রাজশাহীর রাস্তায় মাসে কোটি টাকা চাঁদা ওঠে ট্রাক থেকে, যায় নেতাদের পকেটে

নিজস্ব প্রতিবেদক:

রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জ মহাসড়ক রোড ঘিরে প্রতিদিন স্বাভাবিক সময়ে গড়ে অন্তত চার হাজার ট্রাক চলাচল করে। আর প্রতিটি ট্রাক থেকে ৫০ টাকা করে দুটি স্থানে মোট ১০০ টাকা চাঁদা আদায় করে দুটি গ্রুপ। এই টাকার একটি অংশ যায় ট্রাক টার্মিনালের নামে বাস শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি কামাল হোসেন রবি’র পকেটে। আরেকটি অংশ যায় ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের পকেটে। নগরীর কাশিয়াডাঙ্গাতে ট্রাকপ্রতি ৫০ টাকা করে চাঁদা তুলেন শ্রমিক ইউনিয়নের কর্মীরা। আর নগরীর ট্রাক টার্মিনালের সামনে চলন্ত গাড়ি থেকে টার্মিনাল ফি’র নামে চাঁদা তুলেন কামাল হোসেন রবির লোকেরা। কিন্তু দেশের এই ক্রান্তিকালে ট্রাক শ্রমিকদের কল্যাণে সেই টাকা ব্যয় না করে লুটপাট করে নিচ্ছেন নেতারা।

টাকার হিসেব চাইতে গেলে গত শুক্রবার উল্টো শ্রমিকদের ওপরই চড়াও হয় ইউনিয়নের নেতারা। এসময় হার্টঅ্যাটাকে একজন মারা গেলেও পুলিশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের নেতাদের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেয়নি। তবে আজ রবিবার শ্রমকিদের নামে উত্তোলনকৃত চাঁদার টাকার হিসেবে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তবে শ্রমিকদের আশঙ্কা মাসে শুধু ট্রাক শ্রমিকদের নামেই যে প্রায় অর্ধকোটি টাকা চাঁদা ওঠে, তার সঠিক হিসেব দিতে পারবেন না ট্রাক ও ক্রার্ভাড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। কারণ এই টাকার অন্তত ৯০ ভাগেরও বেশি তারা লুটেপুটে খেয়েছেন। আর কিছু অংশ তারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে বিভিন্ন জায়গায় বিতরণ করেন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান শ্রমিক ইউনিয়নের পাঁচ নেতা লুটপাট করছেন কাশিয়াডাঙ্গা থেকে ট্রাকপ্রতি ৫০ টাকা করে উত্তোলনকৃত চাঁদা। তারা হলেন, সমিতির সভাপতি ফরিদ আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক আক্কাছ আলী, কোষাধ্যক্ষ মোহাম্মদ পলক ও সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ ফারুক হোসেন। এর বাইরে রাজশাহীর বাফার গোডাউন থেকেও ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক গ্রুপের সভাপতি রবিউল ইসলামের নেতৃত্বে উত্তোলন হয় ৫০ টাকা করে চাঁদা।

আর ট্রাক টার্মিনালের নামে নগরীর নওদাপাড়া থেকে ট্রাকপ্রতি ৫০ টাকা করে উত্তোলনকৃত চাঁদা লুটপাট করছেন কামাল হোসেন রবিসহ আরডিএ’র কর্মকর্তারা। তিনটি স্থান থেকে প্রতি মাসে গড়ে অন্তত এক কোটি টাকা চাঁদা উত্তোলন হয়। আর সব টাকায় হচ্ছে লুটপাট। যাচ্ছে নেতাদের পকেটে।  

 

প্রসঙ্গত, গত বছরের ৫ ফেব্রুয়ারি রাতে নগরীর নওদাপাড়া আমচত্তর এলাকায় লাঠি হাতে নিয়ে ট্রাক থেকে চাঁদা তুলতে গিয়ে ট্রাকের ধাক্কায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান রাজশাহী ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের প্রচার সম্পাদক শামীম হোসেন। তারপরেও থামেনি চাঁদা আদায়। শ্রমিকরা রাত-দিন লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে রাস্তা থেকে জোর করে ট্রাক থেকে চাঁদা আদায় করলেও সেই টাকাই হচ্ছে লুটপাট।

গতকাল শনিবার সকালে সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, নগরীর কাশিয়াডাঙ্গা এলাকায় ও নওদপাড়া ট্রাক টার্মিনালের সামনে ৫-৬ জন লোক লাঠি ও রড হাতে নিয়ে রাজশাহী সিটি বাইপাশ দিয়ে যাওয়া সকল ট্রাক থেকে জোর করে চাঁদা তুলছে। ট্রাকগুলোকে জোর করে থামিয়ে চালকদের নিকট থেকে ৫০ টাকা করে ১০০ টাকা চাঁদা নেওয়া হচ্ছে। এমনকি কৃষিপণ্যবাহী ট্রাক থেকেও উত্তোলন হচ্ছে চাঁদা। অথচ এই ট্রাকগুলো ছুটে যাচ্ছে বিভিন্ন গন্তব্যে। চাঁদা আদায়ের জন্য রাস্তার ধারে ফুটপাতের ওপরে একটি ঘরও নির্মাণ করা হয়েছে।

চাঁদার হিসেব চাইতে গেলে গত রবিবার শ্রমিকদের ওপর চড়াও হন ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারা। এসময় হার্ট অ্যাটাকে মারা যান সোহরাব হোসেন নামের একজন।

চাঁদাবাজিতে ব্যস্ত একজন ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এই ট্রাক টার্মিনালটি লিজ নিয়েছেন রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কামাল হোসেন রবি। তাঁর নির্দেশেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে সকল ট্রাক থেকে তারা চাঁদা উত্তোলন করছে ৫০ টাকা করে। প্রতিদিন রাজশাহীতে প্রবেশকারী অন্তত ৪ হাজার ট্রাক থেকে সমানে চাঁদা উত্তোলন করা হচ্ছে। তবে করোনার কারণে এখন কিছুটা সংখ্যা কমে গেছে ট্রাকে। তার পরেও দিনে অন্তত ২ হাজার টাক চলাচল করছে। এর মধ্যে ১০টি ট্রাকও প্রবেশ করানো হয় ট্রাক টার্মিনালে। কিন্তু প্রতিটি ট্রাক থেকেই উত্তোলন করা হচ্ছে চাঁদা। আর সেই টাকা হচ্ছে লুটপাট। সবমিলিয়ে শুধু ট্রাক টার্মিনালের নামেই অন্তত আড়াই লাখ টাকা চাঁদা উঠছে প্রতিদিন।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ছেড়ে আসা পণ্যবাহী ট্রাকের চালক নজরুল খান বলেন, ‘আমার মালবাহী ট্রাকটি যাবে ঢাকায়। কিন্তু রাজশাহী ট্রাক টার্মিনালের নামে চাঁদা দিতে হলো ৫০ টাকা। আবার ট্রাক শ্রমিকদের নামে দিতে হলো আরো ৫০ টাকা। সবমিলিয়ে দুটি স্লিপ ধরিয়ে দিয়ে ১০০ টাকা করে আদায় করা হলো। কিন্তু করোনার কারণে অনেক ট্রাক চালক এখন ঘরে বসে আছেন। সেই শ্রমিকদের জন্য কোনো অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে না ইউনিয়ন থেকে। সব টাকা লুটেপুটে খেয়ে নিয়েছেন হয়তো নেতারা। এই নেতাদের একসময়ে কিছুই ছিল না। তারাও কেউ ট্রাকের চালক বা হেলপার ছিল। কেউ বা দালালি করত। এখন কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন ট্রাক থেকে উত্তোলনকৃত চাঁদার টাকা লুটপাট করে। অথচ শ্রমিকরা এই দুর্যোগে অনেকেই না খেয়ে আছেন।’

 

আরেক ট্রাক চালক লালন হোসেন বলেন, ‘এতো টাকা চাঁদা ওঠে, সেই টাকাগুলো যায় কোথায়? প্রতি মাসে তো অন্তত কোটি টাকা চাঁদা ওঠে। সবটাকায় হয় লুটপাট। নিজেদের সম্পদ গড়ছেন সেই টাকা দিয়ে নেতারা। শুনেছি ক্ষমতায় টিকে থাকতে তারা কিছু টাকা বিভিন্ন দপ্তরেও বিতরণ করে। এ কারণে চাঁদায় শ্রমিকদের কোনো কল্যাণ না হলেও ঠিকই বছরের পর বছর ধরে রাজশাহীর রাস্তায় উঠছে কোটি কোটি টাকা।’ 

অপর এক ট্রাক চালক মুজাহার আলী বলেন, টাকা না দিয়ে পার হওয়ার কোনো উপায় নাই। একেবারে জোর করে টাকা আদায় করা হয়। টাকার জন্য একেবারে ট্রাকের সামনে এসে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে যায় আদায়কারীরা। এভাবে কখনো ট্রাক নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও থেকে যায়। কিন্তু আমরা কোনো বিপদে পড়লে ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়ন থেকে কোনো সহযোগিতা করা হয়  না।’


রাস্তায় চাঁদা আদায় সম্পর্কে জানতে চাইলে রাজশাহী ট্রাক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ফরিদ আহমেদ বলেন, ‘আমাদের টাকা ব্যয় হয় মালিক-শ্রমিকদের কল্যাণেই। কিন্তু আমাদের বাইরেও রাস্তায় নেমে জোর করে টাকা আদায় হয় ট্রাক থেকে। এই টাকার কোনো হিসেব নাই। আমরা আমাদের টাকার হিসেব দিব রবিবারে।’

রাজশাহী মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাবেক সভাপতি কামাল হোসেন রবি বলেন, অধিকাংশ টাকায় উত্তোলন হয় ট্রাক মালিক-শ্রমিকের নামে। শুধুমাত্র ৫০ টাকা করে উত্তোলন হয় ট্রাক টার্মিনালের নামে। তাও যেসব ট্রাক রাজশাহীর বাইরে থেকে আসে, কেবল সেগুলো থেকেই আমরা চাঁদা তুলি। রাজশাহীর ট্রাক চালকরা চাঁদা দিতে চায় না।’

রাস্তায় ট্রাক থেকে চাঁদাবাজি সম্পর্কে জানতে চাইলে মহানগর পুলিশের মুখপাত্র গোলাম রুহুল কুদ্দুস সম্প্রতি বলেন, ‘শ্রমিকরা চাঁদা উঠালে আমরা কি করবো। এটা তাদের নিজস্ব ব্যাপার। আর ট্রাক টার্মিনালের চাঁদা কিভাবে উঠছে সেটি খতিয়ে দেখা হবে।’

স/আর

আরও পড়ুন”

রাজশাহীতে নেতাদের সঙ্গে ট্রাক শ্রমিকদের হাতাহাতি, অসুস্থ হয়ে একজনের মৃত্যু