মনিরুজ্জামান শেখ রাহুলের ছোটগল্প “পরোপকারী”

মনিরুজ্জামান শেখ রাহুল

আজ প্রচন্ড গরম পড়েছে। এই অসহনীয় রৌদ্রতাপে হাড় জ্বলে যাচ্ছে। চারিদিকে শুধু তাপ আর তাপ। সূর্য মামা মনে হয় ব্যাপক রেগে গেছেন। তবে বিষয়টা তার একবার হলেও বিচার আবশ্যক যে, বিশ্ববাসী তাকে মামা বলে ডাকে। তাই ভাগ্নে-ভাগ্নিদের এই রুদ্র প্রকোপ কেন সহ্য করতে হচ্ছে? হয়ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। এইদিকে তাই সবাই সেই ক্রোধের দাবানলে পুড়ছে। পথিকের যেন নাজেহাল দশা। লাউ গাছের মতো নুয়ে পড়ছে ক্রমশই। তবুও এই অগ্নিপর্বতের তীব্রতাকে গায়ে না মেখে অনায়াশে চলছে সাজেদুর। সৃষ্টির সেবাকে মূল কর্ম হিসেবে নির্বাচন করেছেন তিনি। যদিও একজন সরকারি কর্মচারী, তবুও সমাজসেবায় থাকলে যেন তার শরীরে প্রাণশক্তি সঞ্চারিত হয়। সেজন্য সমাজের অন্যান্য মানুষের চেয়ে তিনি ভিন্ন। যখন পাড়ার কোন বাড়িতে মহল্লাবাসীদের দাওয়াত দিলে অনেকেই সেখানে তিন গোষ্ঠি মিলে খেতে যায়। আমন্ত্রনপত্র যায় একজনের ঠিকানায়, আর দাওয়াতের খাবার গিলে গণগোষ্ঠি। যদি সম্ভব হয় তাহলে পলিথিনটা পকেটে নিয়ে যেতে কোনরুপ ভুল করে না। পক্ষান্তরে আবার তারাই আমন্ত্রন দেয়া মানুষদের সমন্ধে কুৎসা করে বেড়ায়। এমন একটি সমাজে থেকে সাজেদুরের মানব বৈশিষ্ট্যের ভিন্নতা প্রত্যক্ষ করে শিক্ষায় আলোয় বিকশিত উজ্জ্বল চক্ষুবিশিষ্ট মানুষেরা।

এলাকার কেউ সমস্যাগ্রস্থ হলেই সেখানে বাতাসের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ছুটে যায়। না, সে সুপারম্যান না। কিন্তু তার ছুটে চলার গতি হয়ত সুপারম্যানকেও হার মানাবে। তার বিশ্বাস, একদিন সে জীবিত থাকবে না কিন্তু এই পরোপকারের মধ্যে দিয়ে সে সমাজের মানুষের হৃদয়ে জীবিত থাকবে।

এই কয়েকদিন আগের কথা। সাজেদুরের পাশের বাড়ি থেকে মা-ছেলের কথাপোকথন চলছে। সাজেদুরের মনোযোগ চলে যায় সেদিকে। ছেলেটি মাকে বলছে, “বাংলা দ্বিতীয় বই কিন্যা দ্যাও। স্যার বকছে আমাকে।”
স্যারকে বলো, সামনে মাসে আব্বু বেতন প্যালেই কিনে দিবে।

ঠিক আছে, তাই বলবোনি। এদিকে সাজেদুর সব কথা শুনে হনফনিয়ে চলে তাদের বাড়িতে। সেখানে যেয়ে ছেলেটিকে বলে, “তোর কি শুধু বাংলা দ্বিতীয় লাগবে, না আরো বই লাগবে?”

শুধু বাংলা দ্বিতীয়।
ত্যাহেলে চ বাজারে। বাজারে গিয়ে ছেলেটিকে বই কিনে দেই। সেই সাথে তাকে পড়ালেখায় মনোযোগি হওয়ার পরামর্শ দেয়। আরো বলে দেয় যদি পড়ালেখা করার জন্য কিছু লাগে সে সাজেদুরকে যেন জানায়। “ঠিক আছে, চাচা” উত্তর দিয়ে ছেলেটা বইটি বুকে জড়িয়ে স্কুলের দিকে রওনা দেয়। সাজেদুর মুচকি হেসে তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জীবিত অবস্থায় সে নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিতে চায়। শুধু দান করতে পারে না নিজেকে। এইরকম সমাজসেবায় অবদান রাখায় নগর জুড়ে রয়েছে তার সুনাম। তবে এই পরোপকার করতে গিয়ে অনেক কিছুই বলিদান দিতে হয়েছে তাকে।

গত ঈদের কয়েকদিন আগের ঘটনা। ঈদ উপলক্ষে সে প্যান্ট ও শার্ট কিনে এনেছে। বাড়ির গিন্নির তো বেশ পছন্দ। তবে সেই পছন্দের উল্লাস বেশীক্ষণ টিকে নি। যখন শুনলো ফুপাত ভাইয়ের কিছু কেনা হয় নি। তখনও পোশাকগুলো দিয়ে দেয় ভাইকে। এই নিয়ে গিন্নির সাথে তো ব্যাপক হট্টগোল। যেমন তেমন নয়। যেন হিমালয় পর্বত ভেঙে পড়ার উপক্রম। বাকবিতন্ডা করে গিন্নি চলে গেল বাপের বাড়ি। আজও ভদ্রমহিলার শূণ্যতা অনুভব করে। এই জীবনে তাই তেমন কোন স্বাদ পাই না। তাই নিজের শরীরটাকে বিলিয়ে দিতে ইচ্ছে করে তার। কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব? তাই সে আরো উদারতার সাথে দানের দরজা প্রশস্ত করতে থাকে।

কয়েকদিন আগে এলাকার মজিদ তার ভাগ্নি মেঘনার একটা সমস্যা নিয়ে যায় সাজেদুরের কাছে। অনুরোধের সকল পর্যায় অতিক্রম করে বিস্তর আকুতি মিনতি। বড় জোর নিবেদন। মজিদ জানায় মেঘনা একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক পাশ করেছে। এরপরেই উপাচার্য সকল শিক্ষার্থীদের অন্য আরেকটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থানান্তর করে। কিন্তু স্নাতক পাশের সনদপত্র দেয়া হয় না মেয়েটাকে। অফিসের কেরানী মশাই বলছে পাঁচ হাজার টাকা লাগবে। মেঘনা পাঁচ হাজার টাকা নেয়ার কারণ জানতে চাইলে বলে উপাচার্য স্যারের কাছে যেতে। এই দিকে উপাচার্যের কাছে গেলে তিনি মেয়েটি নাগরদোলার মতো ঘুরাচ্ছে। উপাচার্য কেন এমন করছেন তা বুঝা বড় দায়। এমন অভিনয় দেখায় যেন সে আলু-পেঁয়াজ কাটতে মহাব্যস্ত। তখন সাজেদুর নিজে উপাচার্যের কাছে যায়। প্রথমে তিনি রাজী হন নি। তাতে কি? যেমন বুনো ওল, তেমনি বাঘা তেতুল। সাজেদুর তো নাছোড়বান্দা। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে সেখানে যান। শুরু উপাচার্র্যের সাথে তুলকালাম মহাকা-। উপাচার্য যখন সমুদ্রের পানির মধ্যে ডুবে যাওয়ার অবস্থা ঠিক তখনই রাজি হয়। স্থানান্তর হওয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মেয়েটিকে সার্টিফিকেট দেয়া হয়। মেয়েটির মুখে পূর্ণিমার চাঁদের মতো হাসির ঝলক দেখা যায়। সফলতার রঙে আঁকানো প্রসন্ন মনে মেয়েটি গ্রামের বাড়িতে যায়। সবাইকে ডেকে সার্টিফিকেট দেখায়। তবে সফলতার রঙ কালো বর্ণে ছেয়ে যায়। অনেকেই বলে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে এসব সার্টিফিকেট টাকা দিয়ে কেনা যায়। তাই এটি মূল্যহীন। হতাশা ফুটে উঠে মেয়েটির দৃষ্টিতে। পরের দিন সাজেদুরের সাথে দেখা হয় মজিদের। সাজেদুর বলে, “কিরে মজিদ, মেঘনার কি খবর?”
আর কি বলব। ওখানকার মানুষরা বলছে, ঐ সার্টিফিকেট নাকি ভুয়া। টাকা দিয়ে কিনা যায়, তাই বলছে।
মেঘনাকে আমার সাথে দেখা করতে বলিস।
বড় ভাই, আপনি অনেক কিছু কর‌্যাছেন। থ্যাক, নাকি?
এবার সুনামির মতো সাজেদুরের রাগের জোয়ার উঠে, সাজেদুর বলে, “তোকে যা বললাম, তাই কর। বেশী কথা বলিয়ে লিস ন্যা। এডে আমি পছন্দ করি ন্যা।
ঠিক আছে ভাই আমি ওকে বলছি।

পরের দিনের সূর্যোদয়টা দেখার জন্য বাড়ির ছাদে সাজেদুর আনমনা হয়ে তাকিয়ে থাকে পূর্বদিকে। উজ্জ্বল বর্ণধারী সূর্যটা ধীরে ধীরে উদিত হচ্ছে। সেই সঙ্গে বয়ে চলেছে শীতল বাতায়ন। বাতাসে তার কাঁচা-পাকা চুলগুলো উড়ছে। এমন মনোরম পরিবেশে সাজেদুরের মনে স্নিগ্ধতার শিহরণ জাগে। এই মনোমুগ্ধকর মুহূর্তগুলো কেউ কেড়ে নিতে পারে না। পারবেও না। হৃদয় গহীনে তেমন কোন হতাশা নেই, নিজের সবকিছু বিলিয়ে দিতে চায় সে। তার মনে আবার কিসের কষ্ট? হয়ত অভিনয় করতে পটু বলেই কারো বুদ্ধিদৃষ্টি সেই কষ্ট দেখতে পাই না। বউ যে এখনও অভিমান করে আছে। সেই হতাশার অগ্নিতে এখনও জ্বলছে তার হৃদপিন্ড। সে যদি সাজেদুরের চিন্তাধারা বুঝত। এমনই ভাবনার রাজ্যে সাজেদুর ঘুরাঘুরি করতে থাকে। বাইরের দরজায় হকারের সাইকেলের শব্দ শুনে নিচে নেমে এসে পেপার নেয়। পেপার পড়া শুরু করে সাজেদুর। কিছুক্ষণ পর মেঘনা আসে। মেঘনাসহ নিজে সকালের নাস্তা করে গেল এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে উপাচার্যের সাথে কথাপোকথন করছে। সাজেদুরের হাতে গরম চায়ের কাপ। তীব্র গরম চায়ের আলতো চুমুক দিতেই মূর্তির মতো নিশ্চুপ হয়ে যায়। এত গরম চা। অতঃপর উপাচার্যের দিকে মজার দৃষ্টিতে তাকিয়ে সাজেদুর বলে, “বউ তো আমার প্রতি অভিমান করেছে স্যার। কারণটা ভালোভাবেই জানি। আমার উপর আপনার কিসের রাগ?
রাগ হবে কেন, বড় ভাই? অবাক হয়ে ভিসি বলে।
অবশ্যই কোন কারণে আপনি আমার উপর ক্ষিপ্ত। এটা চা স্যার নাকি আগ্নেয়গিরির লাভা? মুচকি হেসে সাজেদুর।
কেটলি চুলার উপর অনেকক্ষণ যাবত ছিলো, তাই একটু বেশী গরম হয়ে গেছে, ভাই। কাতর কণ্ঠে ভিসি।
ঠোঁট, জিহ্বা দুইটাই পুড়ে গেছে। নিজেই রান্না করে খেতে হয়। সেটাও হবে না। মুখের সতেরটা দাঁত বের হেসে সাজেদুর বলে।
এইটা তেমন কিছু না ভাই, একটু ঠান্ডা পানি খান। ঠিক হয়ে যাবে। জলিল, ভাইকে ঠান্ডা পানি দাও তো। এবার একটু হেসে বলে ভিসি।
ঠান্ডা পানি খাবো না। আপনি শুধু মেয়েটিকে সান্ধ্যকালিন এমবিএ তে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেন। অনুরোধ করে বলে সাজেদুর।
ঠিক আছে, আগামীকাল ভর্তি ফর্ম ও ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে আসেন আমার কাছে। বাকিটা আমি করে দিবো। আশ্বাস দিয়ে বলে ভিসি।
এতক্ষণে চা স্বাভাবিক মাত্রায় চলে এসেছে। চা খেয়ে মেঘনাকে নিয়ে বাইরে যায় সাজেদুর। পরের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজ খরচে মেয়েটিকে ভর্তি করিয়ে দেয়। মেঘনা বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। একজন অপরিচিত মানুষ তার জন্য এত কিছু কেন করছে? আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে যে মেঘনা নগরীর একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে এমবিএ করছে। যে গ্রামের সমালোচকদের ছেলে মেয়েরাও পাবলিকে এমবিএ করতে পারে নি। সাজেদুর এখানেই থেমে যায় নি। মেঘনাকে মেসে একটি রুম নিয়ে দেয়। এরপর মেস ভাড়া সহ তার পড়ালেখার খরচ সম্পূর্ণ নিজে বহন করতে থাকে। গ্রীষ্মকালিন ছুটিতে মেয়েটি গ্রামের বাড়িতে যাবে, এ কথা শুনে গ্রামে পড়ে আনন্দের রেশ। মেয়েটি যায় নিজ গ্রামে। তার পিতা খালেক সাজেদুরের দীর্ঘায়ূ কামনা করে গ্রামে দুঃস্থ্য ও এতিমদের জন্য মধ্যাহ্ন ভোজ ও বাদ আসর দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। সাজেদুরকে সেখানে আসতে বলা হয়। সাজেদুর যাবে বলে কথা দেয় খালেককে।

পরের দিন দুপুরে যথারীথি আয়োজন শুরু হয়। বাড়ির উঠানে দুঃস্থ্য ও এতিমদের বসিয়ে খাওয়ানো শুরু হয়েছে। খালেক সবাইকে খাওয়াচ্ছেন। অতঃপর সে দ্যাখে একজন মধ্যবয়স্ক এক লোক মাথা নিচু করে গোশত ও ঝোল চায়ছে। খালেক তার থালাতে গোশতসহ ঝোল দিয়ে বলল, “আর কিছু ল্যাগবে ভাই?” লোকটি মাথা তুলতেই খালেক অবাক। হা করে তাকিয়ে থাকে লোকটির দিকে। বলে উঠে, “সাজেদুর ভাই আপনি।”

হ্যাঁ, ভাই। খুব খিদ্যা ল্যাগেছিলো। তাই আপনার সাথে দেখা না কর‌্যাই বস্যা গেছি।
কিন্তু এখানে ক্যান, ভাই। আসেন, চেয়ার-টেবিলে বসেন।
না ভাই, এখানে এতিমরা খাচ্ছে। আমিও তো এতিম। তাই এদের সাথে খাই। এতেই আমাকে প্রশান্তি লাগে।
ত্যাহেলে ঠিক আছে ভাই। আপনার আর কিছু কি ল্যাগবে, ভাই?
আমার কিছু ল্যাগবে না। এই ছ্যালেডাকে গোশ দ্যাও । থালি চর্বিতে ভরে গেছে। গোশই তো নাই। দ্যাও, গোশ দ্যাও।

লেখকঃ মনিরুজ্জামান শেখ রাহুল, রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের কম্পিউটার অপারেটর।