রাজশাহীতে সংসদ নির্বাচনকেন্দ্রীক ক্রমেই উত্তপ্ত হচ্ছে আ.লীগের রাজনীতি

নিজস্ব প্রতিবেদক:
আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে রাজশাহীতে ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠছে আওয়ামী লীগের রাজনীতি। ছোট-খাটো ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য মাথাচাড়া দিচ্ছে দলটির স্থানীয় নেতাকর্মীদের মাঝে। এ নিয়ে কখনো কখনো হামলা-পাল্টাহামলার ঘটনাও ঘটছে দিনকে দিন। আবার কোথাও কোথাও কর্মসূচি পাল্টা কর্মসূচি দেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে কেউ কেউ নির্বাচনী প্রচার-প্ররণাতেও নেমে পড়েছেন।

 

  • এসবই হচ্ছে আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই। রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী), রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর), রাজশাহী-৪ (বাগমারা) ও রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে নেতাকর্মীদের মাঝে বিভেদ ছড়িয়ে পড়েছে প্রকাশ্যে। এসব আসনে দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যেও লবিং-গ্রুপিং অনেকটা চরম আকার ধারণ করেছে।

 
অন্যদিকে সদর আসনে ওয়াকার্স পার্টি পার্থী ফজলে হোসেন বাদশার পরিবর্তে দলীয় প্রার্থীর দাবিতে মাঠে নামছে আওয়ামী লীগ। ফলে মহাজোটের সঙ্গে এ নিয়ে বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।

 

  • রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনে এরই মধ্যে এমপি ওমর ফারুক চৌধূরীর বিরুদ্ধে প্রকাশে মাঠে নেমেছে অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিআইজি মতিউর রহমান আগামী সংসদ নির্বাচন ঘিরে এরই মধ্যে প্রচার-প্রচারণাই নেমে পড়েছেন। ফারুক চৌধূরীকে সরিয়ে তাঁর আসনে দলীয় মনোনয়ন পেতে কাজ শুরু করেছেন মতিউর রহমান। এ নিয়ে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে দেখা দিয়েছে দ্বিধাবিভক্তি।

 
রাজশাহী-২ (সদর) আসনে বর্তমান এমপি রয়েছেন ওয়াকার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা। তবে এমপি হয়েও সদরে উন্নয়নে তেমন কোনো ভূমিকা না রাখতে পারায় মহাজোট থেকে মনোনয়ন পাওয়া বাদশাকে সরিয়ে আগামি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর দাবি জানিয়েছে মহানগর ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা। সম্প্রতি এ নিয়ে কেন্দ্রেও নানাভাবে বার্তা পাঠিয়েছেন তাঁরা।

 

  • সর্বশেষ গত ৪ মার্চ রাজশাহীতে প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম সফরে এলে তাঁর কাছেও একই দাবি জানান এখানকার নেতারা। এতে করে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে মহাজোটের সরিক দল ওয়াকার্স পার্টির নেতাকর্মীদের মধ্যে দেখা দিয়েছে মতবিরোধ। সম্প্রতি মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ডাবলু সরকার ও এমপি ফজলে হোসেন বাদশার মধ্যে প্রকাশ্যে বিরোধও ছড়িয়ে পড়ে। এ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দিতেও শোনা যায়।   

 
রাজশাহী-৩ (পবা-মোহনপুর) আসনের মনোনয়ন নিয়ে এমপি আয়েন উদ্দিন ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক বিরোধ। দুই নেতার কর্মী-সমর্থকরা দ্বিধা-বিভক্ত। চলে এলাকায় পাল্টাপাল্টি মিছিল-মিটিং থেকে শুরু করে দলীয় কর্মসূচিও পালনও।

 

  • সম্প্রতি পবার কাপাশিয়া এলাকায় স্থানীয় এমপি আয়েন উদ্দিন গ্রুপ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া ও মঞ্চ ভাংচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার পরে আয়েন উদ্দিনের অনুসারীদের সঙ্গে আসাদ গ্রুপের অনুসারীদের কোন্দল এখন বড় আকার ধারণ করতে চলেছে।

 

এই দুই গ্রুপের কোন্দল বিরাজমান গত সংসদ নির্বাচনের পরপরই চলে আসছে। তবে সামনের সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে ওই আসনে দলীয় মনোনয়ন পেতে সেই বিরোধ এখন চরম পর্যায়ে গিয়ে ছড়াচ্ছে। কেউ কাউকেই ছাড়তে দিত যেন নারাজ উভয়পক্ষই। আসাদের কৌশল হলো, যে কোনো উপায়ে আয়েন উদ্দিনের পরিবর্তে তার আসন দখল করা।

 

অপরদিকে তরুণ এমপি আয়েন উদ্দিনও চাইছেন যে কোনোভাবেই হোক, তার আসনে তিনি ছাড়া কাউকে ঢুকতে না দেওয়া। আর এ নিয়েই দুই গ্রুপের মধ্যে একের পর এক কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে।

 

  • দলীয় সূত্রগুলো বলছে, গত ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহীতে অনুষ্ঠিত হয় আওয়ামী লীগে বিভাগীয় কাউন্সিল। ওই কাউন্সিলে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দিতে এলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবাইদুল কাদেরের কাছেও এমপি আয়েনের বিরুদ্ধে নালিশ করেন আসাদুজ্জামান এবং তার অনুসারীরা। তবে পাল্টা আসাদের বিরুদ্ধে দলে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির নানা অভিযোগ তুলেন এমপির লোকজন।

 

পাল্পাপাল্টি এ অভিযোগের পরে আসাদকেই শেষে সতর্ক হওয়ার নির্দেশ দেন ওবাইদুল কাদের।এরপর আসাদ গত ৪ মার্চ এইচটি ইমামের কাছে তার অনুসারীদের দিয়ে ফের এমপি আয়েনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে নেন। তবে দলীয় সূত্রগুলো বলছে, কেন্দ্রে আসাদের চেয়ে এখনো আয়েনের অবস্থানই ভাল।

 

  • আসাদ পবা-মোহনপুরের আসনে নির্বাচন করার জন্যই একের পর এক নানা ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনার জন্ম দিচ্ছেন বলেও দাবি করেন এমপি আয়েন উদ্দিন।   

 
রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সংসদ নির্বাচনকে ঘিরেও এমপি এনামুল গ্রুপ ও উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাকিরুল ইসলাম সান্টু গ্রুপও মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। সম্প্রতি এমপি এনামুলকে তাহেরপুরে অবাঞ্চিত ঘোষণা করেন তাহেরপুর পৌরসভার মেয়র ও তাহেরপুর পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ। আবুল কালাম আজাদ হলেন উপজেলা চেয়ারম্যান সান্টু গ্রুপের নেতা। এ নিয়ে ওইদিন দুই গ্রুপের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। পরে অতিরিক্ত পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

 

  • এর বাইরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া ইউনিয়নে নির্বাচনকে ঘিরেও দুই গ্রুপ মুখোমুখি অবস্থান নেয়। এর প্রতিবাদে পাল্টাপালি বিক্ষোভ মিছিলসহ ঝাড়– মিছিলও অনুষ্ঠিত হয় বাগমারায়।

 
রাজশাহী-৫ (পুঠিয়া-দুর্গাপুর) আসনে বর্তমান সংসদ সদস্য আব্দুল ওয়াদুদ দারার সঙ্গে মতবিরোধ চলে আসছে সাবেক এমপি তাজুল ইসলাম মোহাম্মদ ফারুক গ্রুপের। সম্প্রতি এ নিয়ে দুর্গাপুরের দাওকান্দিতে সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। ওইদিন এমপি ওয়াদুদের গাড়ী বহরেও হামলা করে প্রতিপক্ষ আব্দুল মজিদ গ্রুপের নেতাকর্মীরা। আব্দুল মজিদ তাজুল ইসলাম ফারুকের অনুসারী বলে জানা গেছে। এর বাইরে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হওয়া পৌর নির্বাচনেও দুই গ্রুপের মধ্যে চরম মতবিরোধ ফুটে উঠে।

 

  • রাজশাহী-৬ (বাঘা-চারঘাট) আসনে বর্তমানে প্রকাশ্যে কোনো বিরোধ দেখা না দিলেও সাবেক এমপি রায়হানুল আলমের অনুসারীরা ঘাপটি মেরে আছেন বলেও জানিয়েছেন দলীয় নেতাকর্মীরা। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের ভয়ে কেউ মুখ খোলার সাহস না পেলেও দলের নেতাকর্মীদের মাঝে রয়েছে চরম বিভেদ। যা আগামী নির্বাচনের আগে প্রকট আকার ধারণ করতে পারে বলেও দাবি করেছেন এখানকার নেতাকর্মীরা।

 
রাজশাহীতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মাঝে মতবিরোধ নিয়ে জানতে চাইলে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান আসাদ বলেন, আওয়ামী লীগে প্রার্থীর ওভাব থাকে না। তাই নির্বাচনের আগে দলের নেতাকর্মীদের মাঝে এ নিয়ে বিভক্তি দেয় চরমে। সাধারণত দলের মনোনয়ন পেতেই এই ধরনের বিভক্তি হয়ে থাকে। তবে দল যাকে মনোনয়ন দেয়, তখন সব নেতাকর্মী তার হয়েই কাজ করেন। তখন আর বিভেদ থাকে না। এখানেও থাকবে না।

 
জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘সদর আসনে মহাজোট থেকে যাকে প্রার্থী হিসেবে দেওয়া হবে-আওয়ামী লীগ তার হয়েই কাজ করবে। এখানে ব্যক্তিগতভাবে আমার কিছু বলার নাই। তবে জেলার কোথাও কোথাও সমস্যা আছে, সেগুলো নিরসনের জন্য জেলার নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

স/আর