মাঝরাতে কেউ তিনবার ডাকলে তবেই সাড়া দিন, নয়তো মারাত্মক বিপদ

সিল্কসিটিনিউজ ডেস্ক: ইন্টারনেটে ভ্রমণকারীদের কাছে অতি পরিচিত একটি শব্দবন্ধ ‘আরবান লিজেন্ডস’। মূলত অতিপ্রাকৃত আর যুক্তি-অতীত গা ছমছমে কিংবদন্তিগুলিকে আজকাল এই নামেই ডেকে থাকি আমরা ‘নেটভ্রামণিক’রা। গুগল-এ গিয়ে এই শব্দটি লিখে সার্চ দিলে কাতারে কাতারে কাহিনি উঠে আসে। তার কোনওটা ‘আরবান’ কোনওটা নেহাতই গ্রামীণ। কিন্তু সংজ্ঞা মেনে তাদেরকেও ‘আরবান লিজেন্ড’ বলতে হয়। কারণ, গুগল বলছে, তাই মেনে নিতে হবে।

সে যাকগে। আমাদের দেশের অতিপ্রাকৃত নিয়ে ছানবিন করতে গেলে তেমন বেশি কিছু যে পাওয়া যায় তা নয়। বরং উঠে আসে অপ্রাকৃত ঘটনার রিপোর্ট। সেগুলো আসল না নকল, সে বিচার করার ক্ষমতা আমাদের নেই। কলকাতার ভূতের বাড়ি বা কলকাতার ভূতুড়ে জায়গা নিয়ে কম লেখালিখি ইন্টারনেটে হয়নি। বিস্তর লেখা রয়েছে স্টোনম্যান বা ওই জাতীয় অমীমাংসিত রহস্য নিয়েও। কিন্তু তেমন ভাবে বাঙালির নিজস্ব ‘আরবান লিজেন্ড’ কতটা প্রতিফলিত নেট-দুনিয়ায়, তা বিচার করতে গেলে চমকাতে হয়। বাঙালির নিজস্ব ভূত-ভাবনা নিয়ে মাঝে মাঝে কলম ধরেন ইংরেজি ওয়েবসাইটের বাঙালি লেখকরা। তাঁরা সাধ্যাতীত পরিশ্রম করে বোঝাতে চান স্কন্ধকাটা, মামদো বা শাঁকচুন্নির হার্মেনিউটিকস। খেলা কতটা জমে, তা বাঙালি হয়ে বলা মুশকিল। বাংলা দুনিয়ায় কতটা আদৃত হন সেই সব ভেতোবাঙালি ভূতের দল, তা জানার তেমন কোনও উপায় নেই।

এই ভূমিকাটা আসলে স্ট্যাচুটারি ওয়ার্নিং। অনেকটা ‘সিগারেট খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর’-জাতীয়। আসলে এখানে এমন এক ‘আরবান লিজেন্ড’-কে নিয়ে বলতে চাইছি, যে আজকের এই মল-ঝলমল নাগরিকতায় কতটা টিকে রয়েছে, তা জানা নেই। জানতে চাই বলেই লিখতে বসা।

শতখানেক বছর আগেই হবে। কলকাতা তখন শহর বটে। কিন্তু তার ইট-কাঠ-পাথরের ফাঁকফোকরে দেখা পাওয়া যায় পানাপুকুর অথবা মাঠকোঠা বাড়ির। রাতে গ্যাসবাতি। শানবাঁধানো চোরাগলিতে সেই আলো আঁধারকেই বেশি উৎপাদন করে। দেখলে গা ছমছম করে উঠতে বাধ্য। সেই গলিতে রাত ন’টা বাজলেই রাত নামত। গেরস্ত মানুষ খেয়েদেয়ে কুপোকাত হতো রাতপয়লাতেই। এই ঘুমের মধ্যেই নাকি জেগে উঠত সে। গলির মোড়ের গ্যাসের বাতি ততক্ষণে নিবুনিবু। ঘুমন্ত মানুষ নাকি স্বপ্নের মধ্যে শুনতে পেতো চেনা গলায় তাকে কে ডাকছে। এই ডাকে সাড়া দিলেই সর্বনাশ! প্রাণ নিয়ে টানাটানি। কদাচ সাড়া দিতে নেই সেই ডাকে। অন্তত দু’বার তো নয়ই। তৃতীয় বার যদি সেই ডাক শোনা য়ায়, তা হলে সাড়া দিলে ক্ষতি নেই। কারণ, এই ডাক পাড়া পদার্থটি মাত্র দু’বারই ডাক পাড়তে পারে। এই অপ্রাকৃত প্রাণী(?)টির নাম ‘নিশি’।

আজকের নেটজ্ঞান জানাচ্ছে— ‘ভূতদের মধ্যে অন্যতম ভয়ংকর হলো নিশি। অন্যান্য ভূত সাধারণত নির্জন এলাকায় মানুষকে একা পেলে আক্রমণ করে, কিন্তু নিশি গভীর রাতে শিকারকে তার প্রিয় মানুষের গলায় নাম ধরে ডাকে এবং বাইরে বের করে নিয়ে যায়। নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে মানুষ সম্মোহিত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে, আর কখনও ফিরে আসে না। মনে করা হয় তারা নিজেরাও নিশিতে পরিণত হয়। কিছু কিছু তান্ত্রিক অন্যের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার জন্য নিশি পুষে থাকে। লোককাহিনি অনুসারে নিশিরা কোনও মানুষকে দু’বারের বেশি ডাকতে পারে না, তাই কারও উচিত কেউ তিনবার ডাকলে বের হওয়া। তাতে নিশির আক্রমণের ভয় থাকে না।’ (উইকিপিডিয়া)

খেলা গম্ভীর সন্দেহ নেই। কিন্তু এই নিশিডাক-এর গল্প এখানেই শেষ নয়। নিশি আর তন্ত্রকে একাকার করে দেখানোর একটা প্রয়াস বাঙালির রয়েছে। কিন্তু, বিশ্বাস করুন কোনও তন্ত্রগ্রন্থে এর উল্লেখ নেই। এমনকী, টোটালি ভূত-পিশাচের কারবার যে আকরগ্রন্থে ধরা আছে, সেই ‘ভূতডামরতন্ত্র’-এর কোথাও এর উল্লেখমাত্র নেই। অথচ ‘আরবান লিজেন্ডস’ বলে, কোনও অপতান্ত্রিক একটা সবুজ ডাবের ছাল ছুলে তাতে সিঁদুর মাখায়।

তার পরে তার মুখটি কেটে নিয়ে তার জলকে মন্ত্রঃপূত করে। এবং আরও কীসব কীসব করার পরে সেই ডাব হাতে নিয়ে যাকে নিশি ডাকা হবে, তার বাড়ির কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। তখন নিশুতি রাত। অমাবস্যা-টস্যা হবে। সেখানেই নাকি ওই ডাবের ভিতর থেকে ভেসে আসে ডাক, যা শুনতে লাগে অভীষ্ট ব্যক্তির কোনও চেনা মানুষের কণ্ঠস্বরের মতো। এই ডাকে যদি লোকটি সাড়া দেয়, তাহলে তান্ত্রিক সেই ডাবের মুখটি খপ করে বন্ধ করে দেন। আর তৎক্ষণাৎ সেই লোকটি হার্টফেল করে মারা যায়।

আবার অন্য মতে, নিশি সাধারণত ছোট ছেলেমেয়েদেরই টার্গেট করে। তার ডাক দিযে সে তাদের নিয়ে যায় তার নিজস্ব জগতে। অনেকটা হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মতো। সেখানে নিয়ে গিয়ে তাদের কী ব্যবস্থা করে নিশি, তা কেউ অবশ্য বলতে পারেননি। কারণ, সেই বিবরণ দেওয়ার জন্যে কেউ ফিরেই আসেনি ‘নিশিলোক’ থেকে। কল্পনা করতে ইচ্ছে হয়, নিশি কি পিটার প্যানের মতো কোনও জীব, যে খুদে ছেলেপুলেদের ভুলিয়ে ভালিয়ে চাঁদে নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু নিশি মোটেই পিটার প্যানের মতো মজাদার নয়। সে সিরিয়াসলি ডেঞ্জারাস। কিন্তু তার উৎস ঠিক কোথায়। আর যাই হোক, তন্ত্রে সে নিহিত নেই। তা হলে?

রাত নামে শহরে। নিশি কি নামে তার সঙ্গে আজও? ছবি: পিক্সঅ্যাবে

অন্য বিভিন্ন সাক্ষ্য জানায়, নিশি নাকি সেইসব মৃত ব্যক্তির আত্মা, যাদের সদগতি হয়নি। অর্থাৎ গয়ায় গিয়ে কেউ তাদের নামে পিণ্ডদান করেনি। কিন্তু এখানেও খটকা রয়েছে, ভৌতিক দুনিয়ার লজিক অনুযায়ী, পিণ্ড না পাওয়া আত্মা সদগতি প্রাপ্তির জন্য মানুষের হাতে পায়ে ধরতে পারে। কিন্তু তাকে মেরে ফেলার চেষ্টা করবে না। নাকি এরা ভূতের জগতে খানিকটা সন্ত্রাসবাদী প্যাটার্নের, নরহত্যা করে নজরে আসতে চায় মিডিয়ার। নিজের দাবি হাসিল করতে চায়।

সে যেমনই হোক, নিশি কিন্তু একান্ত বাঙালি ভূত। তার উৎস হয়তো বাংলার আদিবাসী সমাজের ভাবনায়। কিন্তু সে ছড়িয়ে গিয়েছে বাংলার গ্রাম থেকে নগরে। শহর কলকাতা তাকে লালন করেছে সস্নেহে। সে বেঁচে থেকেছে না-ঘুমোনো শিশুদের রাত্রিকালীন কল্পনায়। সে টিকে রয়েছে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বয়ে যাওয়া মৌখিক পরম্পরায়। সে শ্বাস নেয় আজকের ইন্টারনেট দুনিয়াতেও। খাস বাঙালি এই অপ্রাকৃতের আখ্যান পড়ে সাহেবরা কী বললেন না বললেন, তাতে কিছু এসে যায় না। বই-বিমুখ, ঠাকুমা-বিচ্ছিন্ন প্রজন্ম কি-বোর্ড দাবিয়ে মাউস হাতড়েও পৌঁছতে পারছে তার কাছে, এ কি কম পাওনা!   সূত্র: এবেলা