পর্যন্ত রাস্তাটিতে শুধু খোয়া ফেলে রেখে চরম জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। নিম্নমাণের খোয়া ও পাথরগুলোও এরই মধ্যে উঠে যেতে শুরু করেছে। এতে করে রাস্তাটির কোথাও একটু পানিতে হাঁটু পানি, কোথাও কাদা পানি আবার বৃষ্টি শেষে ধুলা-বালিতে ভরে যাচ্ছে।

আবার নওগাঁ অংশের সাবাইহাট এলাকায় পাশাপাশি চারটি স্থানে গত কয়েকদিন আগে দেখা দেয় রাস্তায় ফাটল। কার্পেটিং শেষ হতে না হতেই এই ফাটল দেখা দেয়। এই অংশের কাজ করছেন সর্বোচ্চ চারটি কাজ পাওয়া ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান আমিনুল হক এন্টারপ্রাইজ। যদিও কাজ এখনো চলমান দাবি করেছেন ঠিকাদার আমিনুল হক। তিনি কালের কণ্ঠনে বলেন, ওই স্থানে অল্প একটু ফাটল দেখা দিলেও আমরা সেটি ঠিক করে দিয়েছি। কাজ এখনো শেষ হয়নি। আরেকটি কার্পেটিং হবে। কাজেই এই অবস্থায় ছোট-খাটো সমস্যা থাকতেই পারে। কাজ করতে গেলে এমন সমস্যা হতেই পারে। সেটি বড় কিছু নয়।’

নওহাটার বাসিন্দা সোলেমান হোসেন বলেন, ‘এই রাস্তা দিয়ে এখন যেতেই ভয় লাগে। কাজ শেষ না হওয়ায় কখনো ধুলা আবার কখনো কাদা-পানিতে একাকার হয়ে থাকে। এতে করে চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়তে হয়। রাজশাহীর এই অংশে এখন সহজে মানুষ এই রাস্তাটিতে যেতে চান না। তারা বিকল্প পথ বেছে নিচ্ছেন দূরের হলেও।’

স্থানীয় মোহনপুর এলাকার বাসিন্দা মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘যখন রাস্তাটির কাজ শুরু হয়, তখন থেকেই নানা অনিয়ম হচ্ছে। রাস্তায় ঠিকমতো বালু ও খোয়া দেওয়া হয়নি। নি¤œমাণের ইটের খোয়া দেওয়া হলেও ঢালাইয়ের পরিমাণও ছিল কম। এসব নিয়ে প্রতিবাদ করেও কোনো লাভ হয়নি। উল্টো ঠিকাদারের লোকজন নানাভাবে ভয়ভীতি দেখিয়েছে। ফলে কেউ আর প্রতিবাদ করতে সাহস পাইনি। এখন কাজ ফেলেই পালিয়েছে ঠিকাদার। যার কারণে কষ্ট পোহাতে হচ্ছে আমাদের। রাস্তার পাশে বাড়ি হওয়ায় ধুলা গিয়ে ঘরে ঢুকছে। আবার কাদা-পানিতেও রাস্তায় বের হওয়া যায় না বৃষ্টি হলে। এ কেমন রাস্তা হচ্ছে?’

রাজশাহী সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র মতে, প্রায় ৪৩৮ কোটি টাকা ব্যয়ে রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কটির ৭৮ কিলোমিটার বর্ধিতকরণ কাজ চলছে। ১২টি প্যাকেজে ভাগ করে এই কাজটির টেন্ডার আহ্বান করা হয়। এর মধ্যে চারটি কাজই পেয়েছেন আমিনুল হক এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। আর দুটি করে কাজ পেয়েছে রাজশাহীর ওয়াহেদ কন্সট্রাকশন, ডন কন্সট্রাকশন, ঢাকার কামাল এসোসিয়েট কন্সট্রাকশন এবং একটি করে কাজ পেয়েছে র্তূণা কন্সট্রাকশন ও প্যারাডাইস কন্সট্রাকশন। গত দেড় বছর ধরে এই কাজটি চলছে। রাজশাহী ও নওগাঁ সড়ক এবং জনপথ বিভাগের যৌথ তত্বাবোধায়নে এই কাজটি হচ্ছে। কিন্তু কাজ পেয়েও সামান্য কিছু অংশ করে কোনো কোনো ঠিকাদার হয়ে আছেন লাপাপাত্তা।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কটি ৭ দশমিক ৩ মিটার চওড়া থেকে ১০ দশমিক ৩ মিটার চওড়াকরণ কাজটি শুরু হয় প্রায় দেড় বছর আগে। এর মধ্যে দুটি প্যাকেজে কাজ করছেন ওয়াহেদ কন্সট্রাকশন নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। যার সত্তাধিকারী হলেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের নেতা ও বাস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুঞ্জুর রহমান পিটার। তিনি সর্বমোট দুটি প্যাকেজ প্রায় ৫০ কোটি টাকার কাজ করছেন। এর মধ্যে প্রায় ২৫ কোটি টাকা তিনি উত্তোলন করেছেন। তার দুটি কাজের মেয়াদ শেষ হবে চলতি এপ্রিলেই। কিন্তু এখন পর্যন্ত রাস্তা কার্পেটিং কাজের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তাঁ অংশে শুধুমাত্র খোয়া ঢালাই করে রেখে দেওয়ার কারণেই দুর্ভোগ দেখা দিয়েছে বেশি।

রাজশাহী সড়ক ও জনপথ বিভাগের একাধিক সূত্র মতে, ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এই ঠিকাদার কাজ পেলেও কাজটি শেষ করতে গড়িমশি করছেন। এতে করে রাজশাহীর অংশের প্রায় সাড়ে ২১ কিলোমিটার অংশে চরম জনদুর্ভোগ দেখা দিয়েছে। একটু বৃষ্টি হলেই কাদাপানিতে লেপ্টে যাচ্ছে গোটা রাস্তা। তখন ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। আবার সুষ্ক আবহওয়ায় ধুলা-বালিতে পথচারিদের নাক-মুখ ও চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এতে করে এই অংশে যেমন চলাচল দায় হয়ে পড়েছে, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠার কারণে দেখা দিচ্ছে দুর্ঘটনা। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে এরই মধ্যে রাজশাহী সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুজ্জোহা ঠিকাদার মুঞ্জুর রহমান পিটারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন। দুই-একদিনের মধ্যেই এই চিঠি দেওয়া হবে বলেও ওই কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন।

তবে বিষয়টি নিয়ে যোগাযোগ করা হলে মুঞ্জুর রহমান পিটার দেশের বাইরে থাকায় তাকে পাওয়া যায়নি।

এদিকে একটি সূত্র নিশ্চিত করেছে, সড়ক ও জনপথ বিভাগের এই কাজগুলো পছন্দের ঠিকাদারদের কাছে রেট গোপনে বিক্রি করে কাজ পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করেছেন রাজশাহীর একজন উদ্ধর্তন প্রকৌশলী। প্রতিটি কাজের জন্য টেন্ডারের আগেই গোপনে দর ঠিকাদারদের জানিয়ে দিয়ে দুই থেকে তিন পার্সেন্ট হারে অর্থ আদায় করেছেন বলেও ওই প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণেই একজন ঠিকাদার একাধিক কাজ পেয়েছেন। ফলে কাজের মাণ নিয়েও যেমন প্রশ্ন উঠেছে, তেমনি কাজও শেষ হতে বিলম্ব হচ্ছে। আর এ নিয়ে চরম ক্ষোভ দেখা দিয়েছে খোদ সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীদের মাঝেই।

রাজশাহীর নির্বাহী প্রকৌশলী শামসুজ্জোহা বলেন, একজন ঠিকাদারকে নিয়ে আমরা চরম বিপদে আছি। তাঁর কাজ শেষ হওয়ার মাত্র কয়েকদিন বাকি আছে। কিন্তু তিনি রাস্তাটি কার্পেটিং করার কোনো উদ্যোগ নেননি। এতে করে জনদুর্ভোগ চরমে আকার ধারণ করেছে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আমরা চিঠি তৈরী করেছে। দ্রুতই উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে দেওয়া হবে ওই চিঠি। অনুমোদন পেলেই ওই ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

নওগাঁর নির্বাহী প্রকৌশলী হামিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের অংশে প্রায় সাড়ে ৫৬ কিলোমিটার কাজ হচ্ছে ৯টি প্যাকেজে। যার মধ্যে প্রায় ৭০ ভাগ কাজ শেষ হয়েছে। বাকি কাজটুকুও নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই শেষ হবে। কিন্তু কাজে কোনো অনিয়ম হতে দেয়নি। একটি জায়গায় সামান্য ফাটল দেখা দিয়েছিল। সেটি দ্রুতই ঠিক করা হয়েছে। এটি হতেই পারে কাজ চলন্ত অবস্থায়। কারণ ওই অংশে সিসি ব্লকের কাজও হয়েছে। সিসি ব্লকের স্থানে বৃষ্টির পরে মাটি বসে যাওয়ায় এবং গাড়ী দুর্ঘটনার তারণে সেখানে সামান্য ফাটল দেখা দিয়েছিল। এটি ছোট বিষয়। তবে কাজের মাণ ভালো আছে।’

এদিকে রাজশাহীর একজন এমপি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, রাস্তাটির কাজ শেষ না হওয়ায় আমাদেরকেও সাধারণ মানুষে নানা কথা বলছেন। এতে করে আমরাও চরম বিপাকে আছি। দ্রুত কাজ শেষ না হওয়ায় মানুষ চরম দুর্ভোগে আছেন।
স/আর