মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিতর্ক : আশা ও আশঙ্কা

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক:

মার্কিন সংবিধান অনুযায়ী একটি বিধিবদ্ধ সময়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য বারাক ওবামা নির্বাচিত হন। একজন  ব্যক্তি যাতে ক্ষমতার সর্বেসর্বা হয়ে না ওঠেন সে জন্য মার্কিন সংবিধানের ২২ তম সংশোধনী অনুযায়ী একজন প্রেসিডেন্ট দুই মেয়াদের বেশি প্রেসিডেন্ট থাকতে পারেন না। আগামী ৪ নভেম্বর,২০১৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য মার্কিন জনগণ ভোট প্রদান করবেন। নির্বাচন প্রক্রিয়া পরোক্ষ এবং জটিল। দলীয় মনোনয়ন পাওয়াও সহজ সাধ্য নয়। যাহোক দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং ঐতিহ্য অনুযায়ী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুটো প্রধান দল ডেমোক্র্যাট এবং রিপাবলিকান পার্টি তাদের প্রেসিডেন্ট প্রার্থিতা চূড়ান্ত করেছে। সাবেক ফাস্ট লেডি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী ((Secretary of State)) হিলারি ক্লিন্টন ডেমোক্র্যাট দলের প্রার্থী নির্বাচিত হন। অপরদিকে রিপাবলিকান দল চড়াই উৎরাই পেরিয়ে ধনকুবের ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তাদের প্রার্থী মনোনায়ন করে। এই বছরটি তারা নির্বাচনী প্রক্রিয়া নিয়ে ব্যাস্ত ছিল। এখন তারা তাদের শেষ পরীক্ষায় অবতীর্ন হচ্ছে।

 

ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীরা কিন-চারটি বিতর্কে অবতীর্ণ হন। মার্কিন জনগণের কাছে এটি একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় বিষয়। সব টেলিভিশন এই বিতর্ক সরাসরি সম্প্রচার করে। কোটি কোটি মার্কিন জনগণ তো বটেই, গোটা বিশ্ব এ বিতর্ক উপভোগ করে। ব্যাখ্যা বিশ্লেষণে দেখা যায় গতানুগতিক ভাবে বিভাজিত ভোগ সাম্রারাজ্যে এই বিতর্ক খুব কমই প্রভাব ফেলে। তারপরও বিতর্ক দেখে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদের মেধা মনন, শিক্ষা সংস্কৃতি এবং যোগ্যতা অভিজ্ঞতা সম্পর্কে হিসেব নিকেশ নিতে চায় মার্কিন নাগরিকরা। বছরের এ সময়টা অর্থাৎ ২৬ সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গোটা মার্কিন গণমাধ্যম বিতর্ক নিয়ে সরব থাকবে। ইতিমধ্যে প্রথম বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ মার্কিন সময় রাত ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত । মোট ৯০ মিনিটের বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হয়েছে । এটি নিউইয়র্কের হফস্ট্রা ইউনিভার্সিটিতে অনুষ্ঠিত হয়। এতে সঞ্চালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন এনবিসি টেলিভিশনের উপস্থাপক  লেস্টার হল্ট। আরও দু-তিনটি বিতর্ক একই সময়ে বিভিন্ন তারিখে অনুষ্ঠিত হবে। প্রেসিডেন্ট বিতর্ক অনুষ্ঠানের জন্য গঠিত একটি সংগঠন (The commission on Presidential debates-CPD) এসব বিতর্ক পরিচালনা করে থাকে। নতুন করে ১৯৮৭ সালে এ সংগঠন গঠিত হয়।সিপিডির তত্ত্বাবধানে আরো দুটি বিতর্ক অক্টোবরে অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে ভাইস প্রেসিডেন্ট প্রতিদ্বন্দ্বীদের মঝে আর একটি বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে।

 

একটি সুনির্দিষ্ট নীতিমালার ভিত্তিতে সিপিডি প্রেসিডেন্ট বিতর্কের ব্যবস্থাপনা করে থাকে। এরা শুধু প্রধান দুদল থেকে যে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বিতর্কে অহ্বান জানায় তা নয়। যে প্রার্থী সে যে দলেরই হোক না কেন সে যদি ২৭০টি নির্বাচকমন্ডলীর ভোট পায় এবং তাঁর ভোটের পরিসংখ্যন যদি হয় কমপক্ষে ১৫% অন্তত পাঁচটি নির্ধারিত জাতীয় ভিত্তিতে গৃহীত ভোটে, তাহলে তাঁকে বিতর্কে অংশগ্রহণের আহ্বান জানানো হয়। এ বারে চারজন প্রার্থী ন্যূনতম নির্বাচনী ভোট লাভ করেছেন । কিন্তু অন্য দুজন প্রার্থী গড়পরতা ভোট কম পাওয়ায় তাঁদের বিতর্কে ডাকা যায়নি। যাঁরা বাদ পড়েছেন তাঁরা হলেন গ্রিন পার্টি নমিনি জিল স্টেইন এবং লিবেরেটারিয়ান দলের প্রার্থী গ্যারি জনসন। সিপিডি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বত্র সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এ বিতর্ক আয়োজন করে থাকে। নির্ধারিত সময়কে তারা ১৫ x৬ = ৯০ স্লটে ভাগ করে থাকে। প্রতিটি স্লটে ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ের অবতারণা করা হয়। অনুষ্ঠান পরিচালনার সম্পূর্ণ ক্ষমতা থাকে সঞ্চালকের। সমবেত জনগণের প্রশ্ন করার কোনো সুযোগ রাখা হয় না। আয়োজকরা নামিদামি ব্যক্তিদের সঞ্চালক হিসেবে আমন্ত্রণ জানায়। আর একটি সংগঠন (The Free and Equal Elections Foundation) একটি অতিরিক্ত প্রেসিডেন্ট বিতর্ক পৃথকভাবে আয়োজন করে থাকে। এরা কোনো বাধ্যবাধকতা না রেখে সব প্রেসিডেন্ট প্রার্থীকে বিতর্কে অংশগ্রহণের আহ্বান জানায়। এবারেও তারা সব প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। তবে সেখানে হিলারি এবং ট্রাম্প নাও যেতে পারেন।

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে প্রেসিডেন্ট এবং ভাইস প্রেসিডেনট নির্বাচনে প্রার্থীর যোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীকে অতিঅবশ্যই জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিক হতে হবে। তাঁর বয়স হতে হবে কমপক্ষে ৩৫ বছর। একনাগারে ১৪ বছর বসবাসরত থাকতে হবে যুক্তরাষ্ট্রে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দলীয় ব্যবস্থাপনা দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্র হওয়ার কারণে সাধারণত প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীগণ যে কোন একটি রাজনৈতিক দলের মনোনয়ন প্রার্থনা করে থাকেন। ১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই স্বাধীনতা ঘোষনার  পর থেকে ক্রমান্বয়ে দ্বিদলীয় ব্যাবস্থা বিকশিত হয়েছে। নির্দিষ্ট দল প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে দলীয় কর্মী সমর্থকদের মতামত গ্রহন করে। সেখানেও পরোক্ষভাবে দীর্ঘ প্রক্রিয়ায় মতামতের সমন্বয় ঘটতে দেখা যায়। সেটাকে তারা বলে প্রাথমিক নির্বাচন। আইন অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট এর মেয়াদ শেষ হবে ২০ জানুয়ারি ২০১৭। এর আগেই অর্থাৎ ৪ নভেম্বর ২০১৬ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনী ফলাফল ঘোষনা, রাজনৈতিক সুস্থিতি এবং দুই প্রেসিডেন্টকে পরিবেশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও অনুধাবনের জন্য এই মধ্যবর্তী সময়টি দেয়া হয়। সাধারণত একই স্টেট থেকে দু জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে না। তবে এবারই প্রথম উভয় প্রার্থীই নিউইয়র্ক থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ঘোষিত সূচি অনুযায়ী আগামী ৯ অক্টোবর দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে। ফ্রি এবং ইকুয়াল ইলেকশন ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনায় একক বিতর্কটি অনুষ্ঠিত হবে ২৫ অক্টোবর কলরোডা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

উপরোক্ত নিয়মকানুনের মধ্য দিয়ে সফলভাবে অনুষ্ঠিত হলো প্রথম বিতর্ক। এখন গণমাধ্যম এবং নানাধরনের সংগঠন বিতর্কের সফলতা ব্যর্থতা নিরূপণে ব্যস্ত।

 

কে জিতেছেন আর কে হেরেছেন এই নিয়ে দুই পক্ষ  নিজ নিজ স্বার্থে কথা বলছে। প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ফুরফুরে মেজাজে আছেন ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিন্টন। আর রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষোভে ফুসছেন। বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানের মূল্যায়নে হিলারি জয়লাভ করেছেন। বিতর্কে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাম্পকে আত্মরক্ষামূলক অবস্থানে ঠেলে দিতে সক্ষম হন। ৯৫ মিনিট স্থায়ী এই বিতর্কে হিলারি কেবল অধিক প্রস্তুত ও অভিজ্ঞ প্রার্থী হিসেবেই নিজেকে প্রমাণ করেছেন যে তা নয়, তিনি প্রেসিডেন্ট সুলভ মেজাজ, ব্যক্তিত্ত্ব ও উষ্ণতা প্রকাশ করেছেন। বিতর্ক পরবর্তী তাৎক্ষণিক জনমত জরিপে সিএনএন (Cable News Network)) জানায় দর্শকদের ৬২ শতাংশ বলেছেন, যে বিতর্কে জয়ী হয়েছেন হিলারি। মাত্র ২৬ শতাংশ মনে করেন জয়ী হয়েছেন ট্রাম্প।বিতর্কে যেসব বিষয় প্রাধান্য পায় সেগুলো হলো  রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, ইরাক যুদ্ধ, রাশিয়া তথা ভ্লাদাদিমির পুতিন, ইসলামিক স্টেট, ওবামার জন্মসনদ, ট্রাম্পের ট্যাক্স রিটার্ন ইত্যাদি। অতিকথন, বাগাড়ম্বরতা এবং দাম্ভিকতায় দুষ্ট ট্রাম্প তাঁর পরামর্শকদের উপদেশে বিতর্কের প্রথম দিকে নিজেকে সামলে রাখতে সক্ষম হন। কিন্তু হিলারি তাঁকে আক্রমণের একপর্যায়ে আসল রূপ বেরিয়ে আসে। ট্রাম্প হিলারির ব্যক্তিগত সার্ভারে তাঁর ইমেইল ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুললে হিলারি বিনা দ্বিধায় ভুল স্বীকার করেন। ট্রাম্প হিলারির সততা, যোগ্যতা এমনকি নারীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ট্রাম্প বলেন, ‘হিলারির চেহারা প্রেসিডেন্ট সুলভ নয়।’ ট্রাম্প যে হাসি মুখ নিয়ে বিতর্ক শুরু করেছিলেন, তা পরে আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠে। তিনি হিলারিকে অসংখ্য বার কথা বলতে বাধা দেন এবং পর্যুদস্ত হয়ে বার কয়েক পানি খান। নিরপেক্ষ বিশ্লেষকরা একমত, গত দুই সপ্তাহে ট্রাম্প যা অর্জন করেছিলেন এ বিতর্কে তা বিসর্জিত হয়েছে। হিলারি সম্ভবত ট্রাম্পের ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়া জনসমর্থন ঠেকিয়ে দিতে সমর্থ্য হয়েছেন। সিএনএন বলছে ৩৪ শতাংশ নিরপেক্ষ ভোটার হিলারির দিকে ঝুকেছেন। তবে রিপাবলিকান জনমন্ডলীতে অবস্থানের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি তা সহজেই বোঝা যায়।

 

প্রায় দেড় বছর ধরে নির্বাচনী প্রচারণা চলছে। হিলারি ক্লিন্টন তাঁর শান্ত সমায়িত এবং রমনীয় ব্যক্তিত্ব দ্বারা গরিষ্ঠ্য জনগোষ্ঠিকে তুষ্ট করেছেন। তিনি শান্তিময় পৃথিবী, অভিবাসীদের প্রতি যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং অবহেলিত জনশ্রেণির প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেছেন। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিক ও নির্দেশনা দিয়েছেন। বেকারত্ব দূরীকরণে পরিকল্পনা পেশ করেছন। অপরদিকে ডোনাল্ড ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়িয়েছেন। মুসলমানদের আমেরিকা প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার কথা বলেছেন। সন্ত্রাস দমনের নামে গোটা বিশ্ব নিয়ন্ত্রণের কথা বলেছেন। মুক্ত বাণিজ্যের বিরোধিতা করেছেন। ইসলামিক স্টেটকে নিশ্চিহ্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি হিস্পানিক সম্প্রদায়ের অবৈধ অধিবাসীদের বিতাড়নের হুমকি দিয়েছেন। উল্লেখ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এদের সংখ্যা এক কোটিরও বেশি। হিস্পানিকদের আগমন ঠেকাতে মেস্কিকো সীমান্তে মেস্কিকোর ব্যয়ে দেয়াল তোলার ঘোষণা দিয়েছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প কৃষ্ণাঙ্গদের প্রতি অবমাননাকর উক্তি করেছেন। ন্যাটোকে অপ্রয়োজনীয় আখ্যা দিয়েছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ক্রম হ্রাসমান ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের সংকল্প ব্যক্ত করেছেন।

 

এসবের মধ্য দিয়েই একজন প্রার্থী বাস্তবে না হলেও দৃশ্যত বিশ্ব শান্তির কথা বলেছেন। অপরদিকে আরেকজন প্রার্থী যে রূপকল্প উপহার দিয়েছেন তা পৃথিবীকে আরো গভীর সংকটের দিকে ঠেলে দেবে। যদি ট্রাম্প বিজয়ী হয় তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বর্গরাজ্য দৃশ্যত নরকে পরিণত হবে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী শক্তির হামলায় আরো বেশি করে ক্ষতিগ্রস্ত হবে গোটা বিশ্বের সাধারণ মানুষ। আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মার্কিন রণকূশলী এবং ইহুদিলবী ট্রাম্পের বিজয়ের স্বার্থে নির্বাচন নিকটে আসলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আরো সহিংসতা ও সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটাতে পারে, যাতে বিদ্বেষ বৃদ্ধি করে ট্রাম্পের বিজয় নিশ্চিত করা যায়। তবে গরিষ্ঠ মার্কিন জনগণের ওপর গোটা বিশ্বের আস্থা অনেক। সবাই আশা করে শুভ বুদ্ধির জয় হবে।

 

লেখক : অধ্যাপক,  সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্র: এনটিভি