মুজিব নগর সরকার এবং অধ্যাপক ইউসুফ আলী


মোঃ কায়ছার আলী :
আমার সোনার বাংলা,আমি তোমায় ভালবাসি”। পলাশীর ট্রাজেডির ২১৫ বছর পর ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী বিপ্লবী মুজিব নগর সরকার শপথ অনুষ্ঠানে লাল সবুজ জাতীয় পতাকা উত্তোলনের সময় অনন্য বিসর্জনে পাওয়া জাতীয় সংগীত প্রথম গাওয়া হয়। পরবর্তীতে মুজিব নগর সরকার কলকাতার ৮ নং থিয়েটার রোড থেকে পরিচালনা করা হত।

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় কোরিয়া, কম্বোডিয়া, অ্যাংগোলা, পোল্যান্ড এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধকালীন জার্মানীর নাৎসি বাহিনী ফ্রান্স দখল করলে জেনারেল দ্য গল লন্ডনে বসে প্রবাসী সরকার গঠন করেছিলেন। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার এ তিনটি মূলনীতির এ আইনি দলিলে ৪ জন ব্যক্তির নাম উল্লেখ আছে (১) খলনায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খান, (২) জাতির জনক বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার মহানায়ক এবং স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান (৩) ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং (৪) শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালক হিসাবে অধ্যাপক ইউসুফ আলী [১৯২৩-১৯৯৮ এম,এ বাংলা ঢাবি,বিএল রাবি]।

সেদিন সোনালী রোদের আলোয় আলোকিত বেলা ১১টায় আম্রপুঞ্জের মৌ মৌ মোহনীয় সুবাসে ৪৬৪ শব্দে রচিত স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করেন দিনাজপুর বিরল ফরক্কাবাদের কৃতি সন্তান অধ্যাপক ইউসুফ আলী। তিনি দেওয়ানজীদিঘী মাদ্রাসার পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত, তাঁর গ্রামের বাড়ির স্কুলে (আজীবন সভাপতি ছিলেন) দীর্ঘ দুইযুগ যাবৎ আমি কর্মরত আছি। পরিবারের কেউ রাজনীতিতে না থাকলেও তাঁর রয়েছে অমোচনীয় বিশাল কর্মময় জীবন। দিনাজপুর এস,এন কলেজে বাংলা পড়ানো ছিল অত্যন্ত হ্রদয়স্পর্শী, চিত্তাকর্ষক যা তাঁর ছাত্র/ছাত্রিরা আজো ভুলেনি।

১৯৬০ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়ে রাজনীতি শুরু করেন (১৯৬৫ সালে এমএনএ) এবং ১৯৮৬ সালে জাতীয় পার্টি থেকে অবসর নেন। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে গণপরিষদের সদস্য হয়ে সংসদীয় বোর্ডের ক্ষমতাবলে চীপ হুইপ হিসাবে তিনি ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রীদের শপথ বাক্য পাঠ করান। মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তরের প্রধান, বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্রতিষ্ঠাকালীন সভাপতি, শ্রমমন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, পাট ও বস্ত্রমন্ত্রী, শিল্পমন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রথম শিক্ষা ও সংস্কৃতি মন্ত্রী হিসাবে প্রাথমিক শিক্ষাকে জাতীয়করণ করার সুযোগ পান। এরশাদ সরকারের আমলে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী হয়ে পূনর্ভবা নদীর উপর কাঞ্চন সেতু তিনিই নিয়ে আসেন। তাঁর মুখে নিজেই শুনেছি নদীর পশ্চিম তীরে জনগণের এটা ছিল প্রাণের দাবী।

নদীর পূর্বতীরে চাউলিয়াপট্টি বাঁধের পাশে আমাদের বাড়ী, তাই আমিও তাঁদের (লোকজনের) যন্ত্রণাগুলো দেখেছি। পূর্বে একমাত্র মিটার গেজ (এখন পাশে নতুন ব্রডগেজ) রেলসেতুর একপাশ দিয়ে যানবাহন গেলে আরেক পাশের যানবাহন অপেক্ষা করত। আর ট্রেন যাতায়াত করলে দুইপাশে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে প্রচুর ভীড়ে যানজট হত। বর্ষাকালে নদী পারাপারের একটি নৌকা ছিল অবলম্বন। নৌকা মিস করলে একঘন্টা অপেক্ষা করতে হত, ঐ পারে গিয়ে ১০/১২ জন যাত্রী না হলে নৌকা ফিরতে দেরী হত আবার রাতে নৌকা চলাচল বন্ধ থাকত। এটা এখন ইতিহাস হলেও তখন ছিল চরম বাস্তবতা।

আজ কাঞ্চন সেতু দিয়ে দিনাজপুর শহরে বেশ কয়েকটি উপজেলার জনসাধারণ দিবারাত্রী চব্বিশ ঘন্টা শহরে যাতায়াত করে। দিনাজপুর শহরে প্রবেশের যত রাস্তা আছে সব রাস্তার লোকজন যোগ করলে কাঞ্চন সেতুর সমান পারাপার হবে না। অনেক অবদানের মাঝে সবচেয়ে বড় অবদান বলব যতদিন বাংলাদেশের নাম, পতাকা, মানচিত্র থাকবে ততদিন মুজিব নগর সরকারের একজন সারথি হিসাবে আলহাজ্ব অধ্যাপক ইউসুফ আলীর নাম সহ সকলের নাম প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে স্বর্ণাক্ষরে ইতিহাসে পাতায় লিখা রবে। তাঁদেরকে বিনম্র গভীর শ্রদ্ধা জানাই এই মাহেন্দ্রক্ষণে।

লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট

০১৭১৭-৯৭৭৬৩৪, kaisardinajpur@yahoo.com