মার্কিন নির্বাচনে ভারতের ধর্মীয় রাজনীতির ছায়া

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতি ভারতীয়-আমেরিকানদের চিরাচরিত আনুগত্যে যেভাবে চিড় ধরেছে, যেভাবে তারা ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভক্ত হয়ে পড়ছেন— নভেম্বরের নির্বাচনের আগে তা নিয়ে জো বাইডেন শিবির চিন্তিত।

‘ভারত-বিরোধী’ এবং এমনকি ‘হিন্দু-বিরোধী’ বলে ভারতীয়-আমেরিকান সমাজের বিরাট একটি অংশের মধ্যে যে ইমেজ তাদের তৈরি হচ্ছে— তা ঘোচানোর চেষ্টায় নেমেছেন ডেমোক্র্যাটরা।

ভারতের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শনিবার এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে দুই সিনিয়র উপদেষ্টাকে সঙ্গে নিয়ে জো বাইডেন ভারতীয়-আমেরিকান ভোটারদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়েছেন।

এ ছাড়া ডেমোক্র্যাটদের অনেকে ভরসা করছেন, ভারতীয় এবং জ্যামাইকান বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসকে রানিংমেট হিসেবে বেছে নেওয়ায় ভারতীয়-আমেরিকান ভোটারদের সন্দেহ হয়তো কিছুটা ঘুচতে পারে।

হ্যারিসের মনোনয়ন নিশ্চিত করার পরদিনই আত্মপ্রকাশ করেছে ‘ইন্ডিয়ানস ফর বাইডেন (বাইডেনের পক্ষে ভারতীয়রা) ন্যাশনাল কাউন্সিল’ নামে নতুন একটি সংগঠন।

সাংবাদিকদের কাছে এ খবর জানানোর সময় নতুন এই ক্যাম্পেইন গ্রুপের পরিচালক সঞ্জীব জোসিপুর বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে ডেমোক্র্যাটরাই যে তাদের প্রকৃত মিত্র এবং ভরসা, তা ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে বোঝাবেন তারা।

US-1

সঞ্জীব জোসিপুর বলেন, ‘একজন কৃষ্ণাঙ্গ এবং ভারতী-আমেরিকান নারীকে প্রথমবারের মত ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। ভারতীয়-আমেরিকান সমাজকে বোঝানো খুবই জরুরি যে, এ দেশে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে এই নির্বাচনের ফলাফলের ওপর।’

কমলা হ্যারিস বনাম ভারতীয় ভোট
কমলা হ্যারিসের মনোনয়নে ভারতে এবং ভারতীয়-আমেরিকানদের মধ্যে যে এক ধরনের সাড়া পড়েছে তাতে সন্দেহ নেই। সোশ্যাল মিডিয়ায় চোখ রাখলেই তা স্পষ্ট। ভারতের গণমাধ্যমগুলোতেও বিস্তর কথাবার্তা চলছে তাকে নিয়ে।

কমলা হ্যারিসের মনোনয়ন ঘোষণার দিনে ভারতের অন্যতম দৈনিক টাইমস অব ইন্ডিয়া তাদের শিরোনাম করে, ‘ওয়ান অব আওয়ারস অর্থাৎ তিনি আমাদেরই একজন।’

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, ডেমোক্র্যাটদের প্রতি ভারতীয়-আমেরিকানদের আনুগত্যে যে ফাটল তৈরি হয়েছে, কমলার মনোনয়নে তার কতটা সুরাহা হবে? ট্রাম্পের প্রতি তারা যেভাবে আকৃষ্ট হয়ে পড়েছেন— তা কি বদলে যাবে?

সন্দিহান অনেক পর্যবেক্ষক বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে বা নির্বাচনে এখন ভারতীয়-আমেরিকানদের বিশাল একটি অংশের সমর্থনের প্রধান নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে ভারতের চলমান অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। সেখানে আংশিক ভারতীয় বংশোদ্ভূত কমলা হ্যারিসের মনোনয়ন খুব বেশি পার্থক্য তৈরি করবে না।

ভারতীয় রাজনীতি এবং হিন্দু-মুসলিম বিরোধ
ভারতে মুসলিম এবং কাশ্মীর ইস্যুতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নানা কর্মকাণ্ডে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির বিশেষ করে দলের বামপন্থী অংশটির খোলাখুলি সমালোচনায় চটে গেছেন হিন্দু ভারতীয়-আমেরিকানদের বিরাট একটি অংশ।

পাশাপাশি, কাশ্মীরসহ মোদি সরকারের বিভিন্ন বিতর্কিত নীতির প্রতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং সর্বশেষ চীনের সঙ্গে চলমান সীমান্ত বিরোধে ভারতের প্রতি তার সমর্থনের ফলে ভারতীয় আমেরিকানদের মধ্যে রিপাবলিকান-প্রীতি দিনে দিনে বাড়ছে।

US-2

এ বছরই যুক্তরাষ্ট্রে ‘হিন্দুজ ফর ট্রাম্প বা ট্রাম্পের জন্য হিন্দুরা নামে নতুন একটি গোষ্ঠী আত্মপ্রকাশ করেছে। অতি সম্প্রতি অনলাইনে ট্রাম্পের সমর্থনে একটি ভার্চুয়াল নির্বাচনী সভার আয়োজন করে— যাতে এক লাখের মত ইন্ডিয়ান-আমেরিকান যোগ দেন।

ওয়াশিংটনে সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক সীমা সিরোহী দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সর্বশেষ প্রকাশিত সাময়িকীতে লিখেছেন, প্রধানত ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির প্রভাবে ভারতীয়-আমেরিকানরা রিপাবলিকান শিবিরে গিয়ে ভিড়তে শুরু করেছেন।

তিনি বলেন, ‘তলে তলে ভারতীয়-আমেরিকানদের মধ্যে রিপাবলিকান দলের প্রতি সমর্থন যে বাড়ছে তা গবেষণা সংক্রান্ত তথ্যে চেখে পড়বে না। কিন্তু হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ, জুম মিটিং এবং মানুষের সঙ্গে কথা বললে এ সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়।’

সীমা সিরোহী বলছেন ‘ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি এবং সেখানে হিন্দু-মুসলিম বিভেদ যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে এসে পড়েছে। ট্রাম্পকে অনেকে দেখছেন ভারতের এবং হিন্দুদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, অন্যদিকে বাইডেন এমন সব লোকজদের খপ্পরে পড়েছেন যারা ভারতবিরোধী।’

ডেমোক্র্যাটিক পার্টির যাদের নিয়ে বহু হিন্দু ভারতীয়-আমেরিকানদের এই সন্দেহ বিরক্তি; কমলা হ্যারিস তাদের বাইরে নন।

গত বছর অগাস্টে মোদি সরকার ভারতশাসিত কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদা বাতিল করে ব্যাপক বিধিনিষেধ আরোপর পর ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বামধারার গোষ্ঠীগুলোর সাথে কিছু ইসলামপন্থী সংগঠন তার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।

তারা মার্কিন কংগ্রেস থেকে শুরু করে বিভিন্ন সিটি কাউন্সিল এবং রাষ্ট্রের আইন সভাগুলোতে কাশ্মীরে মানবাধিকার পরিস্থিতি তুলে ভারতের ওপর চাপ তৈরির চেষ্টা করছে।

কাশ্মীর ইস্যুতে মার্কিন কংগ্রেসে নিন্দা প্রস্তাব তোলার প্রধান উদ্যোক্তাই ছিলেন আরেক ভারতীয় বংশোদ্ভূত রাজনৈতিক প্রমীলা জয়পাল। তাতে জোর সমর্থন দিয়েছেন কমলা হ্যারিসও। তার আগে, মোদি সরকারের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন এবং বিজেপির হিন্দু শ্রেষ্ঠত্ববাদ নীতির খোলাখুলি সমালোচনা করেছেন কমলা।

US-3

ডেমোক্র্যাটদের অনেক বড় বড় নেতাও কথা বলেছেন, কিন্তু ভারতীয় বংশোদ্ভূত বলে ওই দুজনের কথা প্রচার পেয়েছে অনেক বেশি। হিন্দু ভারতীয়-আমেরিকান সমাজের বিশাল অংশ এগুলো পছন্দ করেনি, বিশেষ করে প্রথম প্রজন্মের ভারতীয় অভিবাসীরা যারা এই কমিউনিটির ভোটারদের তিন-চতুর্থাংশ।

রিপাবলিকানদের ‘ভারত ও হিন্দু বান্ধব’ ইমেজ
রিপাবলিকানরা হিন্দু ভারতীয়-আমেরিকানদের এই উদ্বেগ-হতাশাকে কাজে লাগাচ্ছেন। তার তীব্র অভিবাসী বিরোধী অবস্থান সত্বেও ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৬ নির্বাচনের আগে নিজেকে ভারত এবং হিন্দু-সমর্থক হিসেবে তুলে ধরে বেশ কিছু ভারতীয়-আমেরিকান ভোট রিপাবলিকানদের ঘরে নিয়ে গেছেন।

ক্ষমতায় এসে গুরুত্বপূর্ণ সমস্ত ইস্যুতে তিনি ভারত সরকারকে সমর্থন করেছেন। এমন সব অস্ত্র বিক্রি অনুমোদন করেছেন যা ওবামা সরকার আটকে রেখেছিল। পাকিস্তানের সাহায্য কমিয়ে দিয়েছেন এবং অতি সম্প্রতি চীনের সঙ্গে সীমান্ত সংঘাতে ভারতকে সমর্থন করেছেন।

US-4

এ ছাড়া, গত বছর টেক্সাসের হিউস্টনে সফররত নরেন্দ্র মোদির সম্বর্ধনা অনুষ্ঠান ‘হাউডি মোদি’ ডেমোক্র্যাটরা অগ্রাহ্য করলেও, ট্রাম্প গিয়ে হাজির হন। তারপর ফেব্রুয়ারিতে ফেরত সম্বর্ধনা নিতে হাজির হন গুজরাটে।

২০১৭ সালে থেকে ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারণা শিবিরের পক্ষ থেকে ভারতীয়-আমেরিকানদের লক্ষ্য করে কমপক্ষে ৫০০ সভা করা হয়েছে। পর্যবেক্ষকদের কোনো সন্দেহ নেই হিন্দু ভারতীয় আমেরিকানদের কাছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের রিপাবলিকান পার্টি আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় অনেক গ্রহণযোগ্য।

ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতির অধ্যাপক ড. আলী রীয়াজ অবশ্য মনে করেন, ডেমোক্র্যাটদের প্রতি ভারতীয়-আমেরিকানদের প্রশ্নহীন আনুগত্য অনেকদিন ধরেই কম-বেশি ‘মিথ’ বা ভ্রান্ত ধারণা।

তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রে পেশাজীবী-ব্যবসায়ী ভারতীয়রা যত বেশি সম্পদশালী হচ্ছেন— রিপাবলিকানদের দক্ষিণপন্থী কর এবং অন্যান্য নীতির সাথে তারা ততই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করছেন। যে প্রবণতা ভারতেও একই রকম। সেখানেও উচ্চ-মধ্যবিত্তদের মধ্যে বিজেপির অকুণ্ঠ সমর্থন স্পষ্ট।’

সেই সাথে যোগ হয়েছে ভারতে এবং যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে ধর্মের ব্যাবহার।

তার কথায়, ‘নাইন-ইলেভেনের পর বুশ সরকারের ‘ওয়ার অন টেরর’ ভারতীয়-আমেরিকানরা ব্যাপকভাবে সমর্থন করেছে। ট্রাম্প নিজেও মুখে ইসলামী সন্ত্রাস নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। এখন মোদি ভারতে যা করছেন তাকে অনেক ভারতীয়-আমেরিকান ইসলামী সন্ত্রাস দমন হিসেবে দেখছেন এবং মোদির প্রতি ট্রাম্পের প্রশ্নহীন সমর্থনে তারা খুশি।’

আমেরিকান-ভারতীয়রা কত বড় ভোট ব্যাংক
ভোটের সংখ্যার বিবেচনায় আমেরিকান-ভারতীয়রা মাত্র এক শতাংশের কিছু বেশি মত যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার সংখ্যা কমপক্ষে ১৫ শতাংশ। কিন্তু মিশিগান, পেনসিলভানিয়া, উইসকনসিন বা ফ্লোরিডার মত আটটি মারজিনাল অঙ্গরাজ্যে তাদের বাস উল্লেখযোগ্য সংখ্যক।,এসব জায়গায় তাদের সংখ্যা আরও বাড়ছে।

US-5

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের এএপিআই ডেটার (এশিয়ান আমেরিকান অ্যান্ড প্যাসিফিক আইল্যান্ডার) প্রধান ঋত্বিক রামাকৃষ্ণানকে উদ্ধৃত করে রয়টর্স বার্তা সংস্থা বলছে, ‘২০১৬ সালে মিশিগান, পেনসিলভানিয়া এবং উইসকনসিনে ৮০ হাজার ভোটের পার্থক্য ট্রাম্পের জেতার পেছনে কাজ করেছে। এসব রাজ্যে এশিয়ান-আমেরিকান ভোট জয়-পরাজয় নির্ধারণে আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।’

সে কারণেই ওই এক শতাংশ ভারতীয়-আমেরিকান ভোটের জন্য এখন উঠেপড়ে লেগেছে বাইডেন শিবির।

ভারতের স্বাধীনতা দিবসে অনুষ্ঠান করে ভাষণ দেওয়ার পরিকল্পনা তার স্পষ্ট লক্ষণ। এ ছাড়া বাইডেনের প্রচারণা অফিস থেকে সম্প্রতি ভারতের ১৪টি ভাষায় বিজ্ঞাপন প্রচার করা হচ্ছে যার ভাষা অনেকটাই ভারতে প্রচলিত রাজনৈতিক স্লোগানের মত।

সীমা সিরোহীর ভাষায়, ‘এই প্রথম কোনো নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিকে ইন্ডিয়ান-আমেরিকান ভোটারদের কাছে পেতে কষ্ট করতে হচ্ছে।’

কমলা হ্যারিস ফ্যাক্টর
রানিংমেট কমলা হ্যারিস বাইডেনকে কতটা সাহায্য করতে পারবেন? নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারছেন না।

কমলা হ্যারিসের মায়ের জন্ম ভারতে, ছেলেবেলায় অনেকবার চেন্নাইতে নানা বাড়িতে গেছেন, তামিল খাবার তার পছন্দ। প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়নের প্রাইমারির প্রচারণার সময় তিনি একটি ভিডিও প্রকাশ করেছিলেন যাতে তাকে মসালা দোসা তৈরি করতে দেখা যায়।

তারপরও তিনি কতটা ভারতীয় তা নিয়ে বহু ভারতীয়-আমেরিকানের মধ্যে সন্দেহ রয়েছে।

ইন্ডিয়ান আমেরিকান ফোরাম অব পলিটিক্যাল এডুকেশনের প্রেসিডেন্ট সমপাথ শিভাঙ্গিকে উদ্ধৃত করে বার্তা সংস্থা পিটিআই লিখছে, ‘বাস্তবে তিনি (কমলা হ্যারিস) ইন্ডিয়ান আমেরিকান নন। তিনি কখনও সেটা দাবিও করেননি। বরঞ্চ তিনি নিজেকে সবসময় কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান এবং ব্যাপটিস্ট ক্রিশ্চিয়ান হিসেবে দেখিয়েছেন।’

তারপরও শিভাঙ্গি মনে করেন, ‘কিছু ইন্ডিয়ান-আমেরিকান তাদের আনুগত্য নিয়ে দোটানায় পড়ে যাবেন, তারা কি তথাকথিত একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূতকে ভোট দেবেন নাকি ভারত-সমর্থক ট্রাম্পকে ভোট দেবেন।’

সূত্র : বিবিসি বাংলা