রাঙ্গামাটি-বান্দরবানে নির্মূলেই ম্যালেরিয়ামুক্ত হবে দেশ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্কঃ

আজ ২৪ এপ্রিল, বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও পালন করা হচ্ছে দিবসটি। এবছর ম্যালেরিয়া দিবসের প্রতিপাদ্য ‘উদ্ভাবনী কাজে লাগাই, ম্যালেরিয়া রোধে জীবন বাচাই’। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশ সরকারও ম্যালেরিয়া নির্মূলে কাজ করে যাচ্ছে। ম্যালেরিয়া নির্মূলে নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং ব্যবহার করছে সরকার। সরকারের নানা পদক্ষেপে দেশে ম্যালেরিয়ার প্রকোপ সামগ্রিকভাবে কমে আসলেও একেবারে নির্মূল সম্ভব হয়ে ওঠেনি। বরং গত এক বছরে ম্যালেরিয়া রোগী বেড়েছে।ম্যালেরিয়া থেকে মুক্তিতে পাবর্ত্য এলাকা বড় বাধা বলে মনে করছেন স্বাস্থ্য সংশ্লিষ্টরা। তবে এসব অঞ্চলেও ম্যালেরিয়ার প্রকোপ কমিয়ে দেশে ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূল লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে আশাবাদী তারা।

সম্প্রতি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৬টি জেলার ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ রয়েছে। তবে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুহার সবেচেয়ে বেশি তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানে। এই তিন জেলাকে উচ্চ ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশের মোট ম্যালেরিয়া রোগীদের মধ্যে ৯৪ শতাংশই এ তিন জেলায়।

ম্যালেরিয়া মশাবাহিত একটি সংক্রামক রোগ। এর মূলে রয়েছে প্লাসমোডিয়াম নামে এক ধরনের পরজীবী। আর মশা এটি বহন করে থাকে। সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল যেখানে গরম ও আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি, সেসব অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব বেশি। এ কারণে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার হার বেশি।

মূলত অ্যানাফেলিস মশার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া সংক্রমণ ছড়ায়। মশার লালারসের মাধ্যমে রক্তে এবং লিভারে বংশবৃদ্ধি হয় ম্যালেরিয়ার জীবাণুর। এরপর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে আক্রান্তের শরীরে। পাশাপাশি মাথাব্যথা, দুর্বলতা বমিসহ আরও একাধিক উপসর্গ দেখা দেয়। সংক্রমণের মাত্রা তীব্র হলে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্ডিস, যকৃৎ ও প্লীহা বড় হওয়া, খিঁচুনি, কোমা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

দেশে ম্যালেরিয়া নির্মূলে কাজ করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ণন্ত্রণ কর্মসূচি। সংস্থাটি জানায়, ২০০৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত কমেছে ৯৪ শতাংশ এবং মৃত্যু কমেছে ৯৩ শতাংশ। দেশে ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে ১ হাজার ১৬৪ জন ম্যালেরিয়ার রোগী বেড়েছে। ২০২১ সালে ম্যালেরিয়া রোগী ছিল ৭ হাজার ২৯৪ জন। মৃত্যুবরণ করেছে ৯ জন। ২০২০ সালে রোগী শনাক্ত হয় ৬ হাজার ১৩০ জন এবং ৯ জনের মৃত্যু হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাসার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, ম্যালেরিয়া নির্মূলে সমন্বিতভাবে কাজ করা হচ্ছে। তিন পার্বত্য অঞ্চল ছাড়া বাকি জেলাগুলোতে ম্যালেয়িরা নির্মূল প্রায় সম্ভব হয়েছে। ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূল লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কাজ চলছে।

তিনি আরও বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী কোনো এলাকায় যদি পরপর তিন বছর ম্যালেরিয়ার স্থানীয় সংক্রমণ না থাকে, তখন সেই এলাকাকে ম্যালেরিয়ামুক্ত ঘোষণা করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছরে ম্যালেরিয়াপ্রবণ ১৩ জেলার ৭২ উপজেলার মধ্যে কমপক্ষে ৩০ থেকে ৩৫ উপজেলায় কোনো ম্যালেরিয়া রোগী পাওয়া যায়নি। এছাড়া অন্য উপজেলাগুলোতে এপিআই ১ পয়েন্টের নিচে বা ম্যালেরিয়া শূন্যের পথে এবং এসব রোগী স্থানীয়ভাবে সংক্রমিত নন। বাকি ৫১ জেলা আগে থেকেই ম্যালেরিয়ামুক্ত। ফলে শুধু রাঙ্গামাটি ও বান্দরবান জেলার কারণে ম্যালেরিয়ামুক্ত স্বীকৃতি চাইতে পারছে না বাংলাদেশ।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ও কীটতত্ত্ববিদ ড. কবিরুল বাশার বলেন, বাংলাদেশের একটা লক্ষ্যমাত্রা আছে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে ম্যালেরিয়ামুক্ত ঘোষণা করা। সেটা বাস্তবায়ন করতে হলে যে প্রক্রিয়াতে এখন ম্যালেরিয়া নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে, বিশেষ করে মশারি বিতরণ করে, শুধু এই একটি পদ্ধতিতে হবে না। আরও কিছু পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হবে। নতুন ওষুধের সন্ধান করতে হবে। মশারি ব্যবহারের নিয়মেও পরিবর্তন আনতে হবে।

রাঙ্গামাটি-বান্দরবানে নির্মূলেই ম্যালেরিয়ামুক্ত হবে দেশ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ বিভাগের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ) ড. ইকরামুল হক বলেন, এই মুহূর্তে যেটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো বান্দরবান ও রাঙ্গামাটি জেলায় ম্যালেরিয়া নির্মূল। ম্যালেরিয়া পরিমাপকের স্কেল আছে অ্যানুয়াল প্যারাসাইট ইনডেক্স (এপিআই), এটা একটা সূচক। এই সূচক দিয়ে আমরা এই রোগের মাত্রা ও সংক্রমণ কোন পর্যায়ে আছে, সেটা পরিমাপ করি। এই ইনডেক্সের মান যদি ১-এর নিচে থাকে, তখন একটা জেলা বা দেশ ম্যালেরিয়ামুক্ত বা শূন্যের পর্যায়ে আছে বলা যায়।

এই কর্মকর্তা জানান, দেশে ১১টি জেলার এপিআই ১-এর নিচে আছে। এই ১১ জেলা হলো- ময়মনসিংহ জোনে ৪টি জেলা- ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর ও শেরপুর। সিলেট জোনে সিলেট, হবিগঞ্জ, মৌলবীবাজার ও সুনামগঞ্জ। এই আটটি জেলায় ম্যালেরিয়া একেবারেই শূন্যের কোঠায়। এসব জেলায় বছরে দু/একজন রোগী পাওয়া যায়, তাও সেগুলো অন্য জেলা থেকে আসা। এরপর কক্সবাজার, চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়িতেও এপিআই ১-এর নিচে। শুধু দুটি জেলা রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানে এপিআই ১-এর ওপরে। এর মধ্যে রাঙ্গামাটিতে এপিআই ১ পয়েন্ট ৮৬, অর্থাৎ এটার এপিআই-ও ১ এর কাছে। (শুধু বান্দরবানেই) এপিআই সবচেয়ে বেশি ৬ পয়েন্ট ৮৬।

জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ণন্ত্রণ কর্মসূচি জানিয়েছে, কোভিও-১৯ পরিস্থিতির মধ্যেও দেশে ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চলে আবশ্যিক ম্যালেরিয়া সেবা প্রদান অব্যাহত রয়েছে। সব সরকারি হাসপাতাল ও ব্র্যাকসহ সহযোগী এনজিও সংস্থাগুলোর সব ল্যাবরেটরি ম্যালেরিয়া শনাক্ত ও চিকিৎসা প্রদানের জন্য খোলা রয়েছে। মাঠপর্যায়ে সব সরকারি ও বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মী, স্বাস্থ্য সেবিকা, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডাররা (সিএইচসিপি) ম্যালেরিয়া রোগীদের সেবা প্রদান অব্যাহত রেখেছেন। এনজিও কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ম্যালেরিয়াসহ কোভিড-১৯ বিষয়েও জনসচেতনতামূলক বার্তা প্রচার করছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এই কর্মসূচি আরও জানায়, এই মুহূর্তে দেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ১৩টি জেলার ৭২টি উপজেলায় ম্যালেরিয়ার প্রকোপ রয়েছে। রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবান-এই তিন পার্বত্য জেলায় ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত ও মৃত্যুহার সর্বাধিক। এই তিন জেলাকে উচ্চ ম্যালেরিয়া প্রবণ অঞ্চল হিসেবে গণ্য করা হয়। দেশে ২০০৮ থেকে ২০২১ সাল অর্থাৎ গত ১৩ বছরে ম্যালেরিয়া রোগীর সংখ্যা ও রোগটিতে মৃত্যু হ্রাসের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। ২০০৮ সালের তুলনায় ২০২১ সালে ম্যালেরিয়াজনিত অসুস্থতা শতকরা ৯৪ ভাগ এবং মৃত্যু শতকরা ৯০ ভাগ কমেছে। বর্তমানে উচ্চ ম্যালেরিয়া প্রবণ তিন পার্বত্য জেলায় মোট ম্যালেরিয়া রোগীর ৯৪ শতাংশ পাওয়া গেছে। তবে ২০২৫ সালের মধ্যে এই জেলাগুলোতে সংক্রমণের হার ম্যালেরিয়ার পরিমাপক এপিআই প্রতি হাজার জন ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীতে একের নিচে নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এতে করে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ম্যালেরিয়া নির্মূল লক্ষ্যমাত্রা অর্জন সম্ভব হবে।

 

সূত্রঃ জাগো নিউজ