রাজশাহীতে প্রতিদিন কোটি টাকা লেনদেন জুয়ার আসরে, নি:স্ব হচ্ছে মানুষ

নিজস্ব প্রতিবেদক:
গতকাল দুপুর দুইটা। রাজশাহী নগরীর গোবিন্দপুর ওয়াপদা মাঠে গিয়ে দেখা যায়, এখানে ৩০-৪০ জন লোক গোল করে বসে আছে। তার মাঝখানে বসে একজন লোক টাস হাতে নিয়ে একের পর কল করছে। আর তার কলের আগেই হাজার টাকা সামনে ফেলে রাখছে অন্যরা। কিছুক্ষণ পরে আরেকজন লোক তাস নিয়ে কল করে যাচ্ছে আগেরজনের মতো। আবার একইভাবে টাকা পড়ছে বোর্ডে। কল শেষেই মাটিতে ফেলে দিচ্ছে তাস।

এরপর টাকাগুলো হচ্ছে ভাগ-বাটোয়ারা। এভাবে পর্যায়ক্রমে একের পর এক বিট চলছে। সেই পড়ছে হাজার হাজার টাকা। প্রায় আধা ঘন্টা ধরে সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে এই দৃশ্য দেখা যায়। আর এই সময়ের মধ্যে ওই জুয়ার আসরে অন্তত লক্ষাধিক টাকার লেনদেন হতে দেখা যায়। এরই মধ্যে কেউ কেউ বাজিতে হেরে উঠে চলে যাচ্ছে। আবার কেউ এসে যোগ দিচ্ছে।

  • অনুসন্ধানে জানা গেছে, শুরু গোবিন্দপুরের ওয়াপদা মাঠের এই আসরটিই নয়, রাজশাহী নগরীর অন্তত ১০টি পয়েন্টে এভাবে প্রতিদিন বসছে জুয়ার আসর। আর এসব আসরে সবমিলিয়ে অন্তত কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। কোথাও বসছে তাসের মাধ্যমে জুয়ার আসর, আবার কোথাও বসছে টিভিতে সম্প্রচারিতে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার মাধ্যমে জুয়ার আসর। এসব আসরে বুদ হয়ে নি:স্ব হতে হচ্ছে অনেককেই। কিন্তু তারপরেও ভাঙছে না আসর। বরং স্থানীয় পুলিশকে ম্যানেজ করেই চলছে এসব আসর।

এতে করে নি:স্ব হতে হচ্ছে এক শ্রেণির মানুষকে। প্রক্ষান্তরে জুয়ার আসর বসিয়ে মাঝখান থেকে লাখ লাখ টাকা আয় করে রাতারাতি লাখোপতি বনে যাচ্ছেন অনেকেই। এদের অনেকেই বাড়ি-গাড়ীরও মালিক এখন। অথচ দুই-এক বছর আগেও এদের সহায়-সম্বল কিছুই ছিল না। কেউ বস্তিতে থেকেই শুধু জুয়ার আসর বসিয়ে লাখোপতি গেছেন এমন ঘটনাও ঘটেছে।

একটি জুয়ার আসরে পড়ে আছে তাস আর টাকা। গোপনে মোবাইল ক্যামেরাই তোলা ছবি।

সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, নগরীর রাজপাড়া থানার গোবিন্দপুর এলাকার ওয়াবদা মাঠ, বন্ধগেট এলাকা, কোর্টবাজার কাঁচাবাজার, বুলনপুরে রেজাউলের বাড়িতে, আলীর মোড়, রায়াপাড়া ঘুঘুপাড়া, চারখুটার মোড়, লক্ষীপুর, ডাসমারি এবং বোয়ালিয়া থানার রাজশাহী শিরোইল বাসস্ট্যান্ড ও শালবাগান মোড় এলাকায় রমরমা জুয়ার আসর বসছে প্রতিদিন। ডাসমারি লক্ষীপুর এবং শালবাগান মোড়ে বসছে টিভিতে সম্প্রচারিত খেলার মাধ্যমে জুয়ার আসর। আর অন্যগুলোতে চলছে তাসের মাধ্যমে।

এসব আসরে প্রতিদিন সমবমিয়ে অন্তত কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে। রাজশাহীর বিভিন্ন ঠিকাদার থেকে শুরু করে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ মোটরসাইকেল এবং প্রাইভেটকার নিয়ে গিয়েও এসব জুয়ার আসরে যোগ দিচ্ছে। তবে জুয়ার আসর থেকে গাড়ীগুলো রাখা হয় একটু নিরাপদ দূরুত্বে।

জুয়ার আসরগুলো স্থানীয় থানা পুলিশকে ম্যানেজ করে বসে বস্তির গলির মধ্যে খুপরি বাড়িতে অথবা কোথাও প্রক্যাশে মাঠের মধ্যে। এসব আসরে প্রতিদিন অন্তত ৫০০ জুয়াড়ি যোগ দিচ্ছে জুয়া খেলতে। তাসের মাধ্যমে এই জুয়াগুলো পরিচালিত হচ্ছে। আর সবগুলো আসর স্থানীয়রা বসাচ্ছে। তাতে অংশ নিচ্ছে শহর ছাড়া জেলার বিভিন্ন এলাকার লোকজন।

  • অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, প্রতিদিন সকাল থেকেই কোনো আসর শুরু হচ্ছে। আবার কোনো কোনো আসর বসছে সন্ধ্যার পরপরই। সন্ধ্যার পর বসা আসরগুলো চলে একেবারে ভোর পর্যন্ত। এসব আসরে যোগ দেয় রাজশাহী শহরের জুয়াড়িরা। আবার দিনে বসা আসরগুলোতেও তারা যোগ দিয়ে থাকে। দিনের আসরগুলোতে নগরীর বাইরের লোকজনও এসে যোগ দিয়ে থাকে।

এর বাইরে টিভিতে ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার মাধ্যমে জুয়ার আসর বসান ডাসমারির সোহেল এবং শাহ আলমগীর। তাদের নিয়ন্ত্রণে দুটি আসরে প্রতিদিন অন্তত ২০ লাখ টাকার লেনদেন হয়।

  • একটি জুয়ার বোর্ডের নিয়ন্ত্রণকারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, স্থানীয় থানায় প্রতি সপ্তাহে তাকে জুয়া চালানোর জন্য দিতে ৩ হাজার টাকা। এর বাইরে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশকে দিতে হয় ২ হাজার টাকা। প্রতি সপ্তাহে থানার এবং গোয়েন্দা পুলিশের ক্যাশিয়াররা এসে টাকা নিয়ে যায়। টাকা দেওয়ার কারণেই নির্বিঘ্নে জুয়ার আসর চালাতে পারেন তিনি।

ওই জুয়ার নিয়ন্ত্রক আরো জানান, বর্তমান পুলিশ কমিশনার আসার পরে এখন আর প্রক্যাশে জুয়ার আসর তেমন বসে না। শুধুমাত্র গোবিন্দপুর ওয়াবদা মাঠ এবং শিরোইল বাসস্ট্যান্ড ছাড়া আর কোথাও প্রকাশ্যে জুয়ার আসর বসানো যায় না। এসব আসর সবগুলোই বসে ওইসব এলাকার বস্তির মধ্যে। বস্তির চিকন গুলির মাঝখানে বাড়ির মধ্যে। আর বাইরে বিভিন্ন পয়েন্ট পাহারা দিতে লোক বসানো থাকে। সেইরকম কোনো আভাস পাওয়া মাত্র জুয়াড়িদের আস্তে করে ঘর থেকে বের করে দেওয়া হয়। ফলে কখনো কখনো অন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযানে গেলেও তার আগেই টের পেয়ে জুয়াড়িরা সাবধানে সটকে পড়ে।

  • জানা গেছে, জুয়ার কারণে রাজশাহী নগরীর শতশত মানুষ নি:স্ব হতে চলেছে। কেউ কেউ পথে বসেছে। কোনো কোনো প্রথম শ্যেণির ঠিকাদারও সহায়-সম্বল হারিয়ে ঋণদেনায় জর্জরিত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু জুয়ার আসর নিয়ন্ত্রণকারীরা রাতারাতি লাখোপতি বনে গেছেন।

গতকাল দুপুরে গোবিন্দপুরের জুয়ার আসরে খেলা শেষে চলে যাওয়ার সময় আলফোর রহমান নামের এক ব্যক্তি বলেন, ‘তার এক সময় ৪টি অটোরিকশা ছিল। পৈত্রিক সূত্রে বেশকিছু জমিও ছিল। একটি বাড়িও রয়েছে নগরীতে। কিন্তু এখন বাড়ি ছাড়া আর কিছুই নাই। তবে পারিবারিক সম্মানের ভয়ে ওই ব্যক্তি আর কিছু জানাতে চাননি। যদিও গত প্রায় দেড় বছর ধরে প্রতিদিন জুয়া খেলে থাকেন আলফোর রহমান।’


পরিচয় গোপন করে কথা হয় আরেক ব্যক্তি সেলিম হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এখন পেশা বলতেই জুয়া খেলা। কোনোদিন সব টাকা হেরে বাড়িতে যায়। আবার কখনো কখনো কিছু টাকা জিতে বাড়িতে যায়। তবে হারার পরিমাণও বেশি। কিন্তু তার পরেও নেশার টানে ছুটে আসি এখানে।

  • তিনি আরো জানান, ‘এখানে যারা আসে তারা নেশার টানেই মূলত আসে। টাকা থাকলে ধার-দেনা করে বা সংসারের কোনোকিছু বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করে হলেও জুয়ার আসরে যোগ দেন জুয়াড়িরা। কখনো কখনো চড়া সুদে ঋণ নিয়েও যোগ দিচ্ছেন এ আসরে। এতে করে নি:স্ব হতে হচ্ছে অধিকাংশ জুয়াড়িকে। কিন্তু নেশার টানে তার পরেও প্রতিদিন শত শত জুয়াড়ি ছুটে আসছেন জুয়ার আসের।’

আরেক জুয়াড়ির বলেন, ‘জুয়া খেলা অবস্থায় পুলিশ সহযে কোনো আসরে অভিযান চালায় বলে জানা নাই। তবে খেলা শেষে বাড়ি যাওয়ার সময় অনেককে আটক করে। এরপর বিভিন্ন ধারায় মামলা দিয়ে বা টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এর কারণ হলো, আসরগুলো থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায় করা। তাই আসরে অভিযান না চালিয়ে বাইরে যাওয়ার সময় জুয়াড়িদের আটক করা হয়।রাজশাহী নগরীর অন্তত ১০টি পয়েন্টে জুয়ার আসরে প্রতিদিন অন্তত কোটি টাকার লেনদেন হচ্ছে পুলিশের প্রত্যক্ষ সহোগিতায়। ফলে দিনের পর দিন এই জুয়া অব্যাহতভাবে চলে আসছে।

নগরীর গোবিন্দপুর ওয়াবদা মাঠে জুয়ার আসর বসান একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সোর্স পরিচয়ধারী এক ব্যক্তি। তার দাপটের কারণে প্রকাশ্যেই এখানে প্রতিদিন বসে জুয়ার আসর। এছাড়াও অন্য আসরগুল্ওো বসে স্থানীয় পুলিশকে ম্যানেজ করে। তাসের মাধ্যমে চলে এসব জুয়ার আসর। গোল হয়ে বসে থাকে জুয়াড়িরা। আর একজনের হাতে থাকে তাস। এভাবেই চলে প্রতিদিন কোটি টাকার জুয়ার লেনদেন।

জানতে চাইলে রাজশাহী মহানগর পুলিশে মুখপাত্র ইফতে খায়ের আলম বলেন, ‘আমাদের থানাগুলোকে নির্দেশ দেওয়া আছে যে, কোনো ধরনের জুয়ার আসর বসানো যাবে না। মাঝে মাঝে আমরা রেইডও দিচ্ছি। বোয়ালিয়ার শিরোইল এলাকায় আমরা মাঝে মাঝেই অভিযান চালায়। কিন্তু তারপরেও কিছু ঘটনা ঘটছেই। এসব নিয়ে আমরা বড় ধরনের অভিযানে যাবো প্রয়োজনে।

স/আর