রাজশাহীর কৃষিবিদের আবিস্কার ‌’ধান চাষে পাতার মাধ্যমে ইউরিয়া প্রদানে সাফল্য”

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের এগ্রোনমি এবং এগ্রিকালচার এক্সটেনশন বিভাগের গবেষণাতে বিএডিসির সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম-পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ আরিফ হোসেন খান কর্তৃক উদ্ভাবিত ‘ধান চাষের ইউরিয়া সাশ্রয়ী স্প্রে প্রযুক্তিটি সঠিক বলে প্রমাণিত হলো। চলতি বোরো ২০১৬-১৭ মৌসুমের এই গবেষণাতে ধান চাষে ৩৫ ভাগ এবং ২৫ ভাগ ইউরিয়া সার সাশ্রয় করেও ধানের ফলন বৃদ্ধি হয়েছে যথাক্রমে প্রায় ৬ ভাগ এবং প্রায় ১১ ভাগ।

এই প্রযুক্তির মাধ্যমে উৎপাদিত ধানের প্রেটিনের পরিমানও বৃদ্ধি পেয়েছে গবেষকগণ প্রমাণ পেয়েছেন। প্রযুক্তি উদ্ভাবক কৃষিবিদ আরিফ খান বলেন, স্প্রে প্রযুক্তির মাধ্যমে ধান চাষের সাফল্যের এ তথ্যটি বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য ধান উৎপাদনকারী দেশের জন্য একটি মাইল ফলক হতে পারে। কারণ স্প্রে প্রযুক্তির মাধ্যমে ধান চাষের এমনতর সাফল্য দেশসহ আন্তর্জাতিক এ পর্যন্ত অর্জিত হয়নি। একারণে সরকারের সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা পেলে ধান চাষ বিষয়ে প্রযুক্তিটি একটি মডেল হতে পারে এবং এবিষয়ে বাংলাদেশ হতে পারে পাইওনিয়ার।

২০১২ সালে প্রযুক্তিটি উদ্ভাবনের পরে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন জেলায় ২৭৫ জন চাষি এবং কর্মকর্তার মাধ্যমে ৬২০০ বিঘা জমিতে প্রযুক্তিটি বাস্তবায়ন করে মাঠ পর্যায়ে সাফল্য পাওয়া গিয়েছিল। এই প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে শুধু ধান চাষে প্রায় ৫ লক্ষ মেট্রিক টন ইউরিয়া সারের ব্যবহার কমিয়ে দেওয়া সম্ভব হতে পারে। এ কারণে সরকারের ১৬৫০ কোটি টাকা সাশয়ের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আর বাৎসরিক অতিরিক্ত ধান উৎপাদন হতে পারে ১৫ লক্ষ মেট্রিক টন। যার বর্তমান বাজার মূল্য ৩৭৫০ কোটি টাকা।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের খামারের গবেষণা মাঠে চলতি বোরো মৌসুমে ব্রিধান-২৮ এর উপরে এমএস স্টুডেন্ট সেরাজাম মুনিরা তার থিসিসের আওতায় গবেষণাটি করেন। গবেষণার সুপারভাইজার ছিলেন প্রফেসর ড.মোঃ আমিনুল হক। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সম্পাদিত এই পরীক্ষাতে সুনিদিষ্টভাবে প্রমাণিত হয়েছে যে, ধান গাছে পাতার মাধ্যমে নাইট্রোজেন প্রদান একটি কার্যকর এবং বিকল্প পদ্ধতি হতে পারে।

এই তথ্যটি দেশের ধান চাষিদেরকে জানিয়ে দিতে পারলে তারা সংকটকালীন সময়ে, যেমন সাময়িক খরা বা জলাবদ্ধতা বা কৃত্রিম ইউরিয়া সার সংকটের সময়ে অল্প পরিমান ইউরিয়া সার পাতার মাধ্যমে প্রয়োগ করে ভালোভাবে ফসল ফলাতে পারবেন এবং তাদের ফসলকে ফলন বিপর্যযয়ের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবেন।

মাটি পরীক্ষার মাধ্যমে সম্পাদিত বিজ্ঞানভিত্তিক এই পরীক্ষাতে মোট ৮টি ট্রিটমেন্টে ব্যবহার করা হয়েছে। এর মধ্যে ৬টি ট্রিটমেন্টে ২০% থেকে ধাপে ধাপে ৩৫% পর্যন্ত ইউরিয়া সার সাশ্রয় করার চেষ্টা করা হয়। ধানের চারা রোপণ করা হয়েছিল ৪৭ দিন বয়সের এবং প্রতি গোছায় ২ থেকে ৩টি চারা। রোপণ দূরত্ব রাখা হয় লাইন থেকে লাইন ২০ সেন্টিমিটার এবং চারা থেকে চারার দূরত্ব ২০ সেন্টিমিটার।

পরীক্ষার প্লটের আকার ছিল ৫ বর্গমিটার। বীজতলা থেকে চারা তোলার আগের দিন বিকালে প্রতি লিটার পানিতে ২০ গ্রাম ইউরিয়া, ১০ গ্রাম এমওপি, ২ গ্রাম থিওভিট, ০.৫০ গ্রাম চিলেটেড দস্তা এবং ০.৫০ গ্রাম লিবারেল বোরণ এবং একটি কীটনাশকসহ মিশিয়ে প্রতি বর্গমিটারে ৫০ মিলি হিসাবে স্প্রে করা হয়।

ইউরিয়া বাদে অন্যান্য সকল সার শেষ চাষে প্রয়োগ করে ধান রোপন করা হয়। ধান রোপণের ৯ দিন পর সকল ট্রিটমেন্টের প্লটে ৩৩.০ ভাগ ইউরিয়া সার প্রদান করা হয় এবং এর ১৫ দিন পরে ইউরিয়া সাশ্রয় সংক্রান্ত ট্রিটমেন্টের প্লটগুলিতে অবশিষ্ট পরিমান ইউরিয়া সার প্রদান করা হয়। একই সময়ে ট্রাডিশনাল ট্রিটমেন্টের (ট্রিটমেন্ট নং-৭) প্লটে ৩৪ ভাগ ইউরিয়া প্রদান করা হয় এবং অবশিষ্ট ৩৩ভাগ ইউরিয়া চারা রোপণের ৪০ দিন বয়সের সময় প্রদান করা হয়।

ইউরিয়া সাশ্রয় সংক্রান্ত ট্রিটমেন্ট ১, ২ এবং ৩ এর ক্ষেত্রে মাত্রাঅনুযায়ী ইউরিয়া সার কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে প্রথমবার স্প্রে করা হয় চারা রোপণের ৩১ দিন বয়সের সময় দি¦তীয়বার স্প্রে করা হয় চাপা রোপণের ৪১ দিন বয়সের সময় এবং শেষবার মাত্রাঅনুযায়ী ইউরিয়া সার ছত্রাকনাশকের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করা হয় চারা রোপণের ৫১ দিন বয়সের সময়।

ট্রিটমেন্ট ৪, ৫ এবং ৬ এর ক্ষেত্রে মাত্রাঅনুযায়ী ইউরিয়া সার কীটনাশকের সাথে মিশিয়ে প্রথমবার স্প্রে করা হয় চারা রোপণের ৩৫ দিন বয়সের সময় দি¦তীয় বার স্প্রে করা হয় চারা রোপণের ৪৫ দিন বয়সের সময় এবং শেষবার মাত্রাঅনুযায়ী ইউরিয়া সার ছত্রাকনাশকের সাথে মিশিয়ে স্প্রে করা হয় চারা রোপণের ৫৫ দিন বয়সের সময়। এই পরীক্ষার যে ট্রিটমেন্টে (ট্রিটমেন্ট নং-৩) মাটিতে দুইবারে ৫০% ইউরিয়া প্রদান করে পাতায় তিনবারে ২৫% ইউরিয়া এবং এর সাথে ১.২৫% এমওপি, সালফার বোরণ ও জিঙ্ক মিশিয়ে (তৃতীয় স্পের সময় সালফার বোরণ এবং জিঙ্ক ব্যবহার করা হয়নি) তিন বার স্প্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয়েছে সেই ট্রিটমেন্টে সর্বাধিক বেশী সাফল্য পাওয়া গেছে।

মূল জমিতেও প্রতি বর্গ মিটারে ৫০ মিলি স্প্রে দ্রবণ প্রয়োগ করা হয়। সকল স্প্রে করা হয়েছে বিকাল ৫.০ ঘটিকার পরে। প্রতি প্লটের মাঝের ২ বর্গমিটার জমির ৫০টি গুছি কেটে ফলাফল হিসাব করা হয়েছে। এই পরীক্ষায় স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়েছে যে, ১০-২৫% ইউরিয়া সার পাতায় তিনবার স্প্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করে ধান গাছের শেষ পর্যায়ের প্রয়োজনীয় ৪০-৫০% নাইট্রোজেনের যোগান সুন্দর ভাবে দেওয়া সম্ভব।

কম পরিমান ইউরিয়া সার প্রয়োগের মাধ্যেমে ধান চাষে সাফল্যের বিষয় প্রযুক্তিটির উদ্ভাবক বিএডিসির সার বিভাগের যুগ্ম পরিচালক কৃষিবিদ আরিফ খান বলেন, মাটিতে ইউরিয়া প্রয়োগ করলে যেখানে গাছ ৩০-৩৫ ব্যবহার করতে পারে, সেখানে পাতায় প্রয়োগ করলে শতকরা ৯০ এর চেয়ে বেশী ব্যবহার করতে পারে বলে উন্নত বিশ্বের গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায়।

তিনি আরো বলেন, একক নাইট্রোজেন পাতায় প্রদান করলে তা ৪ একক থেকে ১৫ একক পর্যন্ত মাটির প্রদানকে প্রতিস্থাপন করতে পারে। পাতায় যখন ইউরিয়া দ্রবণ স্প্রের মাধ্যমে প্রয়োগ করা হয় তখন প্রয়োগকৃত ইউরিয়ার ৫০ ভাগ ত্রিশ মিনিট থেকে দুই ঘন্টা সময়ের মধ্যে গাছের মধ্যে ডুকে যেতে পারে বলে আমেরিকার মিসিগান স্টেট ইউনিভারসিটির গবেষণালব্ধ তথ্য থেকে জানা যায়।

এই গবেষণার সুপারভাইজার প্রফেসর ড. মোঃ আমিনুল হক বলেন, গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফলটি দেশে ধান চাষে ইউরিয়া সারের ব্যবহার এবং ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে আমুল পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারে। এছাড়া ফোলিয়ার ফিডিং কৌশলের মাধ্যমে ধান গাছে নাইট্রোজেনের যোগানের বিষয়টি খরা প্রবণ বরেন্দ্র এলাকার চাষিসহ দেশের সকল এলাকার চাষিদের ধান চাষে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিতে পারে।

তিনি বলেন, আমন মৌসুমে বৃষ্টির অভাবে চাষিরা যখন তাদের জমিতে সময় মত ইউরিয়া দিতে পারবে না তখন পাতার মাধ্যমে খুব সহজেই চাষিরা ইউরিয়া সারের দ্রবণ স্প্রের মধ্যেমে প্রয়োগ করে ধান গাছের নাইট্রোজেনে চাহিদা তাৎক্ষনিকভাবে মিটিয়ে দিতে পারবেন। তিনি আরও বলেন যেহেতু এই প্রযুক্তিটির মাধ্যমে মাটিতে ৪০ ভাগ-৫০ ভাগ ইউরিয়া সার কম প্রদান করা হচ্ছে সতরাং প্রযুক্তিটির প্রয়োগে মাটি, পানি এবং পরিবেশও অধিক সুরক্ষিত থাকবে।

স/আর