রাজশাহীতে ৯ ঘন্টার ‘ব্লক রেইড’ শেষে যেন স্বস্তির ঢেকুর তুলেন হড়গ্রামবাসী

নিজস্ব প্রতিবেদক:
রাজশাহী মূল শহর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার দূরে নগরীর হড়গ্রাম পূর্বপাড়া মহল্লা। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়কের উত্তর পাশ দিয়ে লম্বা হয়ে উত্তর-পশ্চিমদিকে চলে গেছে মহল্লাটি। মহাল্লাটি আবার তিনটি পাড়ায় বিভক্ত। এগুলো হলো, পূর্বপাড়া, টালিপাড়া ও টুলটুলি পাড়া। সবকটি পাড়াতেই ঢুকতে হয় সিটি বাইপাস থেকে নেমে ৬টি গলির মধ্য দিয়ে। কোনোটি একেবারেই সরু। আবার কোনোটি একটু স্বাভাবিক।

 

গত মঙ্গলবার সকাল নয়টার দিকে হঠাৎ করে এসব গলির পথ বন্ধ করে দেয় পুলিশ। এরপর গ্রামের মধ্যে আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়। যাকে বলা হয়, নট আউট, নট ইন। এরপর শুরু হয় গোটা মহল্লাজুড়ে বাড়ি বাড়ি পুলিশের তল্লাশি। যাকে পুলিশের ভাষায় বলা হয়, ব্লক রেইড’। এটি চলতে থাকে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত। এ অভিযান চালায় রাজশাহী মহানগর পুলিশ। এসময় তাদের সঙ্গে যোগ দেয় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি, মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিআইব) দলের সদস্যরাও। কিন্তু সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়, দিনভর ‘ব্লক রেইড’ থেকে কিছু পাওয়া যায়নি। তবে এ অভিযানের কারণে গ্রামজুড়ে ব্যাপক ভোগান্তি নেমে আসে বলে দাবি করেন স্থানীয়রা। দিনভর ঘর থেকে বাইরে বের হতে না পেরে মহল্লাবাসী যেন গৃহবন্দি হয়ে পড়েন।

 

এমন ভোগান্তির পরেও এ অভিযানকে অনেকেই দেখছেন নিজেদের নিরাপত্তার একটি বড় অর্জনের অংশ হিসেবেই। মহল্লাবাসী মনে করছেন, একটি দিনের জন্য ভোগান্তি হলেও এই মহল্লা এখন অন্তত জঙ্গিমুক্ত হলো। প্রায় সাড়ে তিন শ বাড়ি নিয়ে গঠিত এই মহল্লাটির মানুষ সারাদেশের মতো কিছুটা হলেও আতঙ্কিত ছিলেন কোনো জঙ্গি আস্তানা আছে কিনা এমন সন্দেহে। গত মঙ্গলবার সকালে হঠাৎ কিরে পুলিশের ব্লক রেইড শুরু হওয়ার পরে সেই সন্দেহের পারদ আরো বেড়ে যায় কয়েক গুন। দিন শেষে কোনো জঙ্গি আস্তানার খোঁজ না পাওয়ায় যেন স্বস্তির ঢেকুর তুলেন মহল্লাবাসী।


অভিযানের দায়িত্ব থাকা রাজশাহী মহানগরীর উপপুলিশ কমিশনার (পূর্ব) আমির জাফর সাংবাদকিদের বলেন, ‘আমাদের কিছু তথ্য ছিল। সেই তথ্যমতেই আমরা এই এলাকায় সকাল থেকে অভিযান চালায়। তবে কোনো কিছু পাওয়া যায়নি। কাউকে আটকও করা যায়নি। অভিযানটিতে মহানগর পুলিশ এককভাবেই ছিল।’

 
জঙ্গি আস্তানা বা জঙ্গি সন্দেহে এ অভিযান পরিচালনা করা হয় কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে ওই কর্মকর্তা আরো বলেন, ‘সেইরকম কিছু তথ্যের ভিত্তিকেই এ অভিযান চালানো হয়। তবে অন্য বাহিনীর সদস্যরা কাউকে আটক করেছে কিনা তা জানা নাই।’

 
এদিকে স্থানীীরা জানায়, গতকাল ভোর থেকেই সাদা পোশাকে পুলিশ রাজশাহী নগরীর কোট স্টেশন থেকে থেকে উত্তর দিকে হড়গ্রাম পূর্বপাড়া, টালিপাড়া ও টুলটুলি পাড়া নামক তিনটি পাড়ায় অবস্থান নেয়। সকাল নয়টার দিক থেকেই ওই এলাকার ৬টি গলির পথ বন্ধ করে দেয় পুলিশ। গলিরমুখে অবস্থান নিয়ে পুলিশ কাউকে তিনটি পাড়ায় কাউকে ঢুকতেও দেয়নি আবার বের হতেও দেয়নি। সেইসঙ্গে শতশত পুলিশ হড়্রগাম পূর্বপাড়ায় অবস্থিত একটি বেসরকারি এনজিওর কার্যালয় থেকে দক্ষিণ দিকের সবগুলো বাড়িতে একে একে তল্লাশি করতে থাকে। পর্যায়ক্রমে টালিপাড়া ও টুলটুলি পাড়াতেও প্রতিটি বাড়িতে তল্লাশি করতে থাকে। বাড়ির সামনেও পুলিশ অবস্থান নেয় পুলিশ।

 

এসময় বাড়ির সদস্যদের কাউকেই বের হতে দেওয়া হয়নি। এভাবে সকাল নয়টার পর থেকে আর কাউকেই ওই এলাকাগুলো প্রত্যেকটি বাড়ির সদস্যদের আর কাউকে বাড়ির বাইরে বের হতে দেওয়া হয়নি। আবার গ্রামের ভিতরেও কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এমনকি মিডিয়াকর্মীদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি গ্রামের ভিতরে।

 
এতে করে পুরো এলাকাজুড়ে সাধারণ মানুষের মাঝে নেমে আসে ব্যাপক আত্মক। অনেকেই নয়টার পরে আর গ্রামে ঢুকতে না পেরে আশে-পাশের মোড়গুলোতে অবস্থান করতে থাকেন। শেষে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে অভিযান শেষ করে কয়েক শ পুলিশ সদস্য চলে গেলে স্থানীয়রা বাড়িতে ফেরেন।


হড়গ্রাম পূর্বপাড়ার বাসিন্দা সুমন হসেন গতকালের অভিযান শেষে সাংবাদিকদের বলছিলেন, ‘কি বলবো ভাই মনে হচ্ছিল, গৃহবন্দি হয়ে আছি। বাড়ির বাইরে বাজার করতেও যেতে পারিনি। ফলে কোনো মতে, যা ছিল, তাই দিয়েই কোনো মতে দুপুরের খাবার খেয়েছি। খুব আতঙ্কে ছিলাম। কি হবে, কি হচ্ছে ভেবে।’ তার বাড়িতে পুলিশ গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত দুইবার গিয়ে তল্লাশি করে বলেও দাবি করেন তিনি।

 
আরেক বাসিন্দা পল বিশ্বাস জানান, তার ৫ তলা বাড়ির প্রত্যেকটি ফ্লাতে তল্লাশি করেছে পুলিশ। কিন্তু কিছু পাইনি। তবে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাড়ির কোনো সদস্যকে বাইরে যেতে দেওয়া হয়নি। এতে করে নারী ও শিশুদের মধ্যে বেশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে।

 
তিনি বলেন, ‘শত শত পুলিশ শুধু রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করছিল। কোথায় কি করছিল, কিছু বলতে পারবো না। কারণ আমরা সবাই বাড়ির মধ্যে আটকা ছিলমা। বাইরে একটু দূরে কি হচ্ছিল, বলতে পারবো না।’

 
আরেক বাড়ির সদস্য মনির হোসেন জানান, ‘তিনি একটি ওষুধ কম্পানীতে চাকরি করেন। তার ওষুধের প্রতিটি বাক্স তল্লাশি করেছে পুলিশ। দুই দুইবার তার ভাড়া বাড়িতে ঢুকে তল্লাশি করা হয়েছে। কিন্তু কিছু না পেয়ে পরে চলে গেছে। তবে কাউকে বাড়ির বাইরে বের হতে দেওয়া হয়নি।

 
ওই বাড়ির মালিত রিতা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী পুলিশ সদস্য। কিন্তু তারপরেও আমি চরম আতঙ্কে ছিলাম কি হচ্ছে কি হবে ভেবে। কিন্তু াভিযান শেষ হওয়ার পরে অনেকটা স্বস্তি ফিরে পায়। মনে হচ্ছে এখন মুক্ত হলাম।’

 
স্থানীয় আরেক নারী রুবি বেগম (৫৮) বলেন, ‘বাড়ির বাইরে যেতে না পারাই দুপুরে নূন-তেল দিয়ে কোনো মতে ভাত খেয়েছি। কারণ আমরা দিন আনি দিন খাই। বাইরে যেতে চাইলে পুলিশ বলেছে, আজ ভাত খেতে হবে না। যা আছে তাই খান।’

 

তিনি আরো বলেন, ‘তারপরেও আমাদের ভালো লাগছে যেনে যে, এই এলাকায় কোনো জঙ্গি পাওয়া যায়নি। তারা থাকলে হয়তো আতঙ্কটা আরো বেড়ে যেত।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুত কয়েকজন এলাকাবাসী বলেন, ‘সারাদেশের মতো আমাদের এলাকাতেও কিছুটা হলেও আতঙ্ক ছিল। মঙ্গলবার সকালের পর সেই আতঙ্ক পুলিশ আরো বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু দিন শেষে খুব ভালো লাগছে যে এখন অন্তত এলাকাটি জঙ্গিমুক্ত হলো। হয়তো আস্তানা থাকলেও এলাকাবাসী কেউ জানতেই পারতো না, কিন্তু আতঙ্ক মাথায় নিয়ে থাকতে হতো। এখন পুরো এলাকার বাড়ি বাড়ি তল্লাশি করে কোনো জঙ্গি আস্তানা বা জঙ্গি না পাওয়ায় মহল্লাবাসীর মাঝেও স্বস্তি ফিরে এসেছে।’
এদিকে রাজশাহী মহানগর পুলিশের মুখপাত্র ইফতে খায়ের আলম বলেন, ‘সকাল নয়টার পর থেকে নগরীর কোর্ট কলেজের সামনে থেকে হড়গ্রাম পূর্বপাড়ার অন্তত সাড়ে তিনশ বাড়িতে অভিযান চালানো হয়। তবে এসময় কাউকে আটক বা কোনো কিছু উদ্ধার করা যায়নি। বাড়ি ভাড়াটিয়াদের তথ্য ফরম অনুযায়ী কিছু তথ্যের ভিত্তিতেই ওই এলাকায় ব্লক রেড দেওয়া হয়। প্রিভেনশন এয়ারনেস’র (প্রতিরোধ সচেততা) অংশ হিসেবেই এ অভিযান চালানো হয় বলেও দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।

 
এদিকে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের রাজশাহীর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তৌহিদুল আরিফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘ওই অভিযানের সময় সোয়াট এবং কাউন্টার টেরোরিজমের সদস্যরাও অংশ নিয়েছিলেন। তবে তারা কোথায় অভিযান চালিয়েছেন, তা বলতে পারবো না’।

 
তবে স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, সোয়াট ও কাউন্টার টেরোরিজম দলের সদস্যরা চারটি সিলভার কালার হাইস মাইক্রোযোগে রাজশাহীতে আসেন। তারা ওই এলাকায় অভিযানও চালান। তবে দুপুরের মধ্যেই তারা ফিরে যান। তারা দুজনকে আটক করে নিয়ে যায় বলেও দাবি করেছে স্থানীয় সূত্রগুলো।

 
পুলিশের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, সোমবার রাতেই সোয়াট ও কাউন্টার টেরোরিজমের সদস্যরা রাজশাহীতে যান। পরে সকালে তারা নগরীর হড়গ্রাম পূর্বপাড়া এলাকায় অভিযানে নামেন। তারা দুপুর সাড়ে ১২টার মধ্যেই অভিযান শেষ করেন।
স/আর