মনিরুজ্জামান শেখ রাহুল এর ছোটগল্প ‘ঈদের জন্য’

ঈদের জন্য

মনিরুজ্জামান শেখ রাহুল

সূর্যটা মধ্য আকাশে চলে এসেছে। এ সময়ই বেড়ে গেছে নগরীর রাস্তায় মানুষের ছুটাছুটি। প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে বেড়ে যায় মানুষের এই রকম উত্তেজনা। এমনটা হওয়া অস্বাভাবিক কিছু না। আজ সাতাশ রমজান। আর বেশী সময় নেই। পবিত্র ঈদ-উল-ফিতরের প্রস্তুতি নিতে হবে এখনই। এমন সময় পাড়ার গলিতে বের হয় রফিক। দেখতে পায় প্রতিবেশীরা বাজারে যাওয়ার জন্য ব্যাকুল হয়ে গেছে। কেউ বলছে, “তাড়াতাড়ি চো বাজারে, এত দেরী করে নাকি?” আবার কেউ বলছে, “বাজারে এ্যাজকে শার্টটা মনে হয় পাবো না, অনেক দেরী হয়ে গেল। রোজার শেষের দিকে কি পাওয়া যাবে?”একজন পাঁচ বছরের শিশু তার বাবাকে বলছে, “তুমি আমাকে জুতা কিন্যা দ্যাও নি, ঈদে কিন্তু আমি জুতা পড়বো। এ্যাজকে জুতা কিন্যা দিবা।” এসব কথার কোনরুপ প্রভাব রফিকের দেহ ও মনে প্রতিফলিত হলো না। ঈদের জন্য নেই নতুন পোশাক প্রস্তুতি, নেই কোন উত্তেজনা। দিনমজুর বাবা দিনে আর কত টাকা আয় করে? তাদের জন্য অন্যান্য দিন আর ঈদের দিন যে একই। তা রফিক পরিবারের দরিদ্রতার দর্পণে স্পষ্ট দেখতে পায়। ঈদ উদযাপন করতে হবে, এসব চিন্তার রাজ্য থেকে সে কয়েক শত মাইল দূরে আছে। বছরের শেষে জে.এস.সি পরীক্ষা দিবে এমন ভাবনায় দিন কাটে।

 

যোহরের নামাজ শেষে মাঠে গিয়ে বসে রফিক সহ বন্ধু মহল। সেখানে আকাশ প্রশ্ন করে, “ফরহাদ, তোর ঈদের সব কিনা শেষ?”

হ্যাঁ, কব্বে। তোর শেষ হয়নি?

না, আমার শুধু শার্ট বাকি আছে। একে একে সবার নিকট প্রশ্ন শেষে প্রশ্নের তীর যায় রফিকের দিকে। রফিক বলে, “আচ্ছা, নতুন শার্ট-প্যান্ট না কিনলে কি ঈদ হয় না? যদি নতুন কিছু না কিনি, ত্যাহেলে কি আমার ঈদ হবে?” তখন আকাশ বলে, “এ রকম কিছই না। ঈদ হলো আনন্দের দিন। তাই সবাই নতুন শার্ট-প্যান্ট পড়ি।” এ কথা শুনে মুচকি হেসে রফিক বলে, “ত্যাহেলে আমার আর ঈদ হয়েছে। খ্যাতেই তো পাই ন্যা। ঈদে আর কি পড়বো।” এ কথা শুনে তারা পুষ্পকলির মতো নিশ্চুপ হয়ে যায়। ভাটা পড়ে যায় তাদের ঈদ আলোচনার আনন্দের জোয়ারে। রফিকের জন্য তারা ব্যাপক মর্মাহত হয়। সকলের দৃষ্টি ধাবিত হয় নিচের দিকে। রফিক বলে, “কিরে, তোরা সবাই চুপ হয়ে গেলি ক্যান? আমার পুরাতন শার্ট-প্যান্ট গিল্যা ধুয়্যা লিবো। আর স্যান্ডেল-ডা কালি কর‌্যা লিবো। ঈদের দিন তোদের সাথে ঘুরলে শার্ট-প্যান্ট দেখে কেউ বুঝবে না, কোনটা নতুন আর কোনটা পুরাতন। আর স্যান্ডেলের দিকে কেউ তাকাবেই না। পায়ের দিকে কেউ দ্যাখে নাকি?” আকাশ বলে, “তুই আমাদের বন্ধু। নতুন জামা পড় বা পুরাতন জামা, ঈদে আমরা একসাথে ঘুরবো। কি হবে?”

ঈদে নতুন জামা না থাকলে পরবী দিবে? গত ঈদে আমার নতুন জামা ছিলো না। কয়েকজনের কাছ থেকে শুধু পরবী প্যায়েছিলাম।

দিবে না ক্যান? এ্যারে পাগলা। পরবীর সাথে নতুন জামার কোন সম্পর্ক নাই। ওরা নোংরা মনের মানুষ, যারা নতুন জামা দেখে পরবী দেয়।

 

রফিক চিন্তা করতে থাকে, এবারের ঈদে না হয় হলো না। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা সর্বক্ষণ মাথায় নিয়ে বয়ে বেড়াতে চায় না। পড়ালেখা শেষ করে রফিক একটা ভালো চাকরী করবে। তখন আর কোন দুঃখ থাকবে না, থাকবে না অন্তরের রক্তক্ষরণ। শুধু নিজের জন্য না, পিতামাতাও নতুন পোশাকে ঈদ করবে। সুস্বাদু খাবার খাবে সেদিনÑ এমনটা দেখার জন্য অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকে। স্কুলের এক শিক্ষক তাকে বলেছে, “তাড়াতাড়ি মর‌্যা যাওয়াই ভালো। ব্যাচ্যা থ্যাকলে প্রতিদিন অনেক পাপ হয়।” তাই রফিক সকল পাপকর্ম থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করে। কামনা করে সেই দিনটার, যখন সে পিতামাতার সাথে আনন্দে দিন কাটাবে। এজন্য রফিক অনেক বছর বাঁচতে চায়।

 

চোখের পলক ফেলার কেটে যায় আরেকটা রোজা শেষ হয়। আজ উনত্রিশ রমজান। গত বছরে উনত্রিশটি রোজা হয়েছিলো, তাই এই বছর হয়ত ত্রিশটা রোজ হতে পারে। যদিও ঈদ ঘোষণা করা হবে চাঁদ দেখার উপর ভিত্তি করে। মাগরিবের নামাজের পর সব পরিষ্কার জানা যাবে। হঠাৎ রফিকের চিন্তার ঘোর কাটে। এসব ভেবে কি লাভ? ঈদ তো তার অন্যান্য দিনের মতোই কাটবে। রোজা উনত্রিশটা হোক বা ত্রিশটা। তাতে কি? মাগরিবের নামাজ শেষে দুই-তিন ঘন্টা অন্তেই ঘোষণা আসে না ঈদের। দেশবাসী নিশ্চিত হয়ে যায় আগামী পরশুদিন পবিত্র ঈদ-উল-ফিতর।

 

অন্যদিকে ওয়ার্ড কাউন্সিলর অনেক আগে থেকেই ঈদ শুভেচ্ছার পোস্টার বানিয়ে রেখেছিলো। আজ অবধি ওয়ার্ডের একাংশে কিছু পোস্টার লাগানো হয়েছে। ঈদ যেহুতু পরশুদিন, তাই আগামীকাল বাকী পোস্টার লাগানো হবে। রফিকদের ওয়ার্ডে তিনটি মহল্লা। কাউন্সিলর প্রতিটি মহল্লায় একজন করে লোক নিযুক্ত করে তার পোস্টার লাগানোর জন্য। রফিকদের মহল্লায় দায়িত্ব পড়ে তার বাড়ির পাশের বড় ভাই বিশালের।

রাত দশটা বাজে। এমন সময় রফিকদের দরজায় খটখট শব্দ। রফিকের মা দরজা খুলে দ্যাখে বিশাল দাঁড়িয়ে আছে। রফিকের মা বলে, “বিশাল, কি হলো?”

কাউন্সিলর এই মহল্লায় কিছু পোস্টার লাগাতে দিয়েছে। কিছু ছেলে দরকার এই কাজে। বেশীক্ষুন না, সকাল নয়টা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত। জনপ্রতি একশ টাকা দিবে। রফিক কি করবে?

আচ্ছা ঠিক আছে, রফিক যাবে নি।

ঘরে এসে রফিকের মা বলে, “শুন রফিক, বিশাল এ্যাসেছিলো কাউন্সিরের পোস্টার লাগানোর জন্য। ক্যালকে ওর সাথে য্যাস। একশ টাকা দিবেনি।” এ কথা শুনে রফিকের মুখে যেন ফুটন্ত পুষ্পের মতো হাসি আসে। রফিক বলে, “একশ টাকা দিবে! ত্যাহেলে তো য্যাতেই হবে। ক্যালকেই যাবো।”

পরের দিন বিশালের তত্ত্বাবধায়নে পোস্টার লাগানো শুরু হয়। পোস্টার পলিথিনের মধ্যে ঢুকিয়ে দড়িতে লাগিয়ে সেগুলো মহল্লার গলিতে ও রাস্তায় ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। মহল্লার একটি গলিতে রফিক পোস্টার লাগানোর জন্য গাছের উপরে উঠে। পোস্টারগুলো ভালোভাবে লাগাতে হবে যে। একশত টাকা কি এমনি দিবে নাকি? দড়ি লাগানোর সময় পাশের বাড়ির জানালায় দ্যাখে একজন বাবা তার ছেলের জন্য নতুন শার্ট, প্যান্ট ও জুতা এনে বাচ্চাটিকে পড়িয়ে দেখছে। রফিকের দৃষ্টি উড়াল দেয় সেখানে। ঈদেরই পোশাক হবে হয়ত, নতুন ও চকচক করছে। রফিক এসব ভাবতে থাকে। সে যতই বলুক, ঈদে তার নতুন পোশাকের প্রয়োজন নেই। কিন্তু মন জগতে অবশ্যই হতাশার বাতাস বয়ে যায়। নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে জানালার দিকে। দু-চোখে বিচিত্র স্বপ্নের চলচিত্র শুরু হয়। নতুন পোশাক পরিহিত শিশুটির শরীরের স্থানে নিজের শরীর আবিষ্কার করে। বাহ্, সুন্দর লাগছে তাকে। হঠাৎ জাগ্রত এই স্বপ্নে ভাটা পড়ে যায়। বিশাল চিৎকার করে বলছে, “এই রফিক দড়িটা ব্যান্ধে দে, কি হলো।?” একটু ভয়ে ভয়ে রফিক বলে, “হ্যাঁ ভাই, বান্ধছি।” পোস্টার লাগানো শেষ হলে বিশাল সকল ছেলেদেরকে নিয়ে যায় কাউন্সিলরের চেম্বারে। কাউন্সিলর সেখানে সকলকে ইফতার করাবে। রফিকের সামনে ইফতারের প্লেট রয়েছে। সেখানে রয়েছে খেজুর, পানি, শরবত, জিলাপি সহ অন্যান্য ফল। কিছুক্ষণ পর মসজিদ থেকে মাগরিবের আযান ভেসে আসে। সকলেই ইফতার শুরু করে, সাথে রফিকও। রফিক সব খাবারই খেয়ে ফেলে শুধু জিলাপি ছাড়া। তা দেখে বিশাল বলে, “কিরে রফিক, জিলাপি খাবি ন্যা?”

না ভাই, আমার আম্মু জিলাপি খুব পছন্দ করে। আম্মুর জন্য লিয়্যা যাবো।

ও আচ্ছা, ত্যাহেলে লিয়্যা যা। সকলের ইফতার শেষ হলে পোস্টার লাগানো ছেলেদের প্রত্যেককে কাউন্সিলর একশত টাকা দেয়। টাকা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ও জিলাপি হাতে নিয়ে রফিক রওনা হয় বাড়ির দিকে। মাকে জিলাপি দিয়েই দৌড় দেয় নগরীর বাজারের ফুটপাতে। সেখানে গিয়ে দ্যাখে শার্ট ও প্যান্টের মূল্যে ছাড় দেওয়া হয়েছে। বিক্রেতা বলছে, “যেড্যাই কিনেন না ক্যান, দাম মাত্র পঞ্চাশ টাকা।” রফিক আর বিলম্ব করে, সেখান থেকে পছন্দ করে শার্ট ও প্যান্ট কিনে নেয়, ঐ একশত টাকা দিয়ে। তারপর বাড়ির দিকে ফিরে। পাড়ার গলিতে ঢুকে দ্যাখে তার বন্ধুরা পটকা ও আতশবাজি ফুটাচ্ছে। রফিক হাসতে হাসতে মুখের উনত্রিশটা দাঁত বের করে আকাশকে বলে, “এই দ্যাখ পোস্টার লাগানোর একশ টাকা দিয়ে শার্ট-প্যান্ট কিনলাম। ভালো হলো রে?”

হ্যাঁ, হ্যাঁ। অনেক সুন্দর হয়েছে। ভালো ল্যাগছে তো।

যাহ্, তুই পাম ম্যারছিস।

পাম দিবো ক্যান বে? আমার মতোই হয়েছে তোর শার্ট-প্যান্ট।

সত্যিই তোর মতো হয়েছে।

হ্যাঁ, সত্যিই বলছি। এ কথা শুনে এবার রফিক আরো আনন্দিত হয়ে যায়। আকাশ বলে, “তুই এ্যাগলে বাড়িতে রেখে আয়। পটকা ফুটাই সবাই একসাথে।

থাম আসছি আমি। এ কথা বলেই রফিক চলে যায় বাড়িতে। এখনও রফিকের মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে। মালেক তখন আকাশকে বলে, “রফিক এত খুশি ক্যান?”

ওই পোস্টার লাগানো টাকা দিয়ে ফুটপাত থেকে শার্ট-প্যান্ট কিন্যাছে।

ও আচ্ছা, আমাদেরকে তো আব্বু কিন্যা দিয়েছে। আমরা খুশি কিন্তু ওর মতো না।

হ্যাঁ, মালেক। এই ঈদটা আমাদের না, ঈদের দিনটা রফিক এখন নিজের নামে করে নিলো।

লেখকঃ মনিরুজ্জামান শেখ রাহুল, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের কম্পিউটার অপারেটর। তিনি ছোটগল্পটি দরিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করতে থাকা সকল কিশোরদেরকে উৎসর্গ করেছেন।