মেরাজের অলৌকিক পটভূমি ও মারেফত দর্শন

আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে আমাদের পিয়ারে নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বিশ্ব জাহানের অধিপতি মহান স্রষ্টা আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে সাক্ষাতে মিলিত হয়েছিলেন। এ কারণে শবে মেরাজের গুরুত্ব ও তাৎপর্য অত্যন্ত ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী আধ্যাত্মিক তথা মারফত দর্শন রয়েছে।

রজব মাসে ২৬ তারিখ দিবাগত রাতেই সংগঠিত হয়েছিল মহানবী (সা.)-এর জীবনের আশ্চার্যজনক ঘটনা, যা পবিত্র শবে মেরাজ নামে পরিচিত। আমরা জানি, আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অসীম ক্ষমতা ও শক্তির অধিকারী। ভূমণ্ডল ও নভোমণ্ডলের সব কিছু তারই সৃষ্টি। পৃথিবীর সৃষ্টিরাজির চেয়েও আরও কত বিস্ময়কর সৃষ্টি আছে, যা মানুষের চোখে দেখা তো দূরের কথা বরং কল্পনা করাটাও অসম্ভব। আর এই মেরাজ হচ্ছে, মহান আল্লাহতায়ালার কুদরতেরই অংশ বিশেষ। নবুওয়াতের ১০টি বছর অসহ্য নির্যাতন, নিপীড়ন-উৎপীড়ন, জ্বালা-যন্ত্রণা সহ্য করে ঘাত-প্রতিঘাত পারি দিয়ে রাসূলুল­াহ (সা.) ইমানি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। এর পরেই সান্ত্বনা স্বরূপ মহান আল্লাহ তার পিয়ারে হাবিব হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে মেরাজের মাধ্যমে বিশেষ মর্যাদা ও সম্মান দান করেছেন, যা বিপদকে আনন্দ উল­াসে এবং অপমানকে সম্মানে রূপান্তরিত করেছেন।

আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআনের সূরা বনি ইসরাইলের ১নং আয়াতে মেরাজের ঘটনা এভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘পবিত্র ও মহিমাময় তিনি, যিনি তার বান্দাকে, রজনী যোগে ভ্রমণ করিয়ে ছিলেন মসজিদুল হারাম থেকে মসজিদুল আকসা পর্যন্ত। যার চারপাশে আমি নানা ধরনের বরকত প্রদান করিয়া রাখিয়াছি, উদ্দেশ্য আমি তাহাকে স্বীয় আশ্চর্য ক্ষমতার কিছু নিদর্শন দেখানো। তিনি সর্বশ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। উপরোক্ত আয়াতে আল­¬াহতায়ালা রাসূলুল­াহ (সা.)-এর মহাবিশ্ব ভ্রমণ এবং দর্শনের কথা উলে­খ করেছেন।

উপরে উলে­খিত আয়াতে দূরতম মসজিদ-এর ব্যাখ্যা কোনো কোনো তাফসিরকারক বাইতুল মোকাদ্দেস বুঝিয়েছেন, আবার কোনো কোনো তাফসিরকারক বাইতুল মামুরের কথা বলেছেন।

মহানবী (সা.)-এর মেরাজের ঘটনা বহু হাদিস দ্বারা প্রমাণিত, যেমনÑ হজরত আনাস (রা.) মালেক ইবনে ছা-সাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, মহানবী (সা.) মেরাজের রাত্রি সম্পর্কে সাহাবীদের কাছে এরূপ বর্ণনা করেছেন, ‘যখন আমি কাবাগৃহের উš§ুক্ত অংশ হাতিয়া ঊর্ধ্বমুখী শায়িত ছিলাম হঠাৎ এক আগন্তুক আমার কাছে এলেন। তার পর তিনি আমার বুকের ওপর থেকে তলপেট পর্যন্ত চিরে আমার দিলটাকে বের করে ফেললেন। তারপর ইমানবর্ধক বস্তুতে পূর্ণ একটি স্বর্ণপাত্র আনা হলো। আমার দিলটাকে ধুয়ে ওই পাত্রের বস্তু ভরে যথাস্থানে রেখে আমার বক্ষটা ঠিকঠাক করে দেয়া হলো। এরপর বোরাক নামের একটা বাহন আমার জন্য আনা হলো। এটা গাধা থেকে একটু বড় এবং খচ্চর থেকে একটু ছোট শ্বেতবর্ণের, এর প্রতি পদক্ষেপ দৃষ্টির শেষ সীমায় পৌঁছে।’ (বোখারি)। বোরাক শব্দটি বারকন শব্দ থেকে এসেছে। বারকন শব্দের অর্থ বিদ্যুৎ। যেহেতু বিদ্যুতের গতি শব্দের গতির চেয়ে বেশি, তাই রাসুলে খোদা (সা.)-এর যানবাহনটির নাম রাখা হয়েছে ‘বোরাক’। আর এর গতি আলোর চেয়েও অনেক বেশি ছিল।

আল্লাহতায়ালা, বিস্ময়কর সৃষ্টিরাজি ও তার মহান কুদরত ‘দোজাহানের সরদার প্রিয় হাবিব রাসুলে করিম (সা.)কে দেখানোর জন্য মনস্থ করলেন। আর এ কারণেই অধিকাংশ তাফসিরকারক ও মুহাদ্দেসদের মতে, ২৭ রজব মধ্যরাতের কিছু আগে বোরাক পাঠিয়েছেন। প্রথম বায়তুল­াহ তারপর বায়তুল মোকাদ্দেস। এখানে অতীতের সব নবী ও রাসূলদের জমায়েত করা হয়। সবাই নামাজের জন্য কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। আর ইমাম নির্বাচনের দায়িত্ব অর্পিত হয় হজরত জিব্রাইল (আ.)-এর উপর।

তিনি আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)কে ইমাম নির্বাচিত করেন। তিনি সব নবী ও রাসুলের ইমাম হয়ে দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করেন। তার এই ইমামতির কারণে সব নবী ও রাসুলের সরদার হিসাবে স্বীকৃতি পেলেন। তারপর শুরু হলো ঊর্ধ্বগমন, যাকে বলা হয় মেরাজ। বোরাকে উঠে মহানবী (সা.) যাত্রা শুরু করলেন। অন্য হাদিসে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) প্রথম আসমানে হজরত আদম (আ.), ২য় আসমানে হজরত ইয়াহিয়া (আ.) ও ঈসা (আ.), ৩য় আসমানে হজরত ইউসুফ (আ.), ৪র্থ আসমানে হজরত ইদ্রিস (আ.), ৫ম আসমানে হজরত হারুন (আ.), ৬ষ্ঠ আসমানে হজরত মুসা (আ.), ৭ম আসমানে হযরত ইবরাহিম (আ.)-এর সঙ্গে সাক্ষাত করেন।

সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলেন হজরত জিবরাইল (আ.)। হজরত জিবরাইল (আ.) রাসূলুল­াহ (সা.)কে নিয়ে এলেন এবার সিদরাতুল মুনতাহায়। এখানে এসে হজরত জিবরাইল (আ.) রাসূলুল­াহ (সা.)কে জানিয়ে দিলেন, সে আর সামনের দিকে যদি এক পা অগ্রসর হয় তবে, মহান আল্লাহর নুরের তাজালি­তে তার সব পালক পুড়ে যাবে। এখান থেকে রাসূলুল­াহ (সা.)কে একাই সামনের দিকে অগ্রসর হতে অনুরোধ জানালেন। সেখান থেকে হজরত মুহাম্মদ (সা.) একাই ‘রফরফ’ নামক এক যানবাহনের মাধ্যমে মহান আল্লাহর আরশে উপস্থিত হলেন। উলে­খ্য যে, রফরফ নামক যানবাহনটি বোরাকের চেয়ে অধিক দ্রুতগামী। আরশে মুয়াল্লায় উপস্থিত হয়ে বিশ্ব জাহানের মহান প্রতিপালক আল্লাহতায়ালার সঙ্গে আলোচনা করতে বসলেন। আল্লাহ ও তার রাসূল অত্যন্ত নিকটবর্তী হলেন। কুরআনের ভাষায় দুই ধনুক বা তার চেয়েও নিকটে।

আল্লাহতায়ালা তার প্রিয় হাবিবের সঙ্গে কথা বললেন, অনেক কথা; কী কী কথা হয়েছে, তা আমরা জানি না। তবে, এতটুকু জানা যায়, এই দিন হাদিয়া স্বরূপ পাঠায় দিলেন দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। এই দিন থেকেই মহানবী (সা.)-এর উম্মতের উপর দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়ে গেল। তাই তো নবী (সা.) নামাজ সম্পর্কে ঘোষণা করলেন, ‘আসসালাতু মিরাজুল মোমেনিন’ অর্থাৎ নামাজই হচ্ছে মুমিনদের জন্য মেরাজ। অন্য এক জায়গায় নবী (সা.) বলেছেন ‘নামাজই হচ্ছে বেহেশতের চাবি।’

মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) জান্নাত ও জাহান্নামসহ আসমানের যাবতীয় বিষয়সমূহ পরিদর্শন করেন। অবশেষে মেরাজ শেষ করে চলে এলেন এ পৃথিবীতে। এসে দেখলেন, অজুর পানি তখনও গড়িয়ে যাচ্ছে। দরজার শিকল লড়তেছে।

পৃথিবীর সময় ও কাজকর্ম সব কিছু বন্ধ করে দিয়েছিলেন মহান আল্লাহ। তার কারণে এ অবস্থা হয়েছে। যখন মহানবী (সা.) এসে এই মেরাজের ঘটনা বর্ণনা করলেন, তখন হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) কোনো প্রশ্ন ও যুক্তিতর্ক ছাড়াই বিশ্বাস করে নিলেন। আর এ কারণে মহানবী (সা.) হজরত আবু বকর (রা.)কে ‘সিদ্দিক’ বা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত করেন, বর্তমানে মেরাজ নিয়ে তেমন কোনো তর্ক পরিলক্ষিত হয় না। কারণ বর্তমানে বিজ্ঞানের এই সভ্যযুগে শুধু মুসলমানই নয় বরং বিধর্মীরাও এটা স্বীকার করে নিয়েছে। কারণ আজ মানুষ বিজ্ঞানের দ্বারা সৌরজগৎ ভেদ করে চন্দ্র ও মঙ্গলগ্রহে পদার্পণ করছে।

আর মহাবিশ্বের স্রষ্টার কুদরতের মাধ্যমে তার প্রিয় হাবিবকে দিদার করানো অসম্ভব নয়, বরং সম্ভব ও যুক্তিসঙ্গত। কারণ আল্লাহর নিকট অসম্ভব বলতে কিছু নেই।

মহান আল্লাহ সূরা হাদিদের ৩নং আয়াতে বলেন, ‘তিনিই আদি, তিনিই অনন্ত, তিনিই ব্যক্ত ও তিনিই সুপ্ত এবং তিনিই সর্ব বিষয়ে সম্যক অবগত।’ পবিত্র বাইবেলে উলে­খ আছে, ‘সৃষ্টির প্রারম্ভে আলোক ছিল, প্রচুর আলোক ছিল।’ ইহাতেও প্রমাণিত হয়, সবকিছু একমাত্র আল্লাহরই সৃষ্টি; তিনি যা ইচ্ছা করেন, তাই করতে পারেন।

মেরাজের প্রথম দর্শন হচ্ছে মারেফত বা তাসাউফ সম্পর্কীয়। আল্লাহর দিদার এবং সান্নিধ্য লাভ করে আমাদের বিশ্বনবী (সা.) মারেফত তথা আধ্যাÍিক ক্ষেত্রে সফলতার সৌভাগ্যের শীর্ষে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। এখানে স্বরণ রাখা দরকার, মহানবী (সা.) আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ লাভ করে, তিনি সমাজবিমুখ বা মজবুত তন্দ্রাগ্রস্ত হন নাই। বরং মাটির পৃথিবীতে ফিরে এসে দ্বীনি দাওয়াত ও দ্বীন প্রতিষ্ঠায় অত্যন্ত বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। মেরাজের পরেই তিনি হিজরত করেন।

মদিনায় খেলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, ২৩টি জিহাদ, মদিনা সনদ, হুদাইবিয়ার সন্ধি, মক্কা বিজয়সহ, নবুয়তেই পরিপূর্ণ দায়িত্ব পূর্ণতা লাভ করে মিরাজের পরেই। তাই শায়খ-মুর্শিদগণ, বুযুর্গগণ, ওলি-আওলিয়া, আলেম-ওলামাগণ যদি মহানবীর মিরাজ থেকে মারেফতের উৎকর্ষ হাসিল করে সমাজে নেতৃত্ব ও সরদারী গ্রহণ করে, তাহলে দুনিয়াতে অশান্তি, দুর্নীতি, ভেজাল, শোষণ-জুলুম, খুন, ধর্ষণ, ছিনতাই, মানবপাচারসহ যাবতীয় পাপকর্ম অনেকাংশে হ্রাস পাবে বলে আমরা মনে করি।

এখানে আরও বলা যায়, মিরাজের আধ্যাত্মিক বিষয় যে দিকে ইঙ্গিত করছে, তা হলো- আক্বীদা। মনে রাখতে হবে, মেরাজের বিষয়সম্পন্ন আকিদা বা বিশ্বাস তথা ইমানের মজবুতি। এখানে যুক্তিতর্কের বিষয় নয় বরং যুক্তিতর্ক বাদ দিয়ে পূর্ণ বিশ্বাস করাই হচ্ছে ইমানের দাবী। যার বিশ্বাস যত বেশি, তার ইমান তত মজবুত। তাওহীদ ও রিসালাতে দৃঢ় বিশ্বাসই হচ্ছে মিরাজের মূল দর্শন।

পবিত্র শবে মেরাজ উপলক্ষ্যে বিশ্বের বিভিন্ন মসজিদ, খানকা ও মহল্লায় মহল্লায় বিশেষ মিলাদ মাহফিল আলোচনা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। যা অত্যন্ত পুণ্যের কাজ বলে আমরা মনে করি। মনে রাখতে হবে, ফরজ ও সুন্নত ইবাদতের পাশাপাশি বেশি বেশি নফল ইবাদতের প্রতি গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। যা নবী (সা.) সাহাবা আজমাইন ও ওলি-আওলিয়াদের জীবন থেকে জানা যায়। এবারের পবিত্র শবে মেরাজ আমাদের সবার জন্য বয়ে আনুক সুখ, সমৃদ্ধ ও দেশের জন্য সার্বিক কল্যাণ, এটিই আমাদের একান্ত কামনা।

লেখক : ইসলামিক গবেষক, কলামিস্ট ও কলেজ প্রভাষক রাজশাহী বিভাগের শ্রেষ্ঠ ইমাম

সূত্র:যুগান্তর