রাজশাহীর শীর্ষ মাদক কারবারিরা সীমান্ত এলাকায় কেউ পাড়ি জমিয়েছে বিদেশে

নিজস্ব প্রতিবেদক:
অভিযান থেকে নিজেদের বাঁচাতে রাজশাহীর শীর্ষ মাদক কারবারিরা সীমান্ত এলাকা দিয়ে অনেকেই ভারত পাড়ি জমিয়েছেন। আবার কেউ আশ্রয় নিয়েছেন সীমান্ত এলাকায়। সুযোগ পেলেই এরা ভারতে পালানোর প্রহর গুনছেন। কেউ কেউ সীমান্ত এলাকা থেকেই নিয়ন্ত্রণ করছেন মাদক কারবার। ফলে অভিযানের মধ্যেও মাদক ছড়িয়ে পড়ছে রাজশাহীতে। বিশেষ করে গ্রাম-গঞ্জে এখনো মাদকে কারবার চলছে ব্যাপক হারে।

নতুন নতুন কৌশল অবলম্বন করে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে মাদক। গ্রামে সরকার দলীয় নেতাকর্মীরাই মাদকের হাট বসিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। ফলে ভয়ে এখনো তাদের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছে কেউ। আবার পুলিশও নিয়মিত মাসোহারা আদায় করে চলেছে এখনো। পুলিশের সোর্সরাও মাদক কারবারি জড়িয়ে রয়েছে এখানো। গত কয়েকদিন ধরে অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। তবে আশার কথা হলো-র‌্যাবের মাদকবিরোধী জোরদার অভিযানের ফলে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে বড় মাদক কারবারিরা। তারা বেশিরভাগই আত্মগোপন করে আছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি গোয়েন্দা সূত্র নিশ্চিত করেছে, রাজশাহীর মাদকের সবচেয়ে বড় কারবার হয় জেলার গোদাগাড়ীতে। এই গোদাগাড়ীরই অনেক দিনমজুর, বা সহায়সম্বলহীন ব্যক্তি এখন মাদকের আর্শীবাদে কোটিপতি। তবে তাদের বেশিরভাগই এখন এলাকাছাড়া। গত ২৭ মে কালের কণ্ঠে এ নিয়ে একটি অনুসন্ধানী খবর প্রকাশের পরে নড়েচড়ে বসে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এরপর গত ১ জানুয়ারি গোদাগাড়ীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ী শহিদুল ইসলাম ভোদলকে ১০০ গ্রাম হেরোইনসহ আটক করে পুলিশ।

তবে এখনো অধরা গোদাগাড়ীর অন্য শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীরা। যাদের মধ্যে আছে মাটিকাটা এলাকার সোহেল রানা, সিএ্যান্ডবি গড়ের মাঠ এলাকার হযরত আলী, শীষ মোহাম্মদ। মহিশালবাড়ি এলাকার হেলালুদ্দিন, মহিশালবাড়ি এলাকার জামায়াত নেতা সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর রবিউল ইসলাম রবি, মহিশালবাড়ি এলাকার সেলিম, রেলগেট মাটিকাটা এলাকার নাসির উদ্দীন নয়ন, মাদারপুর এলাকার নাজিবুর রহমান, ডাইংপাড়া এলাকার হায়দার আলী, মাদারপুর এলাকার টিপু, ডাইংপাড়া এলাকার আনারুল ইসলাম, মাদারপুরের তোফাজ্বল, সহরাগাছী এলাকার জসিম উদ্দীন, মাটিকাটা এলাকার শাহিন আলম, আচুয়াভাটা এলাকার আরিফুল, আজিজুল সাতাল ও দুরুল হোদা, মাদারপুর এলাকার সাইফুল ইসলাম, ও আহম্মেদ আলী, মহিশালবাড়ি এলাকার বানী ইসরাইল ওরফে ভোদল, মাদারপুর এলাকার মনিরুল ইসলাম মনি, টিপু, মেহেদী, সোহেল , মাসুস কশাইপাড়া রেলগেট এলাকারা জিয়াউল ইসলাম জিয়া, দিয়াড় মানিকচর এলাকার ইউপি সদস্য শরিফুল ইসলাম, দিয়াড় মানিকচর এলাকার ইউপি সদস্য জোহরুল ইসলাম, ইব্রাহীম হোসেন, ইউপি সদস্য সেন্টু, মহিশালবাড়ি এলাকার কানা মাহাবুব, গোদাগাড়ী পৌর কাউন্সিল মোফাজ্জল হোসেন মোফা, তার সহযোগী মুত্তাসিম রেলগেট এলাকার মারেজ, দিয়াড় মানিকচর এলাকার ইশ্রা হোসেন, সারফুল, লোকমান, মোংলা ও দেলোয়ার।

এদের মধ্যে অধিকাংশই এখন এলাকাছাড়া। কেউ কেউ ভারতেও পালিয়ে গেছেন। আবার কেউ কেউ রাজশাহী শহরে আশ্রয় নিয়েছেন। কেউ সীমান্ত এলাকার দুর্গম দিয়াড় মানিকচর এলাকায় অবস্থান এখনো মাদক কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা হলেন, ইব্রাহীম হোসেন ও ইউপি সদস্য সেন্টু, শরিফুল ইসরাম. জোহুরুল মেম্বার, ইশ্রা হোসেন, সারফুল, লোকমান, মোংলা ও দেলোয়ার।

একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে, গত ১ জুন গোদাগাড়ীর শীর্ষ মাদক সম্রাট শহিদুল ইসলাম ভোদল আটক হওয়ার পরে এখন শীর্ষ এই মাদক ব্যবসায়ীরা দিয়াড় মানিকচর এলাকায় গিয়ে অবস্থান নিয়েছেন। এদের একেকজনের দুই থেকে তিনটি করে বাড়ি রয়েছে। এর মধ্যে একটি করে বাড়ি রয়েছে দিয়াড় মানিকচর এলাকায়। আর অন্য বাড়িগুলো রয়েছে গোদাগাড়ী সদরে এবং রাজশাহী শহরে। এরা বিপদ টের পেলেই দুর্গম দিয়াড় মানিকচর এলাকায় ডসয়ে অবস্থান নেয়। সম্প্রতি র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কটোর মাদকবিরোধী অভিযানের মুখে এরা গ্রেপ্তার এড়াতে আবারো দিয়াড় মানিকচর এলাকায় গিয়ে অবস্থান নিয়েছে। কেউ কেউ ওই সীমান্ত দিয়েই ভারতী চোরাকারবারীদের সহায়তায় ভারতে পালানোর চেষ্টা করছে। এই ধরনের গোয়েন্দা প্রতিবেদনও সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো হয়েছে বলেও ওই সূত্রটি নিশ্চিত করেছে।

তবে গোদাগাড়ী থানার ওসি জাহাঙ্গীর আলম বলেন, মাদক ব্যবসায়ীদের আর ছাড় নয়। এদের বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে নিয়েছি। এরই মধ্যে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। কেউ পালিয়ে গেছে। আবার কেউ আত্মগোপন করেছে। তবে সবাইকেই আইনের আওতায় আনা হবে।

সূত্র মতে, রাজশাহীর পবা এলাকার মাদক সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন কামাল, শাহীন, ভোকা মেম্বার, মুকুল, মনিরুলসহ অন্তত ২৫ জনের কয়েকটি সিন্ডিকেট। এর মধ্যে মধ্যে ভোকা মেম্বার আটক হলেও অন্যরা এখনো ধরা-ছোয়ার বাইরে অবস্থান করছে।

রাজশাহী নগরীর শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ী সাবেক এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর অভিযান শুরু হওয়ার পরে সৌদিআরব পাড়ি জমিয়েছেন। আরেক গডফাদার রয়েছেন ভারতে।

বাঘার কোটিপতি ও রাজশাহী অঞ্চলের ইয়াবার গডফাদার কালাম মোল্লা, সামাদ মোল্লা এখন লাপাত্তা। এদের মধ্যে কালামের শিষ্য রাজশাহীর আসলামকে সম্প্রতি কক্সবাজারে মিউজিক ভিডিও করার নামে মাদক পাচার করতে গিয়ে এক লাখ ৮ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক হয়। এরপর কালাম পাড়ি জমায় ভারতে।

জেলার বাঘা ও চারঘাট থানা সূত্র মতে, ভারতীয় সীমান্ত সংলগ্ন এই দুই উপজেলার অন্য শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের মধ্যে এখনো অধরা ইদ্রিশ মোল্লা, সাহাবুল ইসলাম, আব্দুল কুদ্দুস, আবুল কাশেম, তজলু হোসেন, দুলাল হোসেন, জয়নাল মুন্সি, মোকারম হোসেন, রিপন আলী, রাকিবুল ইসলাম, গোলাম মোস্তফা, গিয়াস উদ্দীন, হাফিজুল ইসলাম, দবির হোসেন, খালেক হোসেনে, জার্জিস আহম্মেদ, বাদশা হোসেন, আনিছুর রহমান, মিঠুন আলী, গাজী হোসেন, শহিদুল ইসলাম, নাজমুল হোসেন, ঝুন্টু হোসেন, পান্না হোসেন, রান্টু হোসেন, ভুলা হোসেন, আবদুল হান্নান, পিয়ারুল ইসলাম, দুলাল হোসেন, রুবেল আলী, রিয়াল হোসেন, বারী হোসেন, তছিকুল ইসলাম, পলাশ হোসেন, মাহবুর রহমান, ফলা হোসেন, আবদুর বারী, সাইদুর রহমান। এরা এখনো কেউ কেউ পুলিশের সহায়তায় এলাকায় বিচরণ করছে। আবার কেউ সীমান্ত এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।

এই মাদক কারবারিদের আশ্রয়দাতা হিসেবে চারঘাট থানার আলোচিত উপ-পুলিশ পরিদর্শক উৎপল কুমার, এসআই শরিফুল ইসলাম, মামুনুর রশিদ ও তরিকুল ইসলামের নাম উঠে এসেছে। তাদের মধ্যে এরই মধ্যে উৎপলকে পুলিশ লাইন্সে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরেও উৎপলের বিচরণ চারঘাট-বাঘা এলাকায়। তারা নিয়মিত এলাকায় গিয়ে মাসোহারা আদায় করেন বলেও অভিযোগ রয়েছে।

তবে এসব বিষয়ে জানতে চাইলে ওই পুলিশ কর্মকর্তারা মাদকের সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ততার কথা অস্বীকার করেন। তাঁদের মধ্যে উৎপল বলেন, এটা ঠিক নয়। মাদকের সঙ্গে জড়িত থাকার প্রশ্নই আসে না।
এছাড়াও মাদক কারবারিদের সঙ্গে সখ্যতা আছে রাজশাহী নগরীর বোয়ালিয়া থানার এসআই নাসির হোসেন, ডিবির এসআই মনিরুল ইসলাম, গোদাগাড়ী থানার এসআই আকবর, এসআই নুরইসলাম, এসআই নাইমুলসহ আরো অন্তত অর্ধশতাধিক পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। অর্থের বিনিময়ে এরা নিয়মিত মাদক কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এখনো মাসোহারা আদায় করে থাকেন। আবার মাসোহারা না পেলে কখনো কখনো নিজেরাই মাদক দিয়ে সাধারণ মানুষকে ফাঁসিয়ে দেওয়ার অভিযোগ আছে এদের বিরুদ্ধে।

অপরদিকে পুলিশ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স পরিচয়ধারীরাও মাদক কারবারে জড়িত রয়েছে এখনো। এর মধ্যে নগরীর আসাম কলোনী এলাকার রুবেল হোসেন, গোদাগাড়ীর রেলবাজার এলাকার মতিউর, দেওয়ানপাড়া এলাকার জুয়েল, সহরগাছী এলাকার মতিউর রহমান বাবুর বিরুদ্ধে এখনো মাদক ব্যবসার অভিযোগ রয়েছে। এরা মাদক ব্যবসায়ীদের তথ্য দেওয়ার নামে নিজেরাই মাদক ব্যবসা পরিচালনা ছাড়াও নিয়মিত মাসোহারা আদায় করে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের হাতে তুলে দেন।

জানতে চাইলে চারঘাট থানাও ওসি নজরুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ কোনো মাদক ব্যবসায়ীকে আশ্রয় দিলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা মাদক কারবারিদের আর ছাড় দিতে চাই না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে আছি।’

জানতে চাইলে র‌্যাব রাজশাহী-৫ এর একজন দায়িত্বশীর কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, রাজশাহীর শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীদের তালিকা আমাদের হাতে আছে। এগুলো আমরা যাচাই-বাছাই করছি। এদের বিরুদ্ধে আমরা জোরালো পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছি। এরই মধ্যে অভিযানও চলছে। সামনে মাদক ব্যবসায়ীদের আরো দুর্দীন আসবে। কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।’

এদিকে রাজশাহী র‌্যাবের মিডিয়া উয়িং সেল থেকে জানানো হয়, গত ৩ মে থেকে রাজশাহীতে মাদকবিরোধী অভিযান শুরু হয়। সেই থেকে গতকাল বুধবার পর্যন্ত র‌্যাবের অভিযানে এক হাজার ৪৪২ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদ- এবং ২৫৩ জনকে অর্থদ- দেওয়া হয়।

তবে পুলিশের অভিযানে এ সময়ে কতজনকে আটক করা হয়েছে তা জানাতে পারেনি রাজশাহী জেলা ও মহানগর পুলিশ।

 

স/আর