রাজশাহীর দুই ওসির বিরুদ্ধে নারী ওসির স্বামীকে ফাঁসানোর অভিযোগ


নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহীর দুই ওসির বিরুদ্ধে এক নারী ওসির স্বামীকে ফাঁসনানোর গুরুতর অভিযোগ পাওয়া গেছে। গতকাল বুধবার রাজশাহী মহানগর পুলিশ কমিশনারের কাছে এ অভিযোগটি করেন নারী পরিদর্শক (ওসি) হোসনে আরা বেগম। বর্তমানে তিনি রাজশাহীর চারঘাটে বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমীতে সংযুক্তি হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। তাঁর মূল কর্মস্থল ঢাকায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের পরিদর্শক। হোসনে আরার অভিযোগটি যথাযথ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে পুলিশ একাডেমীর অধ্যক্ষ খন্দকার গোলাম ফারুক (এডিশনাল মহাপুলিশ পরিদর্শক) সুপরিশ করেছেন।

অভিযোগ ওঠা দুই ওসির মধ্যে একজন হলেন নগরীর বোয়ালিয়া থানায় কর্মরত ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ এবং অপরজন হলেন নগরীর দামকুড়া থানায় কর্মরত ওসি মাহবুব আলম। তাঁদের মধ্যে মাহবুব আলম ছিলেন অভিযোগকারী নারী ওসি হোসনে আরা বেগমের সাবেক স্বামী। ২০১৮ সালে মাহবুবের সঙ্গে হোসনে আরার বিবাহ বিচ্ছেদ হয়।

অভিযোগে ওই নারী পরিদর্শক উল্লেখ করেন, ২০১৩ সালে ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক পুলিশ পরিদর্শক মাহবুব আলম এর সাথে আমার বিয়ে হয়। মাহবুব আলম বর্তমানে রাজশাহী মহানগর এর দামকুড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে কর্মরত আছেন। শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন এর স্বীকার হয়ে আমি নিরুপায় হয়ে ২০১৮ সালে মাহবুব আলম এর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ ঘটাই। এরপর থেকে মাহবুব আলম আমাকে তার সাথে মােগাযোগ রাখার জন্য বিভিন্নভাবে বিষক্ত করে। পরবর্তীতে আমায় পারিবারিক ভাবে রাজশাহী নগরীর চন্দ্রিমা থানার ললিতাহার এলাকার আব্দুল ওদুদের ছেলে মামুন হুসাইনের সঙ্গে বিয়ে হয় এবং আমি সুখে শান্তিতে বসবাস করছি।

রাজশাহী মহানগরীর বোয়ালিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (পুলিশ পরিদর্শক) নিবারন চন্দ্র বর্মণ রাজশাহীতে যোগদান করার পর আমার সাথে পরিচয় হলে আমি তাকে কথা প্রসঙ্গে আমার বিষয়টা জানায়। এরপর থেকে নিবারন চন্দ্র বর্মন আমাকে বিভিন্ন সময় বিরক্ত করতে থাকে। যেমন, আমাকে তার অনেক ভালো লাগে, আমি দেখতে অনেক আকর্ষনীয়, আমার মত একটা মেয়ে পেলে আর তার কিছুই লাগবে না ইত্যাদি। আমি বিষয়টা না বোঝার ভান করে তাকে এড়িয়ে যাবারা চেষ্টা করি।

উল্লেখ্য, পুলিশ পরিদর্শক মাহবুব আলম বোয়ালিয়া থানার ওসি তদন্ত হিসেবে কর্মরত ছিলেন। সেই সময় পুলিশ পরিদর্শক নিবারণ চন্দ্র বর্মণ মাহবুব আলমের বিষয়ে কথা বলার জন্য আমাকে মাঝে মাঝে ফোন করতেন এবং বলতেন ‘একই শহরে অন্য ছেলেকে বিয়ে করে তুমি কি সংসার করতে পারবা? তুমি তো বিপদে পড়ে যাবা।’ এছাড়া পুলিশ পরিদর্শক মাহবুব আলমও আমার বর্তমান স্বামী মাহবু হুসাইনকে মতিহার থানায় ডেকে নিয়ে বিভিন্ন হুমকি দিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ‘হোসনে আরা আরাকে বিয়ে করে তুমি ভালো থাকতে পারবে না। তারপর বলেছিলেন, ‘ওর সাথে মিশে তুমি আমার সাথে শত্রুতা তৈরী করো না।

হোসনে আরা আরও লিখেন, গত ১৬ মার্চ রাত দেড়টার সময় আমার স্বামী মাহবুব হুসাইন আমাকে ফোন করে বলে যে, বাসায় পুলিশ এসেছে। আমি আমার স্বামীর ফোন থেকে বোয়াালিয়া থানার ওসি (তদন্ত) লতিফের সাথে কথা বলি। তারা তখন আমার শ্বশুর-শাশুড়ীর বাসা থেকে চলে যায়। এর কিছুক্ষন পর আনুমানিক ২টা ২০ মিনিটে পুনরায় এসে আমার স্বামীকে নিয়ে যায়। আমি পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) লতিফকে ফোন করে বলি তুমি কি ওকে (মাহবুব হুসাইন) নিতে গেছো? লতিফ জানায় গাঁ নিয়ে গিয়েছি।’ এরপর থেকে আমি অসংখ্যবার ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ এবং ওসি তদন্ত লতিফকে ফোন করি এটা জানার জন্য যে, তারা আমার স্বামীকে কেন নিয়ে গেছে? কিন্তু অতান্ত পরিতাপের বিষয়, আমি পুলিশ বাহিনীর একজন সদস্য হওয়া সত্বেও তারা আমার ফোন রিসিভি করেনি।

এরপর সকাল ৮ টা ১০ মিনিটের দিকে আমি বোয়ালিয়া থানায় আসি। ডিউটি অফিসার এ,এস,আই সুলতানা আমাকে জানায় যে, আমার স্বামীকে বোয়ালিয়া থানায় নিয়ে আসা হয়েছে রাত ২ টা ৩০ মিনিটের পরে। ওই সময় আমি ডিউটি অফিসার এর সাথে এবং থানার অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে আলােচনা করে জানতে পারি আমার স্বামীর নামে তাদের কাছে কোনো রাজনৈতিক তথ্য নাই।

আমি আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে চাইলে ডিউটি অফিসার জানায় ওসি স্যারের নিষেধ আছে। সকাল অনুমানিক ৮ টা ৩০ মিনিটে ওসি নিবারণ চন্দ্র বর্মণ লুঙ্গী পরিহিত অবস্থায় থানায় আসে এক মুচকি হেসে আমাকে বলে যে, ‘সেইতো দৌড়াইয়া আমার কাছে আসলা। কিন্তু সময়মত অসো নাই, তখন তো আমাকে ভালো লাগে নাই। এরপর তিনি বললেন, ‘তোমার স্বামী তো শিবির করে।’ আমি বললাম, না সার ও কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে জড়িত না।’ তখন তিনি বললেন, ‘পুলিশ কমিশনার স্যারের কাছে তোমার কথা বলে তিনি বললে তোমার স্বামীকে ছেড়ে দিবো।’

আমি বললাম “সার আমি কি আপনার সাথে কমিশনার স্যারের কাছে যাবো?’ নিবারন স্যার বললেন “না তোমার যেতে হবে না।” তখন আমি ডিউটি অফিসাবের রুমে অসহায়ের মত বসে থাকলাম। এরপর আনুমানিক বেলা একটার দিকে ওসি নিবারন চন্দ্র বর্মণ থানায় ফিরলেন। আমি পিছনে পিক্ষনে তার অফিস রুমে ঢুকলাম। তিনি ওয়াশরুমে ঢুকলেন, তখন আমি বসলাম।

ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে তিনি মাথা না সূচক ঘোরালেন এবং বললেন “আমাকে কি একটু ভালো লাগছে। এখনো এত অবহেলা করো কেন আমাকে।’ আমি তখন জানতে চাইলাম কমিশনার স্যার কি বললেন নিবারন স্যার বললেন “পুতুল (হোসনে আরা) শুধু কমিশনার নয়, এই শহরে আমি যেটা বলি সেটাই শেষ কথা।” এরপর তিনি বললেন, ‘তোমার স্বামীর নামে মামলা হবে।’ তখন আমি বললাম, ‘স্যার আমি কি আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে পারবো?’ তিনি অনুমতি দিলেন। আমি আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে গিয়ে দেখি আমার স্বামীর মুখে হাতে আঘাতের চিহ্ন। আমি আমার স্বামীকে দেখে তার দুইটা মোবাইলের একটা ওসি স্যারের নিকট হইতে বুঝে নিয়ে কোর্টে চলে আসি।

ওইদিন বিকেল ছয়টার দিকে আমার স্বামীকেসহ গ্রেফতারকৃত অন্যান্যদের কোর্ট নিয়ে আসে। তখন জানতে পারি আমার স্বামীর নামে সন্ত্রাস দমন আইনের মামলা দিয়েছে এবং তার নামের পাশে শিবিরকর্মী লিখে দিয়েছে। অথচ আমার স্বামী কোনভাবেই জামাত-শিবিরে সাথে জড়িত না। মূলত আমার স্বামী কোনো রাজনৈতিক দলের সাথেই জড়িত নয়। কোনো দলীয় কমিটিতে আমার স্বামীর নাম কেউ দেখতে পারবে না।

এরপর আমি জেলখানায় আমার স্বামীর সাথে দেখা করতে গেলে আমার স্বামী আমাকে জানায় বোয়ালিয়া থানার এস,আই মতিনসহ ওই টিমে থাকা অন্যান্য সদস্যরা শুধু আমার স্বামীকে শারীরিক নির্যাতন করেছে। এস,আই মতিন আমার স্বামীকে বলেছে, ‘শালা মাহবুব স্যারের বউকে বিয়ে করার শখ হয়েছে। মাহাবুব স্যার তোর জীবন বরবাদ করে দিবে। তুই মনে রাখিস।”
পরিদর্শক হোসনে আরা আরও লিখেন, আমার স্বামী পেশায় একজন সাংবাদিক। কোনো নাজনৈতিক দলের সাথে সে জড়িত নয়। আমি আমার স্বাামীকে নিয়ে সহজ স্বাভাবিক ও শান্তিময় জীবন-যাপন করছিলাম। ওসি বোয়ালিয়া নিবারন চন্দ্র বর্মণ তার ব্যক্তিগত নোংরা উদ্দেশ্য আমার উপর প্রয়োগ করতে না পেরে এবং ওসি মাহবুব আলম আমার উপর পূর্ববর্তী আক্রোশ থেকে আমার জীবনটা ধংস করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে আমার স্বামীকে মিথ্যা বানোয়াট মামলায় চালান দিয়েছে। আমি পারিবারিক এবং সামাজিক ভাবে যেন হেয় প্রতিপন্ন হই সে জন্যই এই ধরনের কাজ করেছে।

আমি বাংলাদেশ পুলিশের একজন নারী সদস্য। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত আক্রোশ বশত আমার এবং আমার স্বামীর উপর এই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে সুষ্ঠ তদন্তপূর্বক ওসি বোয়ালিয়া নিবারন চন্দ্র বর্মণ এবং ওসি দামকুড়া মাহবুব আলমসহ আমার স্বামীকে যারা থানায় শারীরিকভাবে নির্যাতন করেছে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিনীত আবেদন করছি।
এই অভিযোগ সুষ্ঠ তদন্তপূর্বক পুলিশ বাহিনীর এই ধরনের নোংরা চিন্তাধারার মানুষদের বিচারের আশায় আপনার বরাবরে অভিযোগ দাখিল করলাম।

এদিকে বিষয়টি নিয়ে ওসি মাহবুব আলমের সঙ্গে যোযোগ করা হলে তিনি এই ধরনের ঘটনা সঠিক নয় বলে দাবি করেন। তিনি বলেন, আমার সঙ্গে হোসনে আরার বিয়ে হয়েছিল। তার পর ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে। এরপর থেকে তার সেঙ্গ আমার কোনো যোগাযোগ নাই। সে আমাকে ফাঁসাতে মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে।

ওসি নিবারন চন্দ্র বর্মণ বলেন, ‘হোসনে আরার সঙ্গে কোনো আপত্তিকর কথা হয়নি। তার স্বামীকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু স্বামীকে বাঁচাতে সে আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ তুলেছে।’

স/রি