রাজশাহী অঞ্চলে ত্রাণ তুলতে ‘উপরির’ চাপে চেয়ারম্যানরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

ত্রাণ উত্তোলন করতে গিয়ে বাড়তি টাকার চাপে পড়ছেন রাজশাহী অঞ্চলের ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যরা। ত্রাণ উত্তোলন, পরিবহন, ব্যাগ কেনা, প্যাকিং, সরকারি সিলমোহর লাগানো, গুদামের কুলি খরচ, চাহিদাপত্র নিতে ঘুষ প্রদান, ত্রাণ পাহারায় নিয়োজিত চৌকিদারের খরচ বাবদ সরকারি বরাদ্দের চেয়ে অনেক বেশি টাকা খরচ হচ্ছে তাদের। আর বাড়তি এ টাকা দিতে হচ্ছে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের একাধিক ইউপি চেয়ারম্যানের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে। আবার অনেক চেয়ারম্যান অভিযোগে বলছেন, খাদ্যগুদামের বস্তায় চাল এক-দুই কেজি করে কমও পাওয়া যাচ্ছে।

জানা গেছে, সরকারি ত্রাণসামগ্রী লোডিং-আনলোডিং ও পরিবহন খরচ বাবদ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর থেকে ৯ এপ্রিল জেলাওয়ারি অর্থ বরাদ্দ করা হয়েছে। রাজশাহী বিভাগের প্রতিটি ইউনিয়ন এ বাবদ পেয়েছে ১ থেকে দেড় হাজার টাকা।

চেয়ারম্যানরা বলছেন, দেশের ইউনিয়ন পরিষদগুলোর আয়ের নিজস্ব কোনো তহবিল বা খাত নেই। খরচের জন্য বিশেষ কোনো বরাদ্দও পান না তারা। কিন্তু এখন ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে তারা বহুমুখী সংকটে পড়ছেন। এদিকে করোনার এই মহাদুর্যোগেও সরকারি ত্রাণ উত্তোলনে খাদ্যগুদাম থেকে প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিসসহ বিভিন্ন ঘাটে দিতে হচ্ছে ‘উপরি টাকা’। এ কারণে মাঠপর্যায়ে ত্রাণ পরিচালনা কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে। ত্রাণ বরাদ্দ ও উত্তোলনে ঘাটে ঘাটে ঘুষ ও উপরি দিতে গিয়ে অনেক এলাকায় ত্রাণ কম দেয়ার অভিযোগও আসছে। এই অভিযোগে রাজশাহীতে দু’জন ইউপি সদস্যকে বরখাস্ত করেছে প্রশাসন।

রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক চেয়ারম্যান অভিযোগে জানান, ত্রাণের বরাদ্দপত্র (ডিও) নিতে গেলে উপজেলার সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের টনপ্রতি ২০০ টাকা করে দিতে হচ্ছে। ডিও নিয়ে উপজেলা খাদ্য অফিসে ছাড়পত্র নিতেও বিভিন্ন পরিমাণ টাকা লাগছে। সেই ছাড়পত্র গুদামে দেয়ার পর চাল লোডিং কাজে নিয়োজিত শ্রমিকদের টনপ্রতি ২০০-২৫০ টাকা করে দিতে হয়। সেই চাল পরিবহন করে দূরত্ব বিবেচনায় ইউপি কার্যালয়ে নিতে টনপ্রতি খরচ হচ্ছে ৫০০-৮০০ টাকা। ইউপি গুদামে চাল লোড করে পাহারায় নিয়োজিত চৌকিদারদেরও দিতে হয় টনপ্রতি ৫০ টাকা। ইউপি কার্যালয় থেকে ত্রাণসামগ্রী প্রতিটি ওয়ার্ডে পৌঁছানোর খরচও চেয়ারম্যানকে নিজের পকেট থেকে দিতে হচ্ছে। অথচ খাদ্যগুদাম, খাদ্য অফিস ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিসের ঘুষ ও উপরি ব্যবস্থা সম্পর্কে অভিযোগ করলেও কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।

চেয়ারম্যানদের বিড়ম্বনা এখানেই শেষ নয়। সম্প্রতি করোনা মোকাবেলা ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য রাজশাহী বিভাগের সব উপজেলা নির্বাহী অফিস থেকে হ্যান্ড সানিটাইজার, মাস্ক, সাবান ইত্যাদি সুরক্ষাসামগ্রী কিনে বিতরণের চিঠি দেয়া হয়েছে ইউপি চেয়ারম্যানদের। কিন্তু কোনো অর্থ বরাদ্দ আসেনি।

রাজশাহীর গোদাগাড়ীর পাকড়ি ইউপি চেয়ারম্যান আবদুর রাকিব বলেন, এসব সামগ্রী কিনতে এখন ৮০ হাজার টাকা দরকার। ইউপি তহবিলে কোনো টাকা নেই। বিতরণ শেষে প্রতিবেদন দাখিলের পর অফিস থেকে বিল দেয়া হবে। এখন সরকারি নির্দেশ পালনে নিজের টাকাতেই এসব কেনার উদ্যোগ নিয়েছি।

গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউপি চেয়ারম্যান আখতারুজ্জামান বলেন, কয়েক দফা ত্রাণ উত্তোলন, পরিবহন ও বিতরণে আমার খরচ হয়েছে ৫৫ হাজার টাকার বেশি। এখন পর্যন্ত খরচ পেয়েছি মাত্র ২ হাজার ৩০০ টাকা। এই চেয়ারম্যান আরও বলেন, ত্রাণ বরাদ্দ উত্তোলন ও বিতরণে ঝামেলা বিস্তর। কিন্তু এর মধ্যে সরকারি টাকা ছাড়ে বিলম্ব হলে মাঠপর্যায়ে ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা কঠিন হয়ে পড়বে। পরিবহন খরচের অভাবে অনেক চেয়ারম্যান ত্রাণ তুলতেও বিলম্ব করছেন বলে জানিয়েছেন চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর উপজেলার একাধিক ইউপি চেয়ারম্যান।

রাজশাহীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. হামিদুল হক বলেন, একটা দুর্যোগকালীন পরিস্থিতিতে থেকে আমরা সবাইকে আন্তরিকভাবে সরকারি নির্দেশনা বাস্তবায়নের অনুরোধ করেছি। ত্রাণ উত্তোলন ও বিতরণে খরচের সমস্যাগুলো দ্রুতই সমাধান করা হবে। ইউপি চেয়ারম্যানরা সব খরচই পাবেন। হয়তো কিছুটা বিলম্ব হচ্ছে। অন্যদিকে ডিও ছাড় ও খাদ্যগুদামে চাল তুলতে টাকা নেয়ার বিষয়টি তার জানা ছিল না। তিনি বিষয়টি সিরিয়াসলি দেখবেন বলেও জানান। তিনি বলেন, এই সময়ে কাউকে সুযোগ নিতে দেয়ার কোনো অবকাশ নেই।

জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর থেকে ৯ এপ্রিল রাজশাহী জেলার জন্য ত্রাণ লোড-আনলোড ও পরিবহন খরচ বাবদ ১ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। জেলার ৭২টি ইউনিয়ন, একটি সিটি কর্পোরেশন ও ১৪টি পৌরসভায় ত্রাণ পৌঁছানোর জন্য এ খরচ খুবই নগণ্য। পাশাপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জয়পুরহাট ও নাটোরে ৭৫ হাজার টাকা করে এবং পাবনা ও নওগাঁ জেলার জন্য ১ লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছে। এই সামান্য টাকায় ত্রাণ লোডিং-আনলোডিং, পরিবহন ও বিতরণ সম্ভব কি না-জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের উপসচিব হাবিবুল্লাহ বাহার জানান, এই বরাদ্দ প্রাথমিকভাবে দেয়া হয়েছে। ত্রাণ বিতরণের সব খরচই অধিদফতর পর্যায়ক্রমে দেবে।

স/আর

আরও পড়ুন:

রাজশাহীতে ত্রাণ বিতরণ সমন্বয়ে মাঠে থাকবে ‘কুইক রেসপন্স টিম’