রাজনীতিতে নেতা আছে, নেই কর্মীবান্ধব ‘ব্যক্তিত্ব’

প্রবাদপ্রতিম নেতারা যেটা করেছিলেন, তাহলো- তারা কর্মী থেকেই নিজেদের পদে পদে ‘আবিষ্কার’ করেছিলেন।

পারিপার্শ্বিক পরিবেশের ওপর যাতে তাদের চিন্তাভাবনা প্রভাব বিস্তার করতে পারে, সেভাবেই নিজেদের ব্যক্তিত্ব গড়ে তুলেছেন। প্রত্যেকেই ছিলেন অসামান্য গুণের অধিকারী। তারা রেখে গিয়েছেন নিজেদের কৃতিত্বের স্বাক্ষর। কাল প্রমাণ করে দিয়েছে নেতৃত্ব দেয়ার ব্যাপারে তাদের অসামান্য দক্ষতার কথা। জীবনের যেকোনো ক্ষেত্রের প্রতি দৃষ্টি দিলে দেখা যায়, নেতারা সব সময়েই ‘হাজির’ হয়েছেন নিজেরা অনেক কিছু সহ্য করে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করতে। তারা কোন জাদুমন্ত্রের বলে সমস্ত গুণ অর্জন করেননি।

উইলিয়াম, আব্রাহাম লিংকন, নেপোলিয়ন, মহাত্মা গান্ধী, কামাল আতাতুর্ক, বঙ্গবন্ধু’র কথা নাই বা বললাম, আমাদের শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাসানী এমনকি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতার গুণ আর ব্যক্তিত্বের কথা ভাবুন না! আর এ সময়ের দিকে দৃষ্টি রাখলে তো বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সুদীর্ঘ নেতৃত্বেরও প্রশংসার দাবি রাখে।

 

কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তার সরকারের অধিকাংশ মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এবং দলীয় নেতা মনে করছেন, কর্তৃত্ব, ক্ষমতা জাহির করলেই বুঝি সেটা দক্ষতা। অন্যকে প্রভাবিত করার প্রতিভা বা ক্যারিশমা, জ্ঞান থাকলেই কেবল নেতা হওয়া যায় না। রাজনৈতিক সরকারের নেতৃত্বে দলীয় নেতৃত্বের গুণ অবশ্যই থাকতে হবে। যেহেতু দলীয় নেতৃত্বই ক্ষমতা লাভের উপায়। রাজনৈতিক বা সরকারের নেতৃত্বের অর্থ যদি হয় ঐকমত্য গড়ে তোলার ক্ষমতা এবং অভিন্ন লক্ষ্যের প্রতি দায়বদ্ধতা তাহলে তা বর্তমান নেতামন্ত্রীদের মধ্যে অধিকাংশেরই নেই। দলীয় কর্মীদের প্রভাবিত ও অনুপ্রাণিত করার লক্ষ্যে নেতৃত্বের কৌশল স্থির করতে না পারার কারণেই আজকের সংকট। সরকার থেকে দল বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণেই কর্মীরা ধর্ষণ, হত্যাসহ নানা অপরাধ কর্মে শামিল হচ্ছে। নেতারা প্রত্যেকেই দলের ‘টিম মেম্বর’। তাদের যাতে মেনে চলেন তার জন্য কর্মীদের আরও উন্নত করা বা ‘পার্সোনাল ডেভেলপমেন্ট’ এর ব্যাপারে নেতাকে আগ্রহ দেখানোর কথা। কর্মীদের দক্ষতা বোঝার মতো সূক্ষ্ম অনুভূতি নেতাদের থাকা চাই। নেতাকে মানসিকভাবে ধরে নিতে হবে অনুগামী হিসেবে কর্মীরা তার সঙ্গে দলের জন্য করছেন, তার জন্য কাজ করছেন না। সফল নেতারা সব সময় ভালো কাজ করার জন্য নিজেদের তৈরি করতে কর্মীদের প্রেরণা দিয়ে থাকেন। দলের ভেতরে এমন একটি পরিবেশ গড়ে তোলেন, যেখানে কর্মীরা দলীয় কার্যালয়ে সময় দেয়াটাকেই আনন্দের মনে করতো। কলেজ ছাত্রাবাসে অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার কুচিন্তা তাদের গ্রাস করতে পারতো না।  ভালো নেতা যে তত্ত্বে বিশ্বাস করে থাকেন, মহৎ কিছু অর্জন করতে হলে কর্মীদেরও বাঁচাতে হবে। কর্মীরা না বাঁচলে দল বাঁচবে না। নিজেদের প্রশংসা জাহির করার পাশাপাশি কর্মীদেরও প্রশংসা করতে শিখতে হবে। স্যামুয়েল জনসন খুব সম্ভবত এজন্যই বলেছেন, দলের বিশেষ ব্যক্তির (নেতার) প্রশংসা কর্মীকে অনেক দূর এগিয়ে যেতে সাহায্য করে। নেতা হবেন কর্মীদের ‘ফ্রেন্ড ফিলোসফার অ্যান্ড গাইড’।

নির্বাচন এলে ইচ্ছে মতো ব্যবহার আর ক্ষমতায় গিয়ে ভুলে যাওয়া এই নীতির কারণে সারাদেশে ছাত্রলীগের যুবলীগ কর্মীদের এই অবক্ষয় ঘটেছে।
সরকারের ভেতরে ব্যক্তিত্বের বড় অভাব। কজন মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন? দার্শনিকদের মতে, ব্যক্তিত্ব বলতে ব্যক্তির অন্তর্নিহিত এমন কিছু গুণাবলিকে বুঝিয়েছেন যা পর্যবেক্ষণযোগ্য আচরণ তৈরি করে। অর্থাৎ ব্যক্তিত্ব হচ্ছে মানুষের এমন কতিপয় ব্যক্তিক গুণাবলির সমষ্টি, যা অন্যের মনে রেখাপাত করে এবং অন্যকে আকৃষ্ট করে।

সাধারণত মানুষের আচরণ ও চলার স্বাতন্ত্র্য এবং অসাধারণত্বকেই ব্যক্তিত্বের লক্ষণ বলে মনে করা হয়। ব্যক্তির যেসব বৈশিষ্ট্য তাকে অন্য একজন ব্যক্তি থেকে পৃথক করে তোলে তাই তার ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিত্ব কোনো একক বৈশিষ্ট্য নয়, অনেক বৈশিষ্ট্যের সমাহারে মানুষের ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়।
এগুলো হচ্ছে বিশ্বাস, মূল্যবোধ, বুদ্ধি, আচার-আচরণ, কথাবার্তা, দৃষ্টিভঙ্গি ও কর্মক্ষমতা।

ব্যাপক অর্থে ব্যক্তিত্ব হচ্ছে ব্যক্তির সব বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণ। ব্যক্তির দৈহিক গঠন, চুলের গঠন, ধরণ, চেহারা, আবেগ অনুভূতি, ইচ্ছা, অনুভূতি শক্তি সামর্থ্য ও মূল্যবোধের সংমিশ্রণে ব্যক্তিত্ব তৈরি হয়। মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও আবেগ প্রবণতা তার ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। শিল্পকলা, সংস্কৃতি, খেলাধুলা, বইপত্র পাঠে আসক্তি ইত্যাদি ব্যক্তিত্বকে প্রভাবান্বিত করে। বুদ্ধিমান লোকের ব্যক্তিত্ব উচ্চমানের হয়। মানুষের মেজাজ কোমল অথবা কড়া হতে পারে। মেজাজ নির্ভর করে শারীরিক উপাদানের ওপর। স্নায়ুতন্ত্রের কাজ মেজাজ নিয়ন্ত্রণ করা। ফলে কেউ সদালাপী হয়, আবার কেউ খিটখিটে স্বভাবের হয়।

মানুষ বিভিন্ন সমাজ, পরিবার, ধর্ম ও শিক্ষা থেকে উঠে আসে তাই ব্যক্তিত্বের ভিন্নতা থাকাটাই স্বাভাবিক। যে কারণে একই সংগঠনে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা ব্যক্তিত্বের সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন। প্রতিটি মানুষ ছোটবেলা থেকেই দলবদ্ধ হয়। স্কুলের বন্ধু, খেলার সাথী, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং বাড়ন্ত বয়সে পেশাগত বা রাজনৈতিক সংগঠন ইত্যাদির সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে মানুষ ভিন্ন ধারণা লাভ করে যা তার ব্যক্তিত্বের উপর প্রভাব বিস্তার করে।

প্রত্যেক মানুষ যে সম্প্রদায়ের মধ্যে গড়ে ওঠে সে সম্প্রদায়ের মূল্যবোধ রীতিনীতি ঐতিহ্য আচার-আচরণ ইত্যাদি ব্যক্তিত্বকে প্রভাবিত করে। রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রীতিনীতিই একজন মানুষের রুচিবোধ ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার মাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। যে মানুষ যে ধর্মের অনুসারী সে অনুযায়ী তার ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে। ধর্ম মানুষকে উন্নত ব্যক্তিত্বের অধিকারী করে তোলে। রাষ্ট্র, রাজনীতি এসবের নিশ্চয়তা বিধান করবে। ব্যর্থ হলে ছাত্র, কিশোর তরুণদের সামনে কেবলই লক্ষ্যহীন জীবন ও স্বপ্নহীন ভবিষ্যৎ।

লেখকঃ সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।

 

সূত্রঃ বাংলাদেশ প্রতিদিন